ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মালিকানাধীন ৯টি মার্কেটের প্রায় সাড়ে তিন হাজার দোকান পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, পরিত্যক্ত মার্কেটগুলো অতিমাত্রায় ঝুঁকিপূর্ণ, যেকোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে। অথচ পরিত্যক্ত ঘোষণার পর এসব মার্কেট এক দিনের জন্যও বন্ধ করা হয়নি। ব্যবসা ঠিকই চলছে, কিন্তু বন্ধ আছে ডিএনসিসির রাজস্ব আদায়। বছরের পর বছর শতকোটি টাকা রাজস্ববঞ্চিত হচ্ছে ডিএনসিসি। তবে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে করপোরেশনের একটি দুষ্ট চক্র।
নথি থেকে জানা যায়, ২০১৯ সালের ১৪ জানুয়ারি ডিএনসিসির এক সভায় সব পরিত্যক্ত মার্কেট ভাঙার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু সে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়নি। সংশ্লিষ্ট লোকজন বলছেন, পরিত্যক্ত মার্কেটের লাভের গুড় খাচ্ছেন বিশেষ ব্যক্তিরা। এ অনিয়মের সঙ্গে মেয়র অফিসের শীর্ষ কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার অভিযোগ আছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ওপরের ইশারা ছাড়া তো কিছু হয় না।’
নগর-পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহাম্মদ খান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ডিএনসিসি অফিশিয়ালি রাজস্ব নিচ্ছে না। তবে এর সঙ্গে উপকারভোগী অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশ থাকতে পারে। টাকার ভাগ কার কার পকেটে যায়, এটা নিয়ে তদন্ত হওয়া উচিত।’
ডিএনসিসির বাজার শাখার তথ্য অনুসারে, এর আওতায় মোট ৩৬টি মার্কেট আছে। এর মধ্যে ৯টি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। কোনোটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে দেড় যুগ আগে, কোনোটি কয়েক বছর আগে। মার্কেটগুলো হচ্ছে মোহাম্মদপুর টাউন হল পাকা মার্কেট, মোহাম্মদপুর কাঁচাবাজার প্রথম ও দ্বিতীয় তলা, গুলশান-২ কাঁচা মার্কেট (হলুদ বিল্ডিং), গুলশান-১ পাকা মার্কেট, রায়েরবাজার মার্কেট, কারওয়ান বাজারের কিচেন মার্কেট, ১ নম্বর ভবন মার্কেট, ২ নম্বর ভবন মার্কেট ও কাঁচামালের আড়ত মার্কেট। এসব মার্কেটে প্রায় সাড়ে তিন হাজার দোকান রয়েছে। সবচেয়ে বেশি, ৯৭৫টি দোকান রায়েরবাজার মার্কেটে। কারওয়ান বাজার কিচেন মার্কেটে দোকান ৮১৪ টি।
ডিএনসিসির রাজস্ব বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, একেক এলাকার দোকান ভাড়া একেক রকম। প্রতি বর্গফুট দোকানের ভাড়া সাড়ে ৩ টাকা থেকে ১৫ টাকা পর্যন্ত। এ ছাড়া পরিত্যক্ত মার্কেটের দোকানিদের বছরের পর বছর ট্রেড লাইসেন্সও নবায়ন করা হয় না। সাড়ে তিন হাজার দোকানের ভাড়া ও ট্রেড লাইসেন্সের নবায়ন ফি বাবদ প্রতি মাসে অন্তত কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে ডিএনসিসি।
রায়েরবাজার সিটি করপোরেশন মার্কেট বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল অবশ্য আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘রাজস্ব জমা দেওয়ার বিষয়ে একাধিকবার সিটি করপোরেশনে চিঠি দিয়েছি। কিন্তু কোনো সাড়া পাইনি।’
পরিত্যক্ত মার্কেটগুলোর কোনোটির দেয়াল ও ছাদের আস্তরণ খসে পড়েছে। ভাঙা অংশ পড়ে আহত হওয়া ছাড়াও দুবার আগুনে পুড়েছে গুলশান-১ পাকা মার্কেট। গুলশান ডিএনসিসি কাঁচা ও সুপার মার্কেট সমবায় সমিতির সভাপতি দীন মোহাম্মদ বলেন, ‘২০১৭ ও ২০১৯ সালে আগুনে পুড়েছে এই মার্কেট। দুই বছর আগে শুনেছি, এই মার্কেট ভেঙে নতুন করে করা হবে। তারপর আর কিছু শুনিনি।’
গুলশান-২ কাঁচা মার্কেটের (হলুদ বিল্ডিং) দোতলায় সুন্দরবন কুরিয়ারের অফিস। এর মালিক এনামুল কবির জানান, ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেট হিসেবে বেশ কয়েকবার সাইনবোর্ড লাগিয়েছে।দু-এক দিনের মধ্যে আবার খুলেও ফেলা হয়েছে। অভিযোগ আছে, তিনতলায় অবৈধভাবে দোকান বানানোয় ঝুঁকি আরও বেড়েছে। গত ২৮ নভেম্বর গুলশান-২ ডিএনসিসি নগর ভবনে পরিত্যক্ত মার্কেটের বিষয়ে জানতে চাইলে মেয়র আতিকুল ইসলাম পরে বক্তব্য দেওয়ার কথা বলে এড়িয়ে যান। এরপর দুই দিন কয়েকবার ডিএনসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তার মাধ্যমে যোগাযোগ করা হলেও মেয়রের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
তবে আশার বাণী শোনালেন ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সেলিম রেজা। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘মার্কেটগুলো যেকোনো সময় ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ভাঙার আগে কিছু প্রক্রিয়া আছে, সেটা সম্পন্ন করছি। এসব জায়গায় বহুতল আধুনিক সুপার মার্কেট গড়ে তুলব।’
পরিত্যক্ত মার্কেটে এক মিনিটও কাউকে ব্যবসা করার সুযোগ দেওয়া উচিত নয় বলে মনে করেন আদিল মুহাম্মদ খান। তিনি বলেন, ‘দুর্ঘটনা তো বলে-কয়ে আসে না। ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেট ভেঙে প্রাণহানি ঘটলে এর দায় সিটি করপোরেশন এড়াতে পারবে না।’