হোম > ছাপা সংস্করণ

নদী খুন হলে মানুষেরও সর্বনাশ

আনু মুহাম্মদ

নদীর পানি প্রবাহের ওপরই বাংলাদেশের জন্ম। নদী বিপন্ন হলে তাই বাংলাদেশের অস্তিত্বও বিপন্ন হয়। নদী হারানোর সর্বনাশ এক-দুই বছরে, এক-দুই দশকে বোঝা যায় না। কয়েক দশকে বাংলাদেশে জিডিপি যে বহুগুণ বেড়েছে তার হিসাব আমাদের কাছে আছে, কিন্তু একই সময়ে বাংলাদেশের প্রাণ এই নদীমালার কতটা জীবনহানি ও জীবনক্ষয় হয়েছে, তার কোনো পরিসংখ্যানগত হিসাব আমাদের কাছে নেই। কংক্রিটকেন্দ্রিক তথাকথিত ‘উন্নয়নের’ বড় শিকার দুই দেশেরই নদীমালা। বাংলাদেশ অংশে নদীর বিপন্নতা ঘটেছে তুলনায় অনেক বেশি। একতরফা আক্রমণে বাংলাদেশের অসংখ্য ছোট নদী এখন একেকটি মৃতদেহ। আর বৃহৎ চার নদী—পদ্মা, মেঘনা, যমুনা ও তিস্তা এখন বিপর্যস্ত এবং আরও আক্রমণের মুখে।

বাংলাদেশের নদীগুলো যেভাবে খুন
হচ্ছে, সেগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়: ১. ভারতের অন্যায় একতরফা আগ্রাসী তৎপরতা, ২. বাংলাদেশের নদীবিদ্বেষী উন্নয়ন-কৌশল এবং ৩. রাজনৈতিক ক্ষমতায় নদী দখলদারদের আধিপত্য।

প্রথমত, ভারত ও বাংলাদেশের অভিন্ন ৫৪টি নদী। এগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত ছোট নদী,  শাখা নদীর সংখ্যা বাংলাদেশে আগে ছিল সহস্রাধিক। এখনো দুই শতাধিক নদী কোনোভাবে বেঁচে আছে। ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে ভারতের যে যাত্রা শুরু, তা গত ৪০ বছরে এমন স্থানে পৌঁছেছে যে বৃহৎ নদী পদ্মা ও সম্পর্কিত অসংখ্য ছোট নদী খাল-বিল বিপর্যস্ত। ফারাক্কা বাঁধের কারণে পদ্মা নদীর বড় অংশ এখন শুকিয়ে গেছে। ভারসাম্যহীন পানি প্রবাহে ক্ষতিগ্রস্ত উত্তরবঙ্গের বিশাল অঞ্চলের কৃষি। সেচের জন্য চাপ বাড়ছে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর, যা দীর্ঘ মেয়াদে আরও জটিল পরিস্থিতি তৈরি করছে।

শুধু তা-ই নয়, পদ্মা নদীর এই ক্ষয় তার সঙ্গে সংযুক্ত নদীগুলোকেও দুর্বল করেছে। এই প্রভাব গিয়ে পড়েছে সুন্দরবন পর্যন্ত। সুন্দরবনের কাছে নদীর প্রবাহ দুর্বল হয়ে যাওয়ায় লবণাক্ততা বেড়েছে, তাতে ক্রমাগত ক্ষয়ের শিকার হচ্ছে বনের জীবন। অন্যদিকে ফারাক্কার বিষক্রিয়া পশ্চিমবঙ্গ ও এর আশপাশেও পড়ছে। একদিকে পানিশূন্যতা, অন্যদিকে অসময়ের বন্যা এবং অতিরিক্ত পলি।  বিহারের মানুষ শাবল নিয়ে মিছিল করেছেন ফারাক্কা বাঁধ ভেঙে দেওয়ার দাবিতে।

কিন্তু এসব অভিজ্ঞতা বাঁধকেন্দ্রিক উন্নয়ন চিন্তাও বাঁধ-ব্যবসায়ীদের থামাতে পারেনি। উপরন্তু ভারতের শাসকদের চিন্তাপদ্ধতিতে ভাটির দেশ বাংলাদেশের স্বার্থ ও অধিকার বিষয় একেবারেই অনুপস্থিত। মণিপুরে টিপাইমুখ বাঁধের প্রস্তুতি পুরোটাই চলেছে একতরফাভাবে। এই বাঁধ হলে তা বাংলাদেশের আরেক বৃহৎ নদী মেঘনার জন্য যে বড় হুমকি হবে বাংলাদেশ ও ভারতের স্বাধীন বিশেষজ্ঞরা অনেক আগে থেকেই এটি বলে আসছেন। ম্যাপ দেখলে দেখা যায়, ভারত থেকে বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত নদীগুলোর ওপর বিভিন্ন স্থানে কাঁটার মতো সব বাঁধ। তিস্তা নদীর ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটেছে। ভাটির দেশকে না জানিয়ে গজলডোবাসহ বিভিন্ন বাঁধ দিয়ে যেভাবে একতরফা পানি প্রত্যাহার করা হচ্ছে, তা স্পষ্টতই আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। গ্রীষ্মে তাই বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের বিশাল অঞ্চল পানির অভাবে খাঁ খাঁ করে। তিস্তার পানিপ্রবাহ এখন শতকরা ১০ ভাগে নেমে এসেছে। ফারাক্কা ও গজলডোবা ছাড়াও মনু নদীতে নলকাথা বাঁধ, যশোরে কোদলা নদীর ওপর বাঁধ, খোয়াই নদীর ওপর চাকমা ঘাট বাঁধ, বাংলাবান্ধার মহানন্দা নদীর ওপর বাঁধ, গোমতি নদীর ওপর মহারানী বাঁধ এবং মুহুরী নদীর ওপর কলসি বাঁধসহ আরও ১৫-২০টি অস্থায়ী কাঁচা বাঁধ কার্যকর রয়েছে।

এখানেই শেষ নয়, ভারত পৃথিবীর বৃহত্তম নদী সংযোগ প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এই প্রকল্প অনুযায়ী ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গার পানি ১৪টি নতুন খননকৃত খালের মাধ্যমে পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতের দিকে প্রবাহিত করা হবে। এটি কার্যকর হলে অন্যান্য নদীর সঙ্গে বাংলাদেশের আরেকটি বৃহৎ নদী যমুনা আক্রান্ত হবে। শুকিয়ে যাবে অধিকাংশ নদী-উপনদী।

দ্বিতীয়ত, এর সঙ্গে যোগ হয়েছে দেশের ভেতরের অপতৎপরতা। বাংলাদেশের নদ-নদী, খাল, অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে পানিপ্রবাহের ওপর পঞ্চাশের দশক থেকে ধারাবাহিক আক্রমণ এসেছে ‘উন্নয়ন’ নামের বিভিন্ন প্রকল্পের সুবাদে। এ প্রকল্পগুলো করা হয়েছে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সেচসুবিধা সম্প্রসারণে বাঁধসহ নির্মাণমুখী কর্মসূচি হিসেবে। দেখা গেছে, এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্য হিসেবে ঘোষণা করা হলেও একপর্যায়ে গিয়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ হয়নি, সেচসুবিধা কাজ করেনি এবং সর্বোপরি মূল লক্ষ্য খাদ্য উৎপাদনেও ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়েছে। এর অনেক দৃষ্টান্ত আছে। এখানে শুধু একটি দৃষ্টান্ত দিই, যার ফলে বড়াল নামে একটি নদ এখন মৃতপ্রায়।

বড়াল নদ বাংলাদেশের দুই প্রধান নদী পদ্মা এবং যমুনার সংযোগ নদী। দৈর্ঘ্যে প্রায় ২০৪ কিলোমিটার, ১২০ মিটার প্রস্থ, এর অববাহিকা ৭৭২ বর্গকিলোমিটার। এর সঙ্গেই চলনবিল। ১৯৮৫ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত এই নদের মুখে স্লুইসগেট, ক্রসড্যাম, বক্স কালভার্ট নির্মাণ করা হয়। অন্য প্রকল্পগুলোর মতো এটিও সেচব্যবস্থার মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, পানির প্রবাহ বৃদ্ধি, নৌপথ সম্প্রসারণের লক্ষ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। প্রথম তিন বছর উৎপাদন ভালোই দেখা যায়। এরপর শুরু হয় বিপর্যয়। ফারাক্কার কারণে এমনিতেই পদ্মা নদীর প্রবাহ কম ছিল, উপরন্তু বড়াল নদের মুখে স্লুইসগেট বসানোতে পদ্মা থেকে আসা পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। স্রোত কমে যায়, বহু জায়গায় জলাবদ্ধতা দেখা যায়। যমুনায় যেখানে বড়াল গিয়ে মেশে, সেখানে পানিপ্রবাহ খুবই নিম্নস্তরে নেমে যাওয়ায় যমুনা নদীও ক্ষতিগ্রস্ত হয়,  ভাঙন বিস্তৃত হয়। অববাহিকার প্রায় ১ কোটি লোকের জীবন ও জীবিকা এখন হুমকির মুখে। বড়াল শুকিয়ে যে জমি উঠেছে, তা এখন নানাজনের দখলে।

তাই নদীর এই পরিস্থিতি সৃষ্টির সুবিধাভোগীও আছে। তাদের প্রধান অংশ সম্পদ ও ক্ষমতায় শক্তিশালী। নদী দুর্বল হয়ে গেলে নদী ক্রমাগত জমিতে রূপান্তরিত হয়। তখন তা দখল করা অনেক লাভজনক। নদী বাঁচলে তার মূল্য টাকার অঙ্কে পরিমাপ করা যায় না, কিন্তু মরলে তার দাম শত বা হাজার কোটি টাকা হয়ে যায়। সে জন্যই যারা এর ভাগীদার, তারা নদীবিধ্বংসী উন্নয়ন ধারা বহাল রাখতে আগ্রহী। তা ছাড়া, এসব বাঁধ বা নির্মাণকাজ প্রধানত বিদেশি ঋণের টাকায় হয়। ফলাফল যা-ই হোক, ঋণদাতা, কনসালট্যান্ট, ঠিকাদার, আমলা এবং ভূমিদস্যুদের লাভ অনেক।

তৃতীয়ত, এই দখলদারদের জমির ক্ষুধা বাড়ছেই। বাংলাদেশের সীমিত জমি তাদের ক্ষুধা পূরণে সক্ষম নয়। সে জন্য তাদের দখলের আওতায় ক্রমে ক্রমে যাচ্ছে বন, জঙ্গল, পাহাড়, জলাভূমি, উন্মুক্ত স্থান, খেলার মাঠ, বিল-খাল, এমনকি নদী। সারা দেশেই এ ঘটনা ঘটছে। খোদ রাজধানীতে বুড়িগঙ্গা, পাশে তুরাগ, বালু নদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এ দৃশ্য আমাদের সবাইকে জানিয়ে দেয় যে এ দেশে হয় সরকার নেই, থাকলে তার কাজ দখলদারদের সমর্থন দেওয়া, জনপ্রতিরোধের মুখে তাকে রক্ষা করা। এ ছাড়া নদীদূষণের মাধ্যমে তাকে মেরে ফেলার হাজার আয়োজন চলছে সরকারি বা ব্যক্তিগোষ্ঠীর মাধ্যমে।
ভারত যেভাবে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ নদীগুলোর জীবন সংশয় ঘটাচ্ছে, তা শুধু বাংলাদেশের নয়, সে দেশের জনগণের এবং সর্বোপরি সমগ্র মানবসমাজের জন্যও বড় ক্ষতি। বাংলাদেশ যাঁরা চালান, তাঁরা জনগণের স্বার্থ কেন্দ্রে রেখে উন্নয়ননীতি সাজালে এই নদী ও খাল-বিলগুলোর জীবনও সচল করতেন এবং ভারতের এসব আগ্রাসী তৎপরতার বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভূমিকা নিতেন। সেসব ভূমিকা নেই। উল্টো তাঁরা নদ-নদী, সুন্দরবন সবই ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। ভারতের পণ্য-যন্ত্রপাতি সরবরাহের জন্য তিতাস নদের ওপর আড়াআড়ি বাঁধ দেওয়ার মতো অবিশ্বাস্য ঘটনাও ঘটেছে।

১৯৯১ থেকে বাংলাদেশ সংসদীয় পদ্ধতির সরকার দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। নির্বাচন করে না-করে সংসদ গঠিত হচ্ছে। সংবিধান অনুযায়ী এখানেই বাংলাদেশের নীতিগত সব বিষয় আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হওয়ার কথা। কিন্তু খুব সহজ হিসাব যদি বের করা যায়, কত ঘণ্টা এই সংসদে নেতা-নেত্রী প্রশস্তি, অন্যদের কুৎসা ও গালিগালাজ হয়েছে আর কত ঘণ্টা বাংলাদেশের নদী নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এই কয়েক দশকে কয় ঘণ্টাও পাওয়া যাবে না। বিভিন্ন নদীর আজকের এই হালে যারা সুবিধাভোগী দখলদার, তাদের মধ্যে বিভিন্ন আমলের সংসদ সদস্য এবং সহযোগী আমলা, ব্যবসায়ী অনেককে পাওয়া যাবে।সে জন্য দেশি দখলদারদের পৃষ্ঠপোষকতাদান যেমন একদিকে সরকারের ভূমিকা, অন্যদিকে নিজের অবস্থান পরিষ্কার না করে, প্রস্তুতি না নিয়ে, বিশেষজ্ঞ মতামত তোয়াক্কা না করে ‘ভারত কোনো ক্ষতি করবে না’—সেটাই বারবার মুখস্থ বলে যাওয়া সরকারের একমাত্র কাজ মনে হচ্ছে। ‘কোনো ক্ষতি হবে না’ এটা যদি বাংলাদেশ সরকারই আগে থেকেই বলতে থাকে, তাহলে দর-কষাকষি, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, জনগণের উদ্বেগ বিবেচনার আর জায়গা থাকে কোথায়? শুধু তিস্তা চুক্তির বিষয় নয়, সামগ্রিকভাবে অভিন্ন নদী নিয়ে, বিদ্যুৎ করিডর নিয়ে, ট্রানজিটসহ সব বিষয়েই বাংলাদেশের অধিকার নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় কূটনৈতিক আইনগত অবস্থান দরকার, এর জন্য বাংলাদেশের প্রস্তুতি দরকার। বাংলাদেশের যা চাওয়া উচিত তা পরিষ্কার করে কোনো অবস্থাপত্র আছে? নেই। বিশেষজ্ঞদের নিয়ে সরকারের কোনো প্রস্তুতি আছে? নেই। মন্ত্রণালয়ে কিছু খুঁজে পাওয়া যাবে? না। দেশি-বিদেশি দখলদারদের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার ফলেই এই অক্ষমতা, এই অপ্রস্তুতি, এই মুখস্থ অর্বাচীন কথা।

নদী বিপন্ন হলে মানুষের জীবন কী করে স্বচ্ছন্দ হয়? হয় না বলেই কোটি মানুষ দিশেহারা। ভবিষ্যৎ ভয়াবহ আশঙ্কায় ঘেরা। যারা নদীর লাশ খেয়ে ফুলেফেঁপে ওঠে, তাদের ওপর ভরসা করার উপায় নেই। অথচ এই নদী বাংলাদেশের মানুষের বর্তমান ও ভবিষ্যতের অস্তিত্বের অবলম্বন। চোখের সামনে খুন হচ্ছে নদী। চোখ বন্ধ করে থাকলেই জীবন বাঁচবে না। এটা কেবল নদী নয়, আমাদের সবার, দেশ ও মানুষের প্রাণ। আমাদের ভূমিকাই আমাদের জীবন বা মরণ নির্ধারণ করবে।

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ