বিএনপি যদি বর্তমান সরকার কর্তৃক গৃহীত নির্বাচনসংক্রান্ত যেকোনো উদ্যোগের শুধু সমালোচনা না করে ত্রুটি-বিচ্যুতি ধরিয়ে দিয়ে করণীয় বিষয় সম্পর্কে তাদের দলীয় মতামত তুলে ধরত, তাহলে তাদের মনোভাব কতটা যুক্তিসংগত, বাস্তবসম্মত এবং রাজনৈতিকভাবে অর্জনযোগ্য, সেটি বোঝা যেত। কিন্তু বিএনপি যেহেতু সরকারের গৃহীত সব বিষয়ই প্রত্যাখ্যান করছে, নিজেরাও কোনোভাবে অংশ নিতে সম্মত নয়, তখন রাজনীতি বিশ্লেষকদেরও বুঝতে সমস্যা হচ্ছে যে বিএনপি শেষ পর্যন্ত এর মাধ্যমে কী অর্জন করতে চায়? বাস্তব পরিস্থিতি বিচার-বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় কৌশল বা লক্ষ্য নির্ধারণ করে এগিয়ে চলাই যেকোনো রাজনৈতিক দলের কাজ হওয়ার কথা। বিরোধী দলের জন্যও এটা প্রযোজ্য। তাদের কৌশলের মারপ্যাঁচ যেমন নিতে হয়, দিতেও হয়।
সরকারকে বাগে আনতে বিরোধী দলকে কৌশলে গ্রহণযোগ্য পথে সব সুযোগ নিতে হয়। সরকার যদি বিরোধী দলকে উপেক্ষা করে সবকিছু একতরফা করতে চায়, তাহলে জনগণ সরকারকেই দায়ী করবে। তাতে বিরোধী দলেরই লাভ, সরকারের ক্ষতি। বাস্তবতাকে ঢালাওভাবে উপেক্ষা করে নিজস্ব অবস্থান অভ্রান্ত মনে করে যদি সরলরেখার ওপর দিয়ে পার হওয়ার চেষ্টা করা হয়, তাহলে বিরোধী দলের পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে। তা ছাড়া, লড়াইটি যখন সরকারি দল ও প্রধান বিরোধী দলের মধ্যে সমানে সমানে হয়—তখন যুক্তি, বাস্তবতাবোধ, কৌশলের কিছু নিপুণ খেলা উভয় পক্ষেই থাকতে হয়। সেখানে যে পক্ষেরই ঘাটতি থাকবে তাদের জন্য বিপদ ছাড়া সুখকর কিছু না-ও হতে পারে।
রাজনীতির এই কৌশলের বিষয়টি উল্লেখ করেছি বিএনপির রাজনৈতিক কর্মসূচি, বক্তব্য, সিদ্ধান্ত এবং কার্যক্রম দেখে। মনে হচ্ছে, বিএনপি আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সরকারের গৃহীত সব উদ্যোগ একের পর এক যেভাবে প্রত্যাখ্যান করছে, তাতে দলটি সাধারণ মানুষের কাছে তাদের অবস্থান কতটা যৌক্তিকভাবে পরিষ্কার করতে পারছে, তা নিয়ে সচেতন মহলে সন্দেহ কমবেশি দানা বাঁধতে শুরু করেছে। বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।
আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপি দাবি করেছিল সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনী আইন প্রণয়ন করার। দাবিটি যৌক্তিক ছিল। সব রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজসহ বিদেশি সংস্থাগুলোও তা-ই চেয়েছিল। তবে বিএনপি দাবিটি রাষ্ট্রপতির কাছে উত্থাপনের সুযোগ গ্রহণ করেনি। বিএনপির যদি সে রকম হোমওয়ার্ক থাকত, তাহলে তেমন একটি আইনের রূপরেখা রাষ্ট্রপতির কাছে দিয়ে আসতে পারত। কিন্তু বিএনপি তার কোনোটিই করেনি। সম্ভবত বিএনপির ধারণা ছিল, সরকার সে রকম কোনো আইন এবার প্রণয়ন করবে না। আগের মতো সার্চ কমিটি গঠন করে বৈতরণি পার হওয়ার চেষ্টা করবে। তেমনটি ঘটলে সরকার পতনের আন্দোলনের পথে হাঁটার পরিকল্পনা ছিল বিএনপির। কিন্তু আওয়ামী লীগ সংবিধানের ১১৮(১) ধারায় আইনের বর্ণিত দুই স্তরবিশিষ্ট কাঠামোর খসড়া মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের মাধ্যমে সংসদে প্রেরণ করে। বিএনপি তাতে হকচকিত হয়ে যায়। এখানেই বিএনপি পিছিয়ে পড়ে, সরকারি দল এগিয়ে যায়। খসড়া আইনটি সংসদে আলোচনা এবং বিরোধী দলের বেশ কিছু প্রস্তাব গ্রহণের মাধ্যমে গৃহীত হয়। কিন্তু বিএনপি আইনের অনুসন্ধান কমিটির অংশটিকে যেভাবে আগের দুই মেয়াদের গঠিত কমিটির মতো একই রকম লক্ষ্য নিয়ে গঠিত হয়েছিল, তার সঙ্গে এক করে তুলে ধরার চেষ্টা করছে। অনুসন্ধান কমিটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বড় দায়িত্বপ্রাপ্ত বিষয়ে কার্য সম্পাদন করে অল্পসময়ের মধ্যে বিদায় নেওয়ার বিষয়। সেটি নিয়ে খুব বেশি হইচই করার অর্থ হয় না। যদি যোগ্য ব্যক্তিদের নামের তালিকা এই কমিটির কাছে দিয়ে ভালো একটি নির্বাচন কমিশন গঠনের ব্যবস্থা করা যায়, সেটি একধরনের বিষয় হতে পারে। কিন্তু যদি চাপ সৃষ্টির পরও কমিটি সিইসি ও ইসি গঠনে যোগ্য ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করতে ব্যর্থ হয়, তাহলেই কেবল কমিটির বিরুদ্ধে সমালোচনা জনগণের কাছে সমাদৃত হতে পারে। কিন্তু সার্চ কমিটিকেই নানাভাবে বিতর্কিত করা এবং নানা বিশেষণে বিভিন্ন সদস্যকে অভিযুক্ত করার কাজে বিএনপিকে বেশি মনোযোগী হতে দেখা গেছে। বিএনপি সাফ জানিয়ে দিয়েছে, তারা এই আইন মানে না। সার্চ কমিটিও তাদের বিবেচনায় সরকারের আজ্ঞাবাহী এবং তাদের প্রস্তাবিত সিইসি ও ইসিরা হবেন সরকারদলীয় আজ্ঞাবাহী ব্যক্তি। বাস্তবে সিইসি এবং ইসি গঠিত হওয়ার পরই কেবল বোঝা যাবে সার্চ কমিটি কতটা দক্ষতা কিংবা অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। যদি অদক্ষতার পরিচয় দেয় তাহলে তাদের ভাগ্যে সমালোচনা শুধু বিএনপির দিক থেকেই নয়, সবদিক থেকেই হবে, সেটি নিশ্চিত করে বলা যায়।
এমনও হতে পারে, সার্চ কমিটি একটি ভালো সিইসি ও ইসির নামের তালিকা রাষ্ট্রপতিকে দিতে পারে এবং তেমন একটি নির্বাচন কমিশন গঠিত হতে পারে। কিন্তু বিএনপি সেই কমিশনকে যদি প্রত্যাখ্যান করে তাহলে কি সবাই তা মেনে নেবে?
বিএনপি এখন যেভাবে বলছে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে দুই নির্বাচন কমিশনই সরকারের ইচ্ছায় সবকিছু করেছে। একটু স্মরণ করলে দেখা যাবে, কাজী রকিবউদ্দীন কমিশন ২০১৩ সাল পর্যন্ত নির্বাচন অনুষ্ঠানে যথেষ্ট কার্যকর ভূমিকা রেখেছিল। ২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত সবকটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীরাই জয়লাভ করেছিলেন, আরও অন্য বেশ কিছু নির্বাচনেরও অবস্থা প্রায় একই রকম ছিল। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ইস্যুতে সরকারকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করতে গিয়ে বিএনপি তালগোল পাকিয়ে ফেলে। জামায়াত-হেফাজতসহ নানা গোষ্ঠীকে নিয়ে বিএনপি রাজনীতিতে যে মেরুকরণটি ঘটাতে পেরেছিল, তা থেকে তাদের ধারণা হয়েছিল যে সরকারকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করাই তাদের পক্ষে সম্ভব। সে কারণেই নির্বাচন বর্জন এবং প্রতিহত করার পরিকল্পনা নিয়ে যেভাবে ২০১৩ সালের অক্টোবর, নভেম্বর, ডিসেম্বর দেশব্যাপী অগ্নিসংযোগ, থানা আক্রমণ, নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের ওপর হামলা, রাস্তাঘাট অবরোধ, মানুষ পুড়িয়ে হত্যা ইত্যাদি করেছিল। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ভন্ডুল করাই ছিল তাদের পরিকল্পনা। তাতে সফল হলে ৫ জানুয়ারির পর দেশে সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টির সুযোগ নিয়ে তৃতীয় কোনো শক্তি ক্ষমতা গ্রহণ করত কিংবা দেশে একটি নৈরাজ্য অবস্থা তৈরি হতো বলে জামায়াত-বিএনপির রাজনৈতিক হিসাব ছিল। তাহলে সরকার বৈধতার সংকট থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হতো। তাতে অন্তত শেখ হাসিনাকে একটা ‘উচিত শিক্ষা’ দেওয়া যেত!
অথচ নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনা বিএনপিকে ছাড় দিতে যথেষ্ট চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু জামায়াত-বিএনপি এককাট্টা ছিল নির্বাচন প্রতিহত করতে।
পরিস্থিতির কারণেই শেখ হাসিনা বাধ্য হয়েছিলেন যেনতেনভাবে নির্বাচনটি পার করতে। তাতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করার লক্ষ্যে সরকার উৎখাতের গোপন রাজনৈতিক কৌশলও ব্যর্থ হয়। নির্বাচন কমিশনের জন্য সে ক্ষেত্রে ছিল উভয়সংকট। বিরোধী দলের এক রকম কৌশল, সরকারের ভিন্ন রকম।
এখন বিএনপি যখন রকিবউদ্দীন এবং হুদা কমিশনকে সম্পূর্ণরূপে দায়ী করে তখন অনেক কিছুই তাতে স্বচ্ছতার প্রকাশ পায় না। কিন্তু ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে যদি বিরোধী দল অংশগ্রহণ করত, তাহলে রাজনীতির গতিপথ স্বাভাবিক পথেই হাঁটার সুযোগ পেত। এখন তো বিএনপি সেই সময়ের বাস্তবতাকেই অন্যভাবে ঘুরিয়ে দিচ্ছে, অনেকে তা গভীরভাবে তলিয়েও দেখছে না।
দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার বিরোধ, দ্বন্দ্ব ও সংঘাত কখন কোন লক্ষ্য-উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়, সেটি বিবেচনায় নেওয়ার বিষয়টি রাজনীতিসচেতন মহলের ভুলে গেলে চলবে না। ২০০৬ সালের বাস্তবতা যে সংকটের জন্ম দিয়েছিল, তা থেকে এক-এগারো সৃষ্টি হয়েছিল। বিএনপি-জামায়াত তখন কেমন নির্বাচন কমিশন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করেছিল, সেটি অবশ্যই ভুলে যাওয়ার বিষয় নয়। সুতরাং এখন বিএনপি নির্দলীয় সরকার ফিরিয়ে আনার যে দাবি করছে, সেটি কতটা বাস্তবসম্মত কিংবা আদায়যোগ্য, তা ভেবে দেখার বিষয়। আওয়ামী লীগ যেমন একটি বড় দল, একই সঙ্গে ২০০৯ সাল থেকে ক্ষমতায় থাকার কারণে আওয়ামী লীগের একটি সংহত অবস্থান যেমন তৈরি হয়েছে, তেমনি টানা ক্ষমতায় থাকায় কিছু নেতিবাচক প্রভাবও দল এবং সরকারের ওপর পড়েছে। অন্যদিকে বিএনপি বড় দল হওয়া সত্ত্বেও জামায়াত এবং সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর সমর্থন থাকার কারণে তাদের অবস্থানও সুবিধাজনক নেই। বিএনপি-জামায়তের পক্ষে ২০০৬ সালে মহাজোটের মতো কিছু গঠন করা সম্ভব কি না, তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। এই বাস্তবতায় বিএনপি আগের মতোই নির্বাচন বর্জন ও প্রতিহতের চিন্তা নিয়ে এগিয়ে গেলে কতটা সফল হবে, তা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়। সে ক্ষেত্রে বিএনপির ভবিষ্যৎ পরিণতি কী হতে পারে, তা-ও ভেবে দেখার বিষয়। কেননা, আগের আর বর্তমান বিএনপির নেতৃত্বও এক অবস্থানে নেই।
মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী: অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট