২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর নিয়ম করেছিল বাসাবাড়িতে বিদ্যুৎ-সংযোগ পেতে হলে বাধ্যতামূলকভাবে সোলার প্যানেল লাগানোর। কিন্তু সেই সৌরবিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করার ব্যবস্থা রাখা হয়নি। এতে সৌরবিদ্যুতের একধরনের অপচয়ই হচ্ছিল।
আগামী ডিসেম্বর মাসের মধ্যে কয়লাভিত্তিক কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসবে। তখন বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে কিছু গ্যাস শিল্প খাতে সরবরাহ করার সুযোগ সৃষ্টি হবে। এমন আশার বাণী শুনিয়ে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী গত রোববার রাজধানীতে এক আলোচনা সভায় বলেছেন, ‘এরপরও যদি পরিস্থিতি উন্নতির দিকে না যায়, তখন প্রয়োজনে দিনের বেলায় কোনো বিদ্যুৎ ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকার দিকে যেতে হবে।’ জ্বালানি উপদেষ্টার এই মন্তব্যের পর দেশে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে বোঝানোর আর দরকার পড়ে না।
দ্রুত বিদ্যুৎ পাওয়ার আশায় সরকার ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলভিত্তিক রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপন করার প্রতি বেশি মনোযোগ দেওয়ায় জ্বালানি বাবদ বেশি খরচের ভারে দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে বেশ কয়েক বছর ধরেই। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বে জ্বালানি তেলের সংকট এবং ডলারের দাম বাড়ার কারণে সরকারের এখন ত্রাহি অবস্থা। কৃচ্ছ্রসাধন করেও পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে গত আগস্টের প্রথম সপ্তাহে জ্বালানি তেলের রেকর্ড পরিমাণ দাম বাড়িয়েছে সরকার। এর পরিণাম হিসেবে বেড়ে গেছে পরিবহন খরচ, যা ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলেছে জনজীবনে। অথচ কম সময়ে, কম খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুযোগ ছিল, এখনো আছে।
তুষ থেকে সস্তায় সহজে বিদ্যুৎ উৎপাদনের উপায় বাংলাদেশেই উদ্ভাবিত হয়েছে। ব্যক্তি পর্যায়ে তুষ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছেও। তুষ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সরকারের তেমন বড় অঙ্কের বিনিয়োগেরও প্রয়োজন হতো না। বেসরকারি উদ্যোক্তাদের দিয়েই এ ধরনের প্ল্যান্ট চালু করানো যায়।
এটি অবশ্য আজকের আলোচনার মূল প্রসঙ্গ নয়।
ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সবচেয়ে সম্ভাবনাময় উৎস হচ্ছে সৌরশক্তি। সৌরশক্তি কাজে লাগিয়ে দেশে এ পর্যন্ত প্রায় ৩২৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হয়েছে বলে উল্লেখ আছে টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (স্রেডা) ওয়েবসাইটে। তবে ওই বিদ্যুতের বেশির ভাগই এসেছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে তথা অফগ্রিড (জাতীয় গ্রিডের সঙ্গে সংযোগবিহীন) এলাকায় স্থাপিত সোলার হোম সিস্টেম থেকে। প্রতি মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য তিন একরের বেশি ভূমির প্রয়োজন হওয়ায় বড় আকারের সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করার জন্য ভূমির সংস্থান দুরূহ। এ কারণে গ্রিডে সংযুক্ত বিভিন্ন স্থাপনা যেমন বাসাবাড়ি, শিল্পকারখানার অব্যবহৃত ছাদে সোলার সিস্টেম স্থাপনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা যায়। স্রেডার মতে, ছাদে সোলার হোম সিস্টেম স্থাপন করা হলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে নবায়নযোগ্য জ্বালানির অবদান বাড়বে।
সূর্যালোক থেকে বিদ্যুৎ তথা সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের সহজ পদ্ধতি হলো নেট মিটারিং, যা রুফটপ সোলার ও জাতীয় গ্রিডের একটি সমন্বিত ব্যবস্থা। এর মাধ্যমে ভবনের ছাদে স্থাপিত সোলার প্যানেলের সঙ্গে সংযোগ ঘটানো হয় জাতীয় গ্রিডের। নেট মিটারিং পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ গ্রাহক নিজ স্থাপনায় স্থাপিত নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক সিস্টেমে উৎপাদিত বিদ্যুৎ নিজে ব্যবহার করে উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ জাতীয় সঞ্চালন লাইনে সরবরাহ করতে পারেন। এভাবে সরবরাহ করা বিদ্যুতের জন্য সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের বিদ্যুৎ বিল সমন্বয় করা হয় পরবর্তী মাসের বিলের সঙ্গে।
উন্নত বিশ্বে অনগ্রিড সোলার সিস্টেম চালু হয়েছে বহু বছর আগেই। ভারত, শ্রীলঙ্কাসহ বিশ্বের অর্ধশতাধিক দেশে নেট মিটারিং পদ্ধতি চালু আছে। দেশেও নেট মিটারিং পদ্ধতি এসেছে বেশ কয়েক বছর আগে। কিন্তু বগুড়া জেলায় খাদ্য অধিদপ্তরের একটি ভবনের ছাদে স্থাপিত সোলার সিস্টেমকে বিতরণ গ্রিডের সঙ্গে সংযুক্ত করে নেট মিটারিং প্রক্রিয়ায় বিদ্যুৎ আদান-প্রদান করা ছাড়া এখনো দেশের সরকারি অন্য কোনো ভবনে নেট মিটারিং স্থাপন করার খবর মেলেনি। সরকারি ভবনে এই পদ্ধতি চালু না করলে ব্যক্তিপর্যায়ে চালু হবে কী করে! এ ছাড়া সরকারি সংস্থা স্রেডাই বলছে, সোলার সিস্টেম স্থাপনের জন্য অনগ্রিড বিদ্যুৎ গ্রাহককে প্রণোদনা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হলে তা নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকে উৎসাহিত করবে। কিন্তু সেই প্রণোদনা দেওয়ার কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। অথচ শুধু নেট মিটারিং চালু করেই ডিজেলনির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। ২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে দুই মাসের টার্গেট দিয়ে ২০ জন করে নেট মিটারিং গ্রাহক সৃষ্টি করতে বলা হয়েছিল প্রতিটি বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিকে। কিন্তু পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) ছাড়া সবাই ব্যর্থ হয় সেই লক্ষ্য পূরণ করতে। প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা ২০২০ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনলাইন মাধ্যমে এক কর্মশালায় বলেছিলেন, নেট মিটারিং সিস্টেম গ্রাহকবান্ধব করতে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। রুফটপ সোলার ও নেট মিটারিং সিস্টেম ব্যবহারকারীর প্রযুক্তিগত সহযোগিতা বাড়ানো প্রয়োজন। উপদেষ্টা এমন তাগিদ দিলেও বাস্তবে দেশের বেশির ভাগ মানুষ জানেই না নেট মিটারিং আসলে কী!
মাস দেড়েক আগে পরিকল্পনা কমিশনের এক সদস্যের আমন্ত্রণে তাঁর দপ্তরে আড্ডায় মিলিত হয়েছিলাম আমাদের কলেজজীবনের বেশ কয়েকজন বন্ধু, রাজধানীতেই যাঁদের বসবাস। নেত্রকোনা থেকে এক চিকিৎসক বন্ধুর আগমন উপলক্ষে ছিল সেই আড্ডা। অংশগ্রহণকারীদের কেউ সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা, কেউ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, কেউ ব্যবসায়ী। সেই আড্ডায় প্রসঙ্গক্রমে তুলেছিলাম নেট মিটারিং পদ্ধতির কথা। স্পষ্ট বোঝা গেল, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য বন্ধু ছাড়া উপস্থিত কেউই অবহিত নন প্রযুক্তিটি সম্পর্কে। তাহলে সাধারণ মানুষ জানবে কী করে!
কয়েক বছর আগেই বিদ্যুতের প্রিপেইড মিটার স্থাপন করা হয়েছে দেশের নানা স্থানে। মাসখানেক আগে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির এক বৈঠকে প্রিপেইড মিটার স্থাপনের অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা হয়। সেই আলোচনা থেকে জানা যায়, এ পর্যন্ত প্রিপেইড মিটারের আওতায় এসেছে গ্রাহকদের ১২ শতাংশ। ছয়টি বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা এই মিটার স্থাপনের কাজ করছে। ২০২৫ সালের মধ্যে দেশের সব বিদ্যুৎ গ্রাহককে প্রিপেইড মিটারের আওতায় আনার লক্ষ্যমাত্রা আছে সরকারের। প্রকল্পের অর্থে এই মিটার স্থাপন করার পর বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলো এখন মাসে মাসে সামান্য হারে টাকা কেটে নেওয়ায় গ্রাহকদের গায়ে লাগছে না। কিন্তু প্রিপেইড মিটারের যে দাম, তাতে বিশেষ প্রকল্পের আওতায় বিতরণ কোম্পানিগুলো সেটি স্থাপন না করে দিলে কতজন গ্রাহক নিজ খরচে তা কিনে লাগাতেন বা লাগাবেন?
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর নিয়ম করেছিল বাসাবাড়িতে বিদ্যুৎ-সংযোগ পেতে হলে বাধ্যতামূলকভাবে সোলার প্যানেল লাগানোর। কিন্তু সেই সৌরবিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করার ব্যবস্থা রাখা হয়নি। এতে সৌরবিদ্যুতের একধরনের অপচয়ই হচ্ছিল। এ ছাড়া অনেক গ্রাহক ভবনে বিদ্যুৎ-সংযোগ পাওয়ার আশায় সোলার প্যানেল স্থাপন করলেও ব্যাটারিজনিত জটিলতার কারণে তা আর ব্যবহার করেননি বেশি দিন। অথচ নেট মিটারিংয়ের ব্যবস্থা করা গেলে আবাসিক ভবনে নতুন বিদ্যুৎ-সংযোগ পেতে হোম সোলার সিস্টেম স্থাপনের বাধ্যবাধকতাটি অনেক কার্যকর হতো।
সারা দেশে চলাচল করছে কয়েক লাখ ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক। এক লাখ ইজিবাইক বা রিকশার ব্যাটারি চার্জ দিতে জাতীয় গ্রিড থেকে প্রতিদিন অন্তত ১১০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ খরচ হওয়ার কথা। সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে ওই সব যানবাহনের ব্যাটারি রিচার্জ করার ব্যবস্থা করা হলে বিপুল পরিমাণ জ্বালানি সাশ্রয় করা সম্ভব। দেশের ফুয়েলিং স্টেশনগুলোকে জরুরি ভিত্তিতে নেট মিটারিং পদ্ধতির আওতায় আনা হলে কোনো জ্বালানি আমদানি ছাড়াই দ্রুত উল্লিখিত পরিমাণ বিদ্যুৎ সৌরশক্তি থেকে পাওয়া সম্ভব। আর আবাসিক, বাণিজ্যিক বা শিল্প—সব খাতেই নেট মিটারিং সহজলভ্য হলে দিনের বেলায় জাতীয় গ্রিড থেকে তেমন কোনো বিদ্যুৎ লাগারই কথা নয়; বরং ওই সব গ্রাহক নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে বাড়তি কিছু বিদ্যুৎ যোগও করতে পারেন গ্রিডে। তবে সে জন্য প্রিপেইড মিটার চালুর ক্ষেত্রে যে ধরনের প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল বা হচ্ছে, একই রকমভাবে নেট মিটারিংয়ের ক্ষেত্রেও দ্রুত গ্রাহকদের জন্য প্রণোদনার ব্যবস্থা করা জরুরি। তা না হলে নবায়নযোগ্য জ্বালানির লক্ষ্যপূরণ অধরাই থেকে যেতে পারে।
লেখক: আজাদুর রহমান চন্দন, সাংবাদিক