আমরা যারা একটু বয়স্ক তারা স্মৃতিচারণা করতে গেলে কী বলি? বলি, আগে সবকিছু কতই না চমৎকার ছিল! যদি বলি, চমৎকার না কচু ছিল, অনেকেই খেপে যাবে আমার ওপর। খেপে যাওয়ারই কথা, হুট করে যা খুশি তা-ই বললে তো এমনটিই হবে।
আমি নিজে এখন একালে বসবাস করি। তবু সেকালের অনেক কিছু সম্পর্কে জ্ঞান রয়েছে। যেমন একবার একজন প্রতিবেশী মারা গেলেন। বাড়িতে কান্নার রোল উঠে গেল। সেকালে দেখেছি বেশ দলবদ্ধভাবে কথার ছলে বা গানের সুরে রীতিমতো কান্না হতো। তো বাড়ির বড় মেয়ে দিব্যি কান্নার সুরে বলছেন, ‘আমার বাবা জীবনে সন্দেশ, রসগোল্লা, দই এসব কিছুই খেতেন না।’ মেয়েটির এক আত্মীয় বেশ কৌতূহল এবং আগ্রহের সঙ্গে জানতে চাইলেন, ‘ও মণি তোমার বাবা সন্দেশ, রসগোল্লা, দই এসব খেতেন না কেন?’
মেয়েটি তৎক্ষণাৎ পাল্টা জবাবে বললেন, ‘পেতেন না, তাই খেতেন না।’ আমরা যারা সেকালের লোক, আমাদের যেসব সীমাবদ্ধতা ছিল, একালে সেটা নেই। যার ফলে আমাদের স্মৃতিচারণায় আমরা বেশ হৃদয়, মন, প্রাণ দিয়ে এমনভাবে কথা বলি তাতে মনে হয় সেকালই উত্তম ছিল। যেমন ধরুন, সিনেমা আসার আগে কী ছিল? যাত্রাগান, যাত্রা নাটক, তারপর বায়োস্কোপ; মস্ত বড় একজন একটি কাঠের বাক্স নিয়ে ফেরিওয়ালার বেশে গ্রামে গ্রামে কাবুলিওয়ালার মতো ঘুরতেন আর হাঁকতেন, ‘এই বায়োস্কোপ দেখবেন বায়স্কোপ?’ আমরা তখন এসব মজার সঙ্গে দেখেছি। তারপর যাত্রাগান বা যাত্রা নাটক, সেটা তো বিশাল ঘটনা। রাতের ঘুম হারাম করে নবাব সিরাজউদ্দৌলা নাটক, সঙ্গে একঝাঁক ডানাকাটা পরী না দেখলেই নয়।
তারপর রেডিও এল। আমার বাবার ছোট ভাই তখন এলাকায় প্রথম বিএসসি পাস করেছেন বিজ্ঞান বিভাগ থেকে। লেখাপড়া শেষ হতেই তিনি বিয়ে করেন। বিয়েতে তাঁকে একটি রেডিও উপহার দেওয়া হয় শ্বশুরবাড়ি থেকে। আশপাশের লোকে বাড়ি ভরে গেল এ খবরে। বউ দেখা পড়ে থাক, রেড়িও দেখতে হবে আগে—এমনই কৌতূহল সবার মাঝে!
আমি নিজেই প্রথম টেলিভিশন দেখার সুযোগ পেলাম হঠাৎ খুব ছোটবেলায়, যখন গ্রাম থেকে প্রথম শহরে আসি। টেলিভিশন দেখার আগে ভালো বিনোদন দেখেছি বলে মনে পড়েনি তখন। এভাবে ধারাবাহিকভাবে যদি স্মৃতিচারণা করতে থাকি, দেখা যাবে সেকালের সঙ্গে একালের যাত্রা ক্রমান্বয়ে প্রসারিত হয়ে চলেছে।
সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে প্রযুক্তির উন্নতি এবং মাত্রা বেড়ে চলেছে। আমাদের সামনে সব সময় নতুনত্বের ঢেউ এসে নতুন কিছু উপহার দিয়ে চলেছে। ফলে সেকালের মতো অত সময় নিয়ে কোনো কিছু দেখা বা মনোযোগ দেওয়ার সময় এবং সুযোগ হচ্ছে না। আরেকটু পরিষ্কার করে বললে এমন হবে, আমরা আসলে স্লোমোশন থেকে দিনে দিনে ফাস্টমোশনের দিকে চলছি। ফলে আমাদের উপলব্ধির ধরন পাল্টে গেছে। এ কারণেই আমরা যারা সেকালের, আমাদের কাছে মনে হয় অতীত কী মধুময় ছিল।
আজ যদি পৃথিবীর সেই আদি মানুষটি, আদম বেঁচে থাকতেন! তিনি হয়তো বলতেন, ‘কী সুন্দরই না ছিল সেকাল, শুধু আমি আর হাওয়া, যা কিছু করার করেছি, যা কিছু দেখার দেখেছি, যা কিছু খাবার খেয়েছি…’ বলতে বলতে শেষে বলতেন, ‘কেন যে হাওয়া বিবি গন্ধমটা খেতে গেল!’
যা হোক, একালও একদিন শেষ হয়ে পরকাল হয়ে যাবে। আমরা থাকব না, থাকবে শুধু নতুন প্রজন্ম। তারাও তাদের কালে সেকালের স্মৃতিচারণা করবে। জীবন চলতে থাকবে সেকাল, একাল আর পরকালের মধ্য দিয়ে। এদিকে আমার মন একদিন সুরকার শেখর সেনের সুরে অনুরাধা পাডোওয়ালের মতো গাইতে শুরু করবে—আমার সাধ না মিটিল আশা না পুরিল, সকলি ফুরায়ে যায় মা…।
লেখক: সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন