বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে চার দিনের সফরে (৫ থেকে ৮ সেপ্টেম্বর) ভারত সফরে গিয়েছেন। নানা দিক থেকেই প্রধানমন্ত্রীর এ সফরটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের রয়েছে অসংখ্য স্বার্থসংশ্লিষ্ট ইস্যু। সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন, বাংলাদেশ কতটুকু কী আদায় করতে পারল। বিরোধপূর্ণ ইস্যুগুলোর কতটুকু কী হলো। এবারও প্রধানমন্ত্রীর সফরে এই প্রত্যাশার প্রতিফলন লক্ষ করা যাচ্ছে।
প্রায় তিন বছর পর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লি সফর করছেন। আওয়ামী লীগের রাজনীতির জন্য নির্বাচনের আগের বছরে শেখ হাসিনার এই সফরের গুরুত্ব নিয়ে চলছে নানা আলোচনা। এখানে বলে রাখা ভালো, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিষয়টি অত্যন্ত জটিল। প্রায় একই রকম সংস্কৃতি, একই শাসকের অধীনে শাসিত হওয়ার ঐতিহ্যের কারণে ভারতের ব্যাপারে বাংলাদেশের মানুষের এক জটিল মনস্তত্ত্ব কাজ করে। এটা একই সঙ্গে ভালোবাসা ও বিরোধের। প্রেম ও বিদ্বেষের।
ভারতীয় পোশাক, প্রসাধনী, সিনেমা, গান, টিভি অনুষ্ঠান, লেখাপড়া, চিকিৎসা বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষের এখনো প্রিয়। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের রাগ-ক্ষোভ-ঘৃণাও ভারতের প্রতিই বেশি।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ভিত রচিত হয়েছিল ১৯৭১ সালে, বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সরকার ও জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থনের মধ্য দিয়ে। এ কথা ঠিক যে ভারতের সাহায্য ও সমর্থন না পেলে বাংলাদেশের পক্ষে হয়তো নয় মাসে স্বাধীনতা লাভ করা সম্ভব হতো না। সে জন্য বাংলাদেশের মানুষের ভারতের প্রতি একধরনের কৃতজ্ঞতা রয়েছে। আবার বাংলাদেশের ‘ন্যায্য হিস্যা’ প্রদানে অনীহা আর ‘দাদাগিরি’র কারণে প্রতিবেশী এই রাষ্ট্রটির প্রতি আমাদের দেশের মানুষের বিদ্বেষও কম নেই। মাঝে মাঝে তা বেশ প্রকটভাবেই প্রকাশ পায়।
তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশি নাগরিকদের যেমন ভারতে যাওয়ার সংখ্যা অনেকটাই বেড়েছে, তেমনি ভারত থেকে বাংলাদেশে আসার সংখ্যাও বেড়েছে। ভারত সরকার বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা দেওয়ার বিষয়টি আগের তুলনায় সহজ করেছে। গত এক দশকে নানা সন্দেহ, অবিশ্বাস, বঞ্চনার অনুভূতি সত্ত্বেও ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন এসেছে। এই সময়ে দুই দেশ যেসব বিষয়ে চুক্তি করেছে, সেটি একটি সময়ে অনেকে ভাবতেও পারেননি। এ সময়ের মধ্যে ভারতে সরকার বদল হলেও বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কে এখনো কোনো ভাটা পড়েনি। ছিটমহল বিনিময়, ভারতকে সড়কপথে ট্রানজিট দেওয়া, চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া, ভারত-বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা চুক্তি কিংবা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমনে বাংলাদেশের সহায়তা—এই সবকিছুতে অভাবনীয় অগ্রগতি হয়েছে।
কিন্তু বহুল প্রত্যাশিত তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি না হওয়া, সীমান্তে গুলি করে বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যা বন্ধ এবং রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারকে ভারতের চাপ দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের ভেতরে নানা সমালোচনা রয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের অনেক মানুষই মনে করেন, গত ১২ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের স্বার্থকে যতটা প্রাধান্য দিয়েছে, বিনিময়ে ভারত বাংলাদেশকে ততটা মূল্যায়ন করেনি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে নতুন কোনো চুক্তি নিয়ে আলোচনার কথা শোনা যায়নি। তবে কূটনৈতিক মহলে তিস্তার পানিবণ্টন, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিরাপদে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর বিষয়টিই আলোচিত হচ্ছে বেশি। এর মধ্যে তিস্তার পানিবণ্টনের প্রসঙ্গটিই ঘুরেফিরে সামনে চলে আসছে। ২০১১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় দুই দেশের মধ্যে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি সম্পাদন হবে বলে ঠিক হয়েছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তিতে শেষ পর্যন্ত তা বানচাল হয়।
এরপর ২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে এলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর এ বিষয়ে আলোচনা হয়। বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তা চুক্তি দ্রুত সম্পাদনের আশ্বাস দেন তিনি। এরপর বিষয়টি আর এগোয়নি।
এর আগে ২০১৯ সালের অক্টোবরে ভারত সফরে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ২০২১ সালের মার্চে বাংলাদেশ সফর করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের দিল্লি সফর দুই দেশের সম্পর্ককে পরবর্তী ধাপে নিয়ে যাওয়ার একটি ভালো সুযোগ। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য, ভারতীয় ঋণে বাংলাদেশে হাতে নেওয়া প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের জন্য অর্থছাড় ও বিনিয়োগ নতুন মাত্রা পেয়েছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও কানেকটিভিটির ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি নতুন প্রকল্প উদ্বোধনের অপেক্ষায় রয়েছে। ভারত-বাংলাদেশ সুসম্পর্ক উভয় দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উভয় দেশের নেতারা যত বেশি পরস্পর দেখা করবেন, কথা বলবেন, তত সম্পর্কোন্নয়নের একেকটি ধাপ অতিক্রম করা হবে। কিন্তু তা যথাযথভাবে হচ্ছে না। দুই দেশের নেতা ও কর্মকর্তাদের মধ্যে যতটুকু যা কথা হয়, চুক্তি হয়, তা খুব একটা বাস্তবায়িত হয় না। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কথা দিয়েছিলেন, শিগগিরই সমস্যার সমাধান হবে। কিন্তু এখনো তার সিকি ভাগও এগোয়নি।
উপমহাদেশ এবং এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল ঘিরে বাণিজ্যিক ও রাজনীতির নতুন পটভূমি তৈরি হচ্ছে; বিশেষ করে তাইওয়ানকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বিরোধ ও চলমান বাণিজ্যযুদ্ধ এ অঞ্চলের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে ক্রমেই জটিল করে তুলছে। এই পরিস্থিতিতে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি ভারতের কাছে এ মুহূর্তে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, দুই দেশই একে অপরের মনোভাব ও চাহিদা ভালোভাবে জানতে-বুঝতে চায়। উভয় দেশের রাজনৈতিক নেতারা জানেন, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে প্রতিবন্ধকতা থাকবে। প্রতিবন্ধকতা তৈরি হওয়াটা সমস্যা নয়, কিন্তু সমাধানের জন্য মনোবৃত্তি না থাকাটা অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং।
আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে হলে রাজনৈতিক বোঝাপড়া অত্যন্ত জরুরি। সুসম্পর্ক ও সহযোগিতার ভিত্তিতেই উভয় দেশ এগিয়ে যেতে পারে। এই সম্পর্কের বিকাশ দর-কষাকষির ভিত্তিতেই হতে হবে। তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা পাওয়া বাংলাদেশের জনগণের আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত একটি অধিকার। এর সঙ্গে দেশের লাখ লাখ মানুষের স্বার্থ জড়িত। আছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রশ্নে ভারতের ইতিবাচক ভূমিকা পালন, আসাম রাজ্যে জাতীয় নাগরিকপঞ্জিতে (এনআরসি) বাদ পড়া ৪০ লাখ নাগরিক নিয়ে বাংলাদেশকে প্রভাবিত না করার প্রশ্ন। আমাদের নেতারা জাতীয় স্বার্থ বিবেচনা করে ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে এগিয়ে নেবেন—দেশবাসী এটাই প্রত্যাশা করে।
বাংলাদেশ ও ভারত ভ্রাতৃপ্রতিম প্রতিবেশী দেশ, কিন্তু দুই দেশের সম্পর্ক সমতার ভিত্তিতে স্থাপিত হয়নি। বস্তুত এই দুই দেশের আয়তন ও প্রভাবের মধ্যে ফারাক এত বিপুল যে চট করেই অর্থপূর্ণ সমতা আশা করা কঠিন। দুই রাষ্ট্রই পারস্পরিক স্বার্থের সর্বোচ্চ উপযোগ গ্রহণের নীতিতে চালিত হয়। এতে করে ছোট দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে সব সময় বঞ্চনার পাত্রটিকেই বহন করতে হয়। তবে যুদ্ধ করে, বয়কট করে এ সমস্যার কোনো সমাধানে উপনীত হওয়া যাবে না। সমস্যার সমাধানে লাগসই কূটনৈতিক ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে ভারত আমাদের সবচেয়ে বৃহৎ প্রতিবেশী, বাণিজ্য থেকে জাতীয় নিরাপত্তা, নদীর পানি থেকে পেঁয়াজ, অনেক ব্যাপারেই এ দেশটির ওপর আমাদের নির্ভরশীল থাকতে হয়। ফলে সমতার সম্পর্ক নিয়ে যত কথাই বলি না কেন, ভারতের ইতিবাচক মনোভাবের ওপর আমাদের অনেকটাই নির্ভরশীল হতে হয়।
আর বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কটা আপাত ‘মধুর’ হলেও ভেতরে-ভেতরে অনেকটাই অবিশ্বাসের। দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাস্তবতাকে কখনোই বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। যেকোনো সম্পর্ক তৈরি হয় শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, সহমর্মিতা ও সহযোগিতার ওপর। কেউ কারও স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে অন্যকে সাহায্য করবে না। কিন্তু নিজের স্বার্থের জন্য অন্যকে পথেও বসাবে না। কিছু ছাড় দেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। কিছু পেতে হলে কিছু দিতেও হবে। এখানে ভারতের নেতৃত্ব চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ভারতের দায় অনেক বেশি। সবার আগে তাদের ‘বড় ভাই’সুলভ মনোভাব ত্যাগ করতে হবে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশকেও ধারাবাহিক দক্ষ ও সৃজনশীল কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রাখতে হবে।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট