হোম > ছাপা সংস্করণ

সহমতের কালে সাংবাদিকতা কেমন চলে?

অর্ণব সান্যাল

সাংবাদিকতার কাজ হচ্ছে নির্মোহ ভঙ্গিতে নির্মম সত্যকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া। অথচ এ দেশে সেই নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি মোহাবিষ্ট হয়ে পড়ছে দিনকে দিন। নির্মম সত্যও কি আর সংবাদমাধ্যমগুলো পরিবেশন করতে পারছে? যদি পারতই, তবে কি আর হাত-পা বেঁধে কুমিরপুষ্ট প্রমত্তা নদীতে সাঁতার কাটার মতো অবস্থা সৃষ্টি হতো নাকি! 
হাত-পা বেঁধে কুমিরের সহযাত্রী হয়ে নদীতে সাঁতার কাটার প্রধানতম বৈশিষ্ট্য হলো–কুমিরের উদরপূর্তির উপলক্ষ হতে না চাইলে কুমিরের কথায় সহমত প্রকাশ করতে হয়। আমাদের দেশে বর্তমানে সর্বক্ষেত্রে সেই সহমতের সংস্কৃতি প্রবলভাবেই আছে, আছে সাংবাদিকতাতেও। ফলে নির্মোহভাবে সমালোচনা করাকেও এখন আনুষ্ঠানিকভাবে বিরোধিতার কাতারে ফেলে দেওয়া হয় নির্দ্বিধায়। আর এর পরই কুমির আসে কামড়াতে!  

অথচ যেকোনো বড় বড় সেমিনারে বা আলাপ-আলোচনায় আমরা নির্দ্বিধায় উন্নত বিশ্বের প্রসঙ্গ তুলে আনি। সেই মাপে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় কণ্ঠে তুলি। কিন্তু আদৌ কি তেমন পরিবেশ এখানে আছে? ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অনেক দিন ধরেই সাংবাদিকদের গলায় পা দিয়ে রেখেছে। মন্ত্রীরা যতই বলুন, ‘আইসিটি অ্যাক্টে মামলা হলেই সাংবাদিক গ্রেপ্তার নয়’ বা কোনো সাংবাদিক যেন এ আইনের অপব্যবহারের শিকার না হন, তা দেখা হচ্ছে—আদতে কি কিছু হয়?

সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) কিছুদিন আগে এক ওয়েবিনারে উত্থাপিত মূল প্রবন্ধে জানিয়েছে, গত দুই বছরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ১০৮টি মামলায় ২০৮ জন সাংবাদিককে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এই ১০৮টি মামলা করেছেন ৯৬ জন, অর্থাৎ একই ব্যক্তি একাধিক মামলা করেছেন। ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সব মিলিয়ে ৮৯০টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ২ হাজার ২৪৪ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ৮৪২ জনকে আটক করা হয়। আর এই আইনে রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিকেরা সবচেয়ে বেশি অভিযুক্ত হচ্ছেন বলে ওয়েবিনারে জানানো হয়। অভিযুক্ত এবং আটক ব্যক্তিদের মধ্যে স্থানীয় সাংবাদিকদের সংখ্যা বেশি।

অর্থাৎ, সাংবাদিকতার একেবারে তৃণমূলে আঘাত করছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। একটি বটবৃক্ষের গোড়ায় যদি কেউ লাগাতার কুঠার চালাতে থাকে, তবে একদিন না একদিন পুরো গাছই মাটিতে শুয়ে পড়তে বাধ্য। আর সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে সেটিই হচ্ছে। তার ওপর আছে নানা ধরনের জেল-জরিমানাভিত্তিক আইন বা নীতি প্রণয়নের নিত্যকার আলোচনা। তো, এত আইনি ভীতির মধ্য থেকে অনিয়মের বিরুদ্ধে সাংবাদিকেরা বলবেনটা কী আর লিখবেনইবা কী!

মজার বিষয় হলো, ‘নির্দেশক্রমে অনুরোধ’ এখন কর্তৃপক্ষের ‘অফিশিয়াল’ দৃষ্টিভঙ্গি। সরকারি দপ্তর থেকে জারি করা বিভিন্ন চিঠিতে এমন ভাষার ব্যবহার করা হয়ে থাকে। আগে তা কেবল হয়তো অভ্যন্তরীণ কাজ সমাধাতেই ব্যবহৃত হতো। তবে ধীরে ধীরে সেই ভাষার তির সংবাদমাধ্যমের দিকেও ছোড়া হচ্ছে। যে কেউ প্রতিবাদ করে বলতেই পারেন, ‘এগুলো দাপ্তরিক ভাষা’। তবে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশ ও অর্থনীতির নিয়ত এগিয়ে যাওয়ার মন্ত্র শুনতে শুনতে অভ্যস্ত এ মন অনুযোগ করতে পারে, ‘পরিবর্তন কি তবে শুধু মাথাপিছু আয় আর প্রবৃদ্ধিতেই হবে? আচরণে নয়?’

নির্দেশক্রমে অনুরোধ—এই দুটি শব্দ যখন আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যবহার করা হয়, তখন সাংবাদিকতা ধন্দে পড়তে বাধ্য যে নির্দেশ পালন করবে নাকি অনুরোধ! নির্দেশ অবশ্যপালনীয়, তাতে যে হুকুম থাকে। ওদিকে অনুরোধ আপনি পালন করতেও পারেন, না-ও পারেন। তবে এ দেশে সাংবাদিকতা দীর্ঘদিন ধরেই এই নির্দেশ আর অনুরোধের ঢেঁকি গিলে আসছে। কখনো কর্তৃপক্ষের নির্দেশ মানে, আবার কখনো পেশার কারণে ঘনিষ্ঠজনদের অনুরোধ। ফলে দিন শেষে এ দেশে সাংবাদিকতা যে তিমিরে, সেই তিমিরেই থেকে যায়।

যদিও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বাংলাদেশের সংবিধানে নিশ্চিত করা হয়েছে। আছে বাক্‌স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রচর্চার নিশ্চয়তাও। সাংবিধানিকভাবে নিশ্চয়তা থাকার পরও বৈশ্বিক গণমাধ্যম স্বাধীনতা র‍্যাঙ্কিংয়ে আমাদের দেশ পেছাচ্ছে। সাংবাদিকদের প্যারিসভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের (আরএসএফ) ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তালিকা অনুযায়ী, ২০২১ সালে এই র‍্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৫২তম। আর ২০২২-এ ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬২তম। গত বছরের তুলনায় পয়েন্ট কমেছে ১৪। আরএসএফের দেওয়া তথ্য অনুসারে, গণমাধ্যমের ওপর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪০তম, অর্থনৈতিক সুরক্ষা সূচকে অবস্থান ১৩৮তম। আইনগত নিয়ন্ত্রণ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৮তম এবং সামাজিক সুরক্ষা সূচকে অবস্থান ১৪৯তম। আর সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের নিরাপত্তা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান একেবারেই তলানির দিকে, ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭২তম।

সুতরাং এ দেশের সাংবাদিকতায় ‘নির্দেশক্রমে অনুরোধের’ মতো পরিস্থিতি যে প্রতিষ্ঠিত আছে, তা র‍্যাঙ্কিং অনুযায়ী স্পষ্ট। এই র‍্যাঙ্কিং কর্তাব্যক্তিরা অস্বীকার করতেই পারেন। হয়তো নেতিবাচক বলেই। মানুষ হিসেবে আমরা খুব স্বাভাবিকভাবেই নেতিবাচকতা এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি। এই একই র‍্যাঙ্কিংয়ে যদি ব্যাপক উন্নতি আসে, তবে সেটিই হয়ে যেতে পারে উন্নয়নের মাপকাঠি। এ বঙ্গের ঐতিহ্য তেমনই।

এমন পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে কি শুধুই ক্ষমতা দায়ী? নাহ্, সাংবাদিকেরা এমন অবস্থার জন্য নিজেদেরও কাঠগড়ায় তুলতে পারেন চাইলে। বাধা এলে, তা ডিঙিয়ে যাওয়াই সাংবাদিকতার বৈশিষ্ট্য। কিন্তু দিনকে দিন আমরাও অনেকাংশে সেই লড়াই থেকে পিছিয়ে এসেছি। আমাদের মধ্যে পক্ষপাতিত্ব ঢুকেছে প্রবলভাবে, দুর্নীতিও আছে ঢের। এই দুর্নীতি গড়ে ওঠার পেছনে আবার সংবাদমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোর অনিয়ম এবং সুযোগ-সুবিধা না দিয়ে ফাউ খাটিয়ে নেওয়ার অপেশাদারি মনোভাবের ভূমিকা আছে। এ দেশে পেশাদারি মনোভাব নিয়ে আসলে কয়টি সংবাদমাধ্যম চলে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে তালিকা করতে বসলে, সেটি দীর্ঘ হবে না নিশ্চিত। ফলে সাংবাদিকতার কোড অব কনডাক্ট নিয়ত ধূলিসাৎ হচ্ছে। ভালো-খারাপ সব পেশায় আছে, তবে কোনো পেশাতেই ভালো-খারাপের ভারসাম্য আনার জন্য বিশেষ আইন করা হয় না। আর এখানেই এ দেশের সাংবাদিকতার প্রতিবন্ধকতা ও ফাঁদ। সেই ভয়ের ফাঁদ পাতায় যেমন আমাদের ভূমিকা আছে, তেমনি আমাদের ওই খামতিকে কাজে লাগিয়েই ক্ষমতাযন্ত্র সাংবাদিকতাকে নিয়ত প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি করে। আর এভাবেই এ দেশে সাংবাদিকতা একটি দুষ্টচক্রের মধ্যে আবর্তিত হচ্ছে তো হচ্ছেই।

আর নিজেদের পিছিয়ে যাওয়ার এমন একটা সময়েই বৈশ্বিকভাবে সাংবাদিকতার ওপর আস্থা হারাচ্ছে মানুষ। রয়টার্স ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব জার্নালিজমের ২০২২ সালের ‘ডিজিটাল নিউজ রিপোর্ট’-এ আমরা দেখতে পাচ্ছি, করোনাকালে সংবাদমাধ্যমের ওপর মানুষের আস্থা বেড়ে যাওয়ার ট্রেন্ড এখন নিম্নমুখী। ছয় মহাদেশ আর ৪৬টি বাজারে একই অবস্থা। সংবাদের প্রতি মানুষের আগ্রহ ২০১৭ সালের ৬৩ শতাংশ থেকে ২০২২ সালে ৫১ শতাংশে নেমে গেছে। অনেক ক্ষেত্রে পাঠক বা দর্শক সংবাদ থেকে একেবারেই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন; বিশেষ করে তরুণ সম্প্রদায়, যাঁদের বয়স ৩০ বছরের কম, তাঁদের কাছে পৌঁছাতে পারছে না সংবাদমাধ্যমগুলো। অনলাইনে সাবস্ক্রিপশনভিত্তিক আয় নামছে নিচের দিকে। কাগজের দামে উল্লম্ফনে বিপদে আছে প্রিন্ট মিডিয়াও। ফেসবুক-টিকটকের প্রবল উত্থানের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় তাল মেলাতে পারছে না সংবাদমাধ্যমের অনলাইন ভার্সন। আর সেই ফাঁকেই ডালপালা মেলছে ভুল তথ্য, ফেক নিউজ ও গুজব।

বৈশ্বিকভাবে সাংবাদিকতার এসব নতুন প্রতিবন্ধকতা নিয়ে সতর্ক হয়ে নিজেদের প্রস্তুত করা দূরের কথা, এ দেশে আমরা ব্যস্ত আছি নিজেদের লোটা-কম্বল বাঁচাতেই। দুর্নীতির খবর প্রকাশ করে বিশেষায়িত মামলায় হেনস্তা হওয়ার ভয়ে থাকতে হয় আমাদের। মাস শেষে বেতন-বোনাস ঠিকমতো পাওয়া হবে কি না, তা নিয়েও শঙ্কা থাকে প্রকট; অর্থাৎ এক শাঁখের করাতে এ বঙ্গে নিয়মিত ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে সাংবাদিকতা এবং তা প্রবলভাবেই। এমন প্রেক্ষাপটেই এতদঞ্চলের সাংবাদিকতায় সৃষ্টি হয় নির্দেশক্রমে অনুরোধের কাল। সেই কালে সাংবাদিকতা আহতের মতো খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলে। ক্ষত স্থানে বারবার খুঁচিয়ে সেটিকে একেবারে শুইয়ে ফেলা যায়, আবার ওষুধ লাগিয়ে সারিয়েও তোলা যায়। আমরা কোন পথে হাঁটব—তাতেই ভবিষ্যতে নির্দিষ্ট হবে এ দেশে সাংবাদিকতার অদৃষ্ট।

লেখক: সহকারী বার্তা সম্পাদক, আজকের পত্রিকা

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ