বাংলাদেশ স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পূর্ণ করে ৫২ বছরে পা দিয়েছে। স্বাধীনতার এত বছর পর এ দেশের মানুষের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির হিসাব মেলাতে গিয়ে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে ঈর্ষণীয় হারে। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় এবং বিশ্বে ৪১তম। অর্থনীতির উন্নতির এ গতি যদি ধরে রাখা যায়, তাহলে ২০৩৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের ২৪তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে।
বাংলাদেশের শুরুটা এমন ছিল না। স্বাধীনতার অব্যবহিত পর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে ছিল পরনির্ভর ও ঋণনির্ভরশীল এক দেশ। শূন্য থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ে উন্নয়নের কৌশল পরিবর্তন ও বৃদ্ধির মাধ্যমে বাংলাদেশ আজকের এ অবস্থানে এসে পৌঁছেছে। স্বাধীনতার পর যেখানে মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ১২৯ মার্কিন ডলার, বর্তমানে তা বেড়ে ২ হাজার ৮২৪ ডলারে দাঁড়িয়েছে।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চে ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে ‘মুক্তির সংগ্রাম’-এর কথা বলেছিলেন, সেই মুক্তি শুধু শত্রুর কবল থেকে দেশকে মুক্ত করা নয়। সেই মুক্তি ছিল এ দেশের মানুষকে দারিদ্র্য ও ক্ষুধা থেকে মুক্তি, অশিক্ষা ও কুসংস্কার থেকে মুক্তি, সামাজিক বৈষম্য থেকে মুক্তি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার অঙ্গীকার ছিল—মানুষ তিন বেলা খাবার পাবে, সবার থাকার ঘর হবে, সুচিকিৎসা নিশ্চিত হবে। শিক্ষার আলো পাবে, কর্মসংস্থান হবে, মানুষের মানবিক মর্যাদা রক্ষা পাবে। সর্বোপরি এ দেশে আইনের শাসন ও মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হবে।
এর মধ্যে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পিছিয়ে থাকলেও বাংলাদেশ তার অঙ্গীকার পূরণের পথেই এগিয়ে চলেছে। কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যব্যবস্থা, মানুষের গড় আয়ু, শিল্পকারখানা, আমদানি, রপ্তানি, রিজার্ভ, জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার, মাথাপিছু আয় এবং সামাজিক অনেক সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে; এমনকি ভারতের চেয়েও অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এগিয়ে আছে।
কৃষি খাতে বাংলাদেশ অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে। খাদ্য উৎপাদনে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানে পৌঁছাতে বাংলাদেশের কৃষক প্রভূত সাফল্য দেখিয়েছেন। ১৯৭২-৭৩ সালে খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিমাণ যেখানে ৯৯ দশমিক ৩০ লাখ টন ছিল, বর্তমানে তা বেড়ে ৪ কোটি ৫৩ লাখ ৪৩ হাজার মেট্রিক টন হয়েছে। আয়তনে বিশ্বের ৯৪তম দেশ হলেও সবজি উৎপাদনে তৃতীয় এবং মৎস্য উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। ফলমূল উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। মৌসুমি ফল উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের তালিকায় নাম লিখিয়েছে বাংলাদেশ। ২০ বছর আগে বাংলাদেশের প্রধান ফল ছিল আম-কাঁঠাল। এখন ৭২ প্রজাতির ফলের আবাদ হচ্ছে দেশে। শিক্ষাব্যবস্থায়ও আমূল পরিবর্তন এসেছে। শিক্ষাকে সর্বস্তরে ছড়িয়ে দিতে শতভাগ ছাত্রছাত্রীর মাঝে বিনা মূল্যে বই বিতরণ কর্মসূচি এ ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখেছে। ১৯৯০ সালে বিদ্যালয়ে শিশু ভর্তির হার ছিল ৬১ শতাংশ, বর্তমানে তা দাঁড়িয়েছে ৯৭ দশমিক ৭ শতাংশে; বিশেষ করে নারীশিক্ষাকে উৎসাহিত করার পদক্ষেপ দেশে শিক্ষাবিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বিশ্বের অন্য অনগ্রসর দেশগুলো যেখানে শিক্ষায় ছেলেমেয়ের সমতা অর্জনে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে আমাদের দেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক দুই স্তরেই মেয়েরা ছেলেদের সঙ্গে সমতা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। প্রাথমিকে ছাত্রীদের হার প্রায় ৫১ শতাংশ এবং মাধ্যমিকে প্রায় ৫৪ শতাংশ। এ হার বিশ্বে নজর কেড়েছে। আশার বিষয়, এখন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও ছাত্রীদের অংশগ্রহণ ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। নারীশিক্ষা কেবল নারীদের জন্য জীবিকা অর্জনে সুযোগ সৃষ্টি করেনি; বরং লিঙ্গবৈষম্য দূর করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। স্বাধীনতার পরপর আমাদের সাক্ষরতার হার ছিল ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ, এখন সেই হার পৌঁছেছে ৭৫ দশমিক ৬ শতাংশে।
উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় নারীর ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছে। দেশে ১৫ বছরের বেশি বয়সীদের সাক্ষরতার হার ৭৫ দশমিক ৬ শতাংশের মধ্যে সমবয়সী নারীদের সাক্ষরতার হার ৭৩ শতাংশ। দেশের মোট শ্রমজীবী কর্মজীবী নাগরিকের প্রায় ৩৮ শতাংশ নারী। শ্রমজীবী নারীর সিংহভাগই অবশ্য তৈরি পোশাক খাতে নিয়োজিত। প্রশাসনসহ সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে বেড়েছে নারীর অংশগ্রহণ। স্বাস্থ্য বিষয়েও আমাদের অর্জন প্রশংসনীয়। স্বাধীনতার ঠিক পরই মানুষের গড় আয়ু ছিল ৪৬ বছর, এখন মানুষের গড় আয়ু বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭২ দশমিক ৬ বছর। যেখানে ভারতের গড় হচ্ছে ৬৫ বছর। শিশুমৃত্যুর হারে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় এগিয়ে আছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর শিশুমৃত্যুর হার যেখানে হাজারে ৫২, সেখানে বাংলাদেশে ৩৫ জন।
শিল্প ও বাণিজ্যক্ষেত্রে, বিশেষ করে পোশাকশিল্পে বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়ে গেছে। তা ছাড়া পরিকাঠামোগত, আবাসন, ওষুধশিল্প, জাহাজনির্মাণ, বিদ্যুৎ উৎপাদন, বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত খাদ্যসামগ্রী ও আইটি সেক্টরে বাংলাদেশ বহির্বিশ্বের আগ্রহের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু ও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র দেশের বর্তমান উন্নয়ন ধারার অন্যতম উদাহরণ। এর মধ্যে পদ্মা সেতু নির্মাণ শেষে চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলমান।
এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশ নব্বইয়ের দশকের পর থেকেই সার্বিক প্রবৃদ্ধিতে অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের গড় হারের তুলনায় অনেক এগিয়ে আছে।
বাংলাদেশের এই অগ্রগতির ধারাকে অব্যাহত রাখতে চাই সম্পদের সুষম বণ্টন ও মানবসম্পদের উন্নয়ন। আমাদের বিপুল কর্মক্ষম জনশক্তিই সার্বিক উন্নয়নের চালিকা শক্তি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এই জনসম্পদের প্রতি যতটুকু যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন ছিল, অনেক ক্ষেত্রেই আমরা তা নিশ্চিত করতে পারছি না। দিন যতই গড়াচ্ছে, ততই যেন ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান বেড়েই চলেছে। যে বৈষম্য দূর করার অঙ্গীকার নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল, স্বাধীনতার পর ধনী-দরিদ্রের সম্পদের বৈষম্য যেখানে ২ দশমিক ৪ ছিল, বর্তমানে তা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে।
ফলে মানুষে মানুষে বিচ্ছিন্নতা এবং সমাজে বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে আমাদের সমাজে একশ্রেণির বিত্তশালী ও ক্ষমতাসীনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যার প্রভাব সুদূরপ্রসারী। আমাদের দেশে, দুর্নীতি ও অর্থসম্পদ লুণ্ঠনের অনৈতিক যে ধারা চালু হয়েছে, তা দেশের উন্নয়নের জন্য হুমকিস্বরূপ। নৈতিকতা-মূল্যবোধ-সততা ও আদর্শহীন কিছু মানুষের ক্ষমতা এবং বিত্তের প্রতি লোভ দেশের অগ্রযাত্রাকে করছে ব্যাহত। ইতিমধ্যে একশ্রেণির মানুষ দেশের যে সম্পদ লুট করেছে এবং যে বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশের বাইরে পাচার করে দিয়েছে, তা যদি বন্ধ করা যেত, তাহলে বাংলাদেশ আরও বেশি এগিয়ে যেতে পারত।
মানবিক সূচকে পিছিয়ে থেকে শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়ন দিয়ে একটা দেশের সার্বিক অগ্রগতির সাফল্য দাবি করা যায় না। অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি মানবিক মর্যাদা, আইনি সহায়তা এবং গণতান্ত্রিক কাঠামো জোরদার করা গেলে দেশের মানুষ স্বাধীনতার পূর্ণ স্বাদ গ্রহণ করতে পারবে।
নাগরিকের সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক চর্চা ও পূর্ণ গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগ করতে যা বোঝায়, আমাদের দেশের মানুষ তা যথাযথভাবে ভোগ করছে বলা যাচ্ছে না। ‘আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব’ এই অবস্থান থেকে সরে যাওয়া দুঃখজনক। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায়ের কয়েকটি নির্বাচনে ভোটের যে চিত্র দেখা গেছে, তা হতাশাব্যঞ্জক। ভোটাধিকার হলো গণতান্ত্রিক চর্চার অন্যতম অঙ্গ। মানুষকে ভোট প্রয়োগের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে যে গণতন্ত্রের (উন্নয়নের গণতন্ত্র) কথাই বলি না কেন প্রকৃত অর্থে তা অগণতান্ত্রিক ধারারই নামান্তর। ডিজিটাল আইন প্রণয়ন এবং এর অপপ্রয়োগ, মানুষের বাকস্বাধীনতাকে হরণ করেছে। ডিজিটাল আইনে একের পর এক মামলা দিয়ে মানুষের মনে ভয় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। সমাজে বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি চালু হয়েছে, তা মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনের প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাবলয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ইশারায় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কাজ করতে দেখলে, সাধারণ মানুষ ন্যায়বিচার পাওয়ার ব্যাপারে অসহায় বোধ করে বৈকি।
এক যুগ ধরে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি হয়েছে। এ জন্য বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার অবশ্যই সাধুবাদ পেতে পারে; তবে এ কথাও ঠিক, এই সময়ের মধ্যেই এমন কিছু ঘটনা ঘটছে, যেগুলোকে অগ্রগতির পথের কাঁটা হিসেবেই দেখছে সবাই।
যত দিন পর্যন্ত সাংবিধানিক নাগরিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করা না যাবে, তত দিন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অর্থাৎ সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে—বলা যাবে না। একটা কথা মনে রাখতে হবে, বহু নির্যাতন সহ্য করে, লাখো প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যই ছিল জনগণ, সমাজ ও রাষ্ট্রের সার্বিক উন্নতি করা। আমার বিশ্বাস, উন্নয়নের সঙ্গে গণতান্ত্রিক অধিকার, বাকস্বাধীনতা, দুর্নীতি দমন ও সমাজে সুবিচার প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে, বাংলাদেশ তার লক্ষ্য পূরণে সামনে এগিয়ে যাবেই যাবে।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ও কলাম লেখক