১৭ এপ্রিল ২০২২, বেলাশেষে।
এই দিবসটির রাষ্ট্রীয় পরিচিতি ‘মুজিবনগর দিবস’। এই দিনে স্বাধীন বাংলা প্রবাসী সরকার তখনকার বৈদ্যনাথতলায় শপথ গ্রহণ করে। চারজন জাতীয় নেতা ও একটি জাতীয় ঘৃণ্য কুলাঙ্গার শপথ গ্রহণ করেছিল। চার নেতাকে হত্যা করেছে সেন্ট্রাল জেলে যে চক্র, তার মূল হোতা হেনরি কিসিঞ্জার। ‘জীবিত’ এই হত্যাকারীকে আমরা এই পৃথিবীর ‘মানবিক সভ্যতা’ বিচার করতে পারিনি। পারব কি না জানি না। ‘জোর যার মুল্লুক তার’।
সেদিন বেলাশেষে আমাদের নবগঠিত সংঘবদ্ধতা আমরা একাত্তরের কয়েকজন ধানমন্ডির একটি রেস্তোঁরায় শেষ বিকেলে বসেছিলাম। আমরা মানবেতিহাসের অন্যতম বীভৎস হত্যাকাণ্ড ও জেনোসাইড—চুকনগরের ৫১ বছর উপলক্ষে কী কর্মসূচি কীভাবে নেওয়া যায়, সেটা নিয়ে প্রস্তুতি-পরামর্শ বৈঠক করছিলাম। রোজার দিনে এমন প্রতিকূল সময়েও আমাদের বৈঠক অভীষ্ট সাধনে ব্যর্থ হয়নি। কাল বিকেলের আবহাওয়ার উষ্ণতা এবং আর্দ্রতার ভেতরও বৈঠক শেষে বুকের ভেতর শীতল আনন্দের পরশ পেলাম।
আমাদের মনে অনেক কষ্ট, গভীর অপরাধবোধ। যখন নানাবিধ পুস্তক, গবেষণা ও তথ্য থেকে জানলাম, মানবেতিহাসে এত অল্প সময়ে এত বেশি মানুষ হত্যার কোনো নজির আজও মেলেনি, এর চেয়ে আকারে ছোট অনেক গণহত্যার বিরুদ্ধে আজও পৃথিবীর নানা স্থানে ঘৃণা ব্যক্ত হয় নানা আয়োজনে; অথচ একাত্তরের বাংলায় পৃথিবীর অন্যতম বিশালাকারের গণহত্যা তেমন করে দেশের বাইরে তো নয়ই, দেশের ভেতরেও আমরা জানি না। শুধু চুকনগর কেন, একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতের অন্ধকারে শুরু হওয়া হিংস্র গণহত্যাসহ বাংলাদেশে সে বছর যে ব্যাপক গণহত্যা হয়েছে, তা আজ পর্যন্ত লুকিয়ে রেখেছে ‘পাশ্চাত্য গণতন্ত্র ও বাক্স্বাধীনতার’ মহাধ্বজাধারী মার্কিন-ব্রিটেনসহ ন্যাটো গোষ্ঠী। ৫১ বছর হয়ে গেল। নানাবিধ জরুরি অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, হত্যাকাণ্ড, অর্থনৈতিক ইস্যু, সামাজিক অনেক কিছু নিয়ে নিরন্তর আন্দোলনে ব্যাপৃত হয়েছি। কিন্তু এই ভয়ংকর গণহত্যা ইস্যু নিয়ে গবেষণা, প্রকল্প, ব্যক্তিগত নানাবিধ উদ্যোগ থাকলেও আমরা ওই পাশ্চাত্যের লুকিয়ে রাখা আমাদের একাত্তরের গণহত্যা ও জেনোসাইড ইস্যুকে প্রকাশ্য করার কাজে তেমন মনোযোগ দিতে পারিনি। এখানেই তীব্র কষ্ট, তীব্র অপরাধবোধ।
১৭ এপ্রিল ২০২২ শেষ বিকেলে তাই মন খুলে কথা বললাম, চুকনগরসহ একাত্তরে পাকিস্তানি বর্বর সেনাবাহিনীর সব গণহত্যার বীভৎস স্বরূপ পৃথিবীর কাছে তুলে ধরার জন্য ‘আমরা একাত্তর’ সংগঠনটির সবটুকু শক্তিকে নিয়োজিত করব। তাই...আসুন চুকনগর বধ্যভূমিতে আগামী ২০ মে, শুক্রবার সমবেত হই, শ্রদ্ধা জানাই অজানা গণহত্যার শহীদদের। চুকনগর হত্যাকাণ্ডের গভীরে জানা গেছে, খুঁজে পাওয়া গেছে পৃথিবীর এক মহাঐশ্বর্য। সেদিন গণহত্যার স্তূপে এরশাদ আলী মোড়ল তাঁর পিতার লাশ খুঁজতে গিয়ে দেখেন এক নিহত মায়ের বুকে এক শিশু। মায়ের চিহ্নে বোঝা গেল মেয়েটি সনাতন ধর্মাবলম্বী। তাতে কী! অতি সাধারণ একজন মানুষ যে এত বড় মানুষ, তা যিনিই জানতে পারেন তিনিই এরশাদ আলী মোড়লের প্রতি শ্রদ্ধায় নত হয়ে যান। সেই শিশুটিকে ছোট থেকে লালনপালন করে সনাতন ধর্মীয় নিয়মে বড় হলে বিয়ে দেন সনাতনধর্মী পাত্রের কাছে। মানবিক পিতা এরশাদ আলীই ‘মহামানব’। আমরা পরিবারের কেউ অন্য ধর্মাবলম্বীর সঙ্গে জীবনসম্পর্ক গড়ে তুললে অনেক বাম-কেউকেটাকে পর্যন্ত গড়াগড়ি করে কাঁদতে দেখেছি। চুকনগরের মহা গণহত্যাকাণ্ড একজন ‘মহামানব’ পৃথিবীকে উপহার দিয়েছে।
এই সেই ভদ্রা নদী, যাকে অসহায়ভাবে একাত্তরের ২০ মে সংঘটিত গণহত্যার হাজার দশেক লাশ বহন করতে হয়েছিল ৫১ বছর আগে।
হিলাল ফয়েজী, প্রকৌশলী কলাম লেখক