হোম > ছাপা সংস্করণ

বাংলাদেশ প্লাস্টিকমুক্ত হচ্ছে

পাভেল পার্থ

একবার ব্যবহারযোগ্য (ওয়ানটাইম) প্লাস্টিক থেকে দেশকে মুক্ত করার অঙ্গীকার করেছে সরকার। লক্ষ্য অর্জনে প্রথম ধাপে সব সরকারি দপ্তরে প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সরকারি দপ্তরগুলোতে প্লাস্টিকের পরিবর্তে কাচের বোতলে পানি রাখার জন্য সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে নির্দেশনা দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এমনকি সরকারি আমন্ত্রণপত্র, নিমন্ত্রণপত্র, ভিজিটিং কার্ড এবং ফাইল-ফোল্ডারে প্লাস্টিক ব্যবহার ও লেমিনেটিং ব্যবহার বন্ধ করতে বলা হয়েছে।  প্রথমেই সরকারের এই উদ্যোগকে অভিনন্দন জানাই। একই সঙ্গে এই প্রক্রিয়া সফল করে তুলতে জনপরিসরের সামগ্রিক অংশগ্রহণ ও পরিবেশ-মনস্তত্ত্বকে তৎপর করার প্রস্তাব রাখছে।

পলিথিন-প্লাস্টিক এক জ্যান্ত পুঁজিবাদী পাপ। তীব্র ভোগবাদিতা আর নয়া উদারবাদী করপোরেট বাজার পৃথিবীকে প্লাস্টিকের তলায় খামচে ধরেছে। মাটি কিংবা মানুষ আজ প্লাস্টিকের কারণে শ্বাস নিতে পারছে না। সমুদ্র থেকে শুরু করে রক্তকণিকা—সর্বত্রই মিলছে প্লাস্টিকের দগদগে ক্ষত। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সূত্র দিয়ে গণমাধ্যম জানাচ্ছে, দেশে কঠিন বর্জ্যের ১০ শতাংশই প্লাস্টিক। এর ভেতর ৬০ ভাগই একবার ব্যবহার করে ফেলে দিতে হয় এবং বাকি ৪০ শতাংশ পুনরায় ব্যবহার উপযোগী করা যায়। একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক দেশে উৎপাদিত হয় বছরে প্রায় ৩ হাজার ৭৪৪ টন। একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বন্ধে প্রাথমিকভাবে দেশের ১২টি জেলার ৪০টি উপজেলাকে বেছে নিয়েছে সরকার।

কিন্তু নাগরিক হিসেবে আমরা কি প্লাস্টিক বর্জন করতে প্রস্তুত? বিশেষ করে প্লাস্টিক যখন আমাদের খাদ্যরুচি থেকে শুরু করে দিনযাপনের প্রতিটি পর্ব নিয়ন্ত্রণ করছে। আমরা জানছি প্লাস্টিক বিপজ্জনক, কিন্তু আমাদের মনস্তত্ত্ব আর অভ্যাস প্রতিদিন প্লাস্টিক জাপটে বড় হচ্ছে। পানির বোতল শেষ করার পর বারবার একে আবারও পানির বোতল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। বাজার থেকে কিনছি প্লাস্টিক মোড়ানো খাবার, মাছ ঢুকছে পলিথিনে, প্লাস্টিক মুড়িয়ে দীর্ঘদিন ফ্রিজে রাখছি খাবার। দুধ রাখছি প্লাস্টিকে, প্রসাধনের প্লাস্টিক কৌটা ব্যবহার করছি বহুবার। লুডুর ছক্কা থেকে শুরু করে বাচ্চাদের খেলনা প্লাস্টিক, প্রবীণের জুতা প্লাস্টিক। পাড়ায় পাড়ায় দুম করে গায়েব হলো রংতুলির দোকান। অনুষ্ঠানের মঞ্চ দখল করল সর্বনাশা প্লাস্টিক পিভিসি ব্যানার। নির্বাচনের পোস্টার পর্যন্ত ঢেকে দিল প্লাস্টিক। রান্নাঘর থেকে বিছানা—সব আজ প্লাস্টিকময়। কিন্তু এর শেষ কোথায়? কেবল রাষ্ট্র এককভাবে সিদ্ধান্ত আর প্রকল্প গ্রহণের ভেতর দিয়ে কি দেশকে প্লাস্টিকমুক্ত করতে পারবে? কোনোভাবেই সেটি সম্ভব নয়। যদি না আমরা করপোরেট নয়া উদারবাদী বাজার আর ভোগবাদকে প্রশ্ন না করি কিংবা প্লাস্টিকের বিরুদ্ধে সক্রিয় জন-আন্দোলন গড়ে না তুলি।

দেশজুড়ে এখানে-সেখানে প্লাস্টিক বোতল, প্যাকেট আর মোড়কের ভাগাড়। এত প্লাস্টিক আসে কোথা থেকে? কারা বানায়? কী থাকে এসব প্লাস্টিকের মোড়ক আর ধারকে? যা থাকে তা না খেলে, ব্যবহার না করলে কি জীবন বরবাদ হয়ে যায়? না, যায় না। কারণ, এসব মোড়ক ও ধারকে যা থাকে তা খাদ্য, পানীয় কিংবা প্রসাধন হলে এসব না ব্যবহার করেও দুর্দান্ত এক স্বাস্থ্যকর দীর্ঘ জীবন পাড়ি দেওয়া যায়। তাহলে এত পণ্য যায় কোথায়? আর এর বহুল ব্যবহারই যদি না হয়, তবে এই সব পণ্য এত প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি করে কীভাবে? শোনা যায়, ক্ষুধা নিবারণ বা পুষ্টি নয়, এসব গিলতে হয় স্রেফ ‘বানোয়াট সামাজিক স্ট্যাটাস’ রক্ষার ঠেলায়। কোক-পেপসি না হলে নাকি ‘স্মার্টনেসের জাত যায়’! আর ঘাম ঝরিয়ে এই ‘জাত-কুল’ বাঁচাতে পৃথিবী হয়ে উঠছে বিপজ্জনক প্লাস্টিক বর্জ্যের ভাগাড়। এসব করপোরেট কোম্পানির মাধ্যমেই সবচেয়ে বেশি প্লাস্টিক দূষণ ঘটছে।

প্লাস্টিক কেবল মাটি, পানি, বাতাসের জন্য বিপজ্জনক নয়, মানুষসহ প্রাণ-প্রকৃতিতেও নির্দয়ভাবে ঢুকে যাচ্ছে প্লাস্টিক। আমাদের খাদ্যশৃঙ্খলের ভেতরও প্রবেশ করছে মাইক্রোপ্লাস্টিক। প্লাস্টিকবিরোধী আন্তর্জাতিক পরিবেশ সংগঠন ‘ব্রেক ফ্রি ফ্রম প্লাস্টিক’ করপোরেট প্লাস্টিক দূষণবিষয়ক তাদের তৃতীয় সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ২০২০ সালের ২ ডিসেম্বর। এই সমীক্ষা তৃতীয়বারের মতো প্রমাণ করেছে, কোক-পেপসি এবং নেসলের মতো বহুজাতিক কোম্পানির মাধ্যমেই দুনিয়ায় ভয়াবহ প্লাস্টিক দূষণ ঘটছে। ২০১৯ সালে ৫১টি দেশে জরিপটি করা হয় এবং দেখা যায়, ৩৭টি দেশে কেবল কোকা-কোলার মাধ্যমেই সবচেয়ে বেশি প্লাস্টিক দূষণ ঘটে। টিয়ারফান্ডের অপর একটি সমীক্ষা জানায়, ছয়টি উন্নয়নশীল দেশে পাওয়া ৫ লাখ প্লাস্টিক বর্জ্যের জন্য কোক-পেপসি ও নেসলে দায়ী। প্রতিবছর পৃথিবীতে উৎপন্ন ৯১ শতাংশ প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহার না হয়ে পরিবেশে বিপজ্জনক বর্জ্য হিসেবে জমা হয়।

১৯৩৩ সালে পলিমার পণ্য আবিষ্কৃত হলেও ১৯৫৮ সাল থেকে ভোক্তার ক্রয়সীমানা দখল করে নেয়। পরিবেশ অধিদপ্তরের সূত্রমতে, ১৯৮২ সালে বাংলাদেশে পলিথিন বাজারজাতকরণ ও ব্যবহার শুরু হয়। পলিথিন গলে না, মেশে না, পচে না। ৫০০ থেকে হাজার বছরে এটি আবারও প্রকৃতিতে রূপান্তরিত হয়। ২০০২ সালের এক সমীক্ষা অনুযায়ী, ঢাকা শহরে প্রতিদিন একটি পরিবার গড়ে চারটি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করত। পরিবেশ অধিদপ্তরের মতে, ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশে দৈনিক ৪৫ লাখ পলিথিন ব্যাগ ব্যবহৃত হতো, ২০০০ সালে ৯৩ লাখ। দুনিয়ায় প্রতিবছর প্রায় ৬০ মিলিয়ন টন পলিথিন সামগ্রী তৈরি হয়।

১৯৯৫ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের ৬ (ক) (সংশোধিত ২০০২) ধারা অনুযায়ী, ২০০২ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকা শহরে এবং একই সালের ১ মার্চ বাংলাদেশে পলিথিন নিষিদ্ধ করা হয়। পলিথিন নিষিদ্ধকরণ প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ‘...যেকোনো প্রকার পলিথিন ব্যাগ, অর্থাৎ পলিথাইলিন, পলিপ্রপাইলিন বা উহার কোনো যৌগ বা মিশ্রণের তৈরি কোনো ব্যাগ, ঠোঙা বা যেকোনো ধারক যাহা কোনো সামগ্রী ক্রয়-বিক্রয় বা কোনো কিছু রাখার কাজে বা বহনের কাজে ব্যবহার করা যায় উহাদের উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাতকরণ, বিক্রয়, বিক্রয়ের জন্য প্রদর্শন, মজুত, বিতরণ, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিবহন বা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার দেশে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হইল।’ প্রজ্ঞাপনে বিস্কুট, চানাচুরসহ বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য, ওষুধ, সিমেন্ট, সারসহ ১৪টি পণ্যের ক্ষেত্রে সাময়িকভাবে পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করার কথা বলা হয়েছে।

পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০০২)-এর ১৫ (১) অনুচ্ছেদের ৪ (ক) ধারায় পলিথিন উৎপাদন, আমদানি ও বাজারজাতকরণের জন্য অপরাধীদের সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা ৬ মাসের কারাদণ্ডের বিধান আছে। আইন অনুযায়ী, ১০০ মাইক্রোনের কম পুরুত্বের পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ। আইন অমান্যকারীর জন্য ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং ১০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। বাজারজাত করলে ৬ মাসের জেল ও ১০ হাজার টাকা জরিমানা। মাঝেমধ্যে এ আইন মেনে ভ্রাম্যমাণ আদালত ‘লোকদেখানো’ কিছু জরিমানা আর অভিযান চালালেও পলিথিন থামছে না। প্লাস্টিক-পলিথিন যেন আইন, বিচারকাঠামো, সরকার, রাষ্ট্র সবকিছুর চেয়ে শক্তিময় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বারবার প্লাস্টিক-পলিথিনের কাছে জিম্মি হলেও আমরা আশা রাখি, রাষ্ট্র এবার প্লাস্টিকবিরোধী অঙ্গীকার সফল করতে পারবে। আর একে সফল করে তুলতে হবে সব নাগরিককেই। প্রতিটি সরকারি অফিসে প্লাস্টিক বোতল বাতিল করে মাটি বা কাচের বোতলের চল হতে পারে।রাষ্ট্রীয় সব কর্মসূচিতে পাট, কাপড় বা কাগজে প্রাকৃতিক রং দিতে হাতে লেখা ব্যানারের প্রচলন করতে হবে। প্রাকৃতিক উপাদান ও বর্জ্যকে পুনর্ব্যবহার করে কাগজ ও নানা সামগ্রী বানানোর বহু তরুণ উদ্যোগ আছে দেশে। সরকারি দপ্তরগুলো তাদের ভিজিটিং কার্ড, নিমন্ত্রণপত্র, ক্যালেন্ডার তৈরিতে এসব বেছে নিতে পারে। ২০২৬ সালের ভেতর দেশকে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক থেকে মুক্ত করতে হলেও বহুমাত্রিক পরিকল্পনা ও মনস্তাত্ত্বিক জাগরণ জরুরি। হয়তো আমাদের সবার সক্রিয় তৎপরতা সামগ্রিকভাবে একদিন প্লাস্টিকমুক্ত বাংলাদেশের ভবিষ্যৎকে সবুজ করে তুলবে।

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ