সংবাদপত্রে এমন সব খবর ছাপা হয়, যা পড়ে শুধু মন খারাপ হয় না, মানুষ হিসেবে পরিচয় দিতেও লজ্জা হয়। মানুষকে বলা হয় সৃষ্টির সেরা জীব। সেই মানুষ যখন অবলীলায় পৃথিবীর
নিকৃষ্টতম ঘৃণ্য জীবের মতো কাজ করে, তখন কষ্ট হয় বৈকি!
ময়মনসিংহ শহরের পাশে চর ঈশ্বরদিয়া গ্রামের এক নারীকে হাত-পা বেঁধে শরীরে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার মতো নৃশংস ঘটনাটি যারা ঘটিয়েছে, তারা আসলে কেমন মানুষ? অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় তাঁকে হাসপাতালে নিয়েও বাঁচানো যায়নি। লাইলী নামের ওই নারীর অপরাধ কি ছিল? তিনি কি কারও পাকা ধানে মই দিয়েছিলেন? তিনি কারও সামনে থেকে আহার কেড়ে নিয়েছিলেন? নাকি কারও জীবন অনিরাপদ করে তুলেছিলেন?
না, এসব কিছু না করেও লাইলী বেগমের মতো একজন নিরীহ গৃহবধূকে জীবন দিতে হলো। যারা তাঁকে পুড়িয়ে মেরেছে, তাদের সঙ্গে লাইলীর কোনো ব্যক্তিগত লাভালাভের বিষয় জড়িত না থাকলেও নিজের ছেলের ‘অপরাধে’ তাঁকে প্রাণ দিতে হলো। কী অপরাধ তাঁর ছেলে সিরাজুল ইসলামের?
সিরাজুল ইসলাম ভালোবাসার সম্পর্কে জড়িয়েছেন খুকি আক্তার নামের এক মেয়ের সঙ্গে। বিষয়টি জানাজানি হয়। আর্থিকভাবে দুই পরিবার এগিয়ে-পিছিয়ে থাকায় মেয়েটির অন্য জায়গায় বিয়ে দিতে পাত্র খুঁজতে থাকে পরিবার। কিন্তু খুকি পালিয়ে যান তাঁর ভালোবাসার মানুষ সিরাজুলের হাত ধরে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে খুকির আত্মীয়রা আগুন ধরিয়ে দেয় সিরাজুলের মা লাইলীর শরীরে।
লাইলীর স্বামী আবদুর রশিদ আটজনকে আসামি করে গত মঙ্গলবার ময়মনসিংহের কোতোয়ালি মডেল থানায় মামলা করেছেন। আসামিরা হয়তো গ্রেপ্তার হবে। আসামিদের শাস্তি হবে কি হবে না, তা নিশ্চিত বলা যায় না। শাস্তি হলেও লাইলী আর ফিরে আসবেন না।
প্রশ্ন হলো, দুটি প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে-মেয়ের প্রেমের সম্পর্কের পরিণতিতে এমন নৃশংসতা আমাদের সমাজের কোন অবস্থানের ইঙ্গিত করছে? সামাজিক মূল্যবোধ, সহমর্মিতা, সহানুভূতির জায়গা থেকে আমরা ক্রমাগত পিছিয়ে যাচ্ছি। পাড়া-প্রতিবেশীদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকার, কোনো সমস্যা দেখা দিলে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথ খোঁজার যে ধারা আমাদের দেশে চালু ছিল, তা কীভাবে আমরা হারিয়ে ফেললাম? কারও সঙ্গে বিরোধ তৈরি হলে তাকে মেরে ফেলার মতো এমন উগ্র চিন্তা কীভাবে সাধারণ মানুষের মাথায় আসছে? মানুষের মানবিক বোধবুদ্ধি কেন লোপ পাচ্ছে?
মানুষের এমন অসহিষ্ণু হয়ে ওঠার কারণ খোঁজা জরুরি। দেশের মানুষের একটা অংশ অকারণেই সহিংস হয়ে উঠছে মনে করা যায় কি? সব মানুষের না হলেও কিছু মানুষ কেন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে, তা তত্ত্বতালাশ না করলে সমাজে শান্তিপূর্ণ অবস্থানই তো অসম্ভব হয়ে উঠবে। মানুষকে বলা হয় সমাজবদ্ধ জীব। মানুষ একা বা বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে না। তাহলে কেন একে অন্যের প্রতি আস্থা, বিশ্বাস নষ্ট করে এমন সহিংস আচরণ?