বাদল সরকার যখন বলতেন, মঞ্চ এবং দর্শকের অবস্থান এক সমতলে হওয়া দরকার, তখন অনেকেই তা বুঝতেন না। সৈয়দ শামসুল হক সে কথার মানে খুঁজে পেয়েছিলেন কালিয়াকৈরের একটি যাত্রাপালায়।
জামাল বাদশার স্ত্রী কমলার দুঃখের কাহিনি অভিনীত হচ্ছিল সেখানে। প্রায় ছয় ঘণ্টা ধরে যে পালাটি অভিনীত হলো, তাতে মঞ্চ আর দর্শক মিলেমিশে গিয়েছিল।অনেকেই হয়তো ‘কমলার বনবাস’ পালার কাহিনি জানেন। যাঁরা জানেন না, তাঁদের জন্য বলি, বাণিজ্যের জন্য জামাল গিয়েছে দূরদেশে। সেখানেই সে স্বপ্ন দেখেছে, আজ রাতে যে পুরুষ মিলিত হবে তার স্ত্রীর সঙ্গে, তার গর্ভে আসবে এক ক্ষণজন্মা পুত্র। সে স্বপ্ন দেখে জামাল আর দেরি করেনি। সেই সুদূর দ্বীপদেশ থেকে সমুদ্র দেওয়ের কাঁধে চড়ে যোজন যোজন পথ পাড়ি দিয়ে নিজের প্রাসাদে ফিরে এসেছে। তারপর স্ত্রী কমলার সঙ্গে মিলনের পর সে রাতেই সে ফিরে গেছে দূর দ্বীপদেশে। স্ত্রী ছাড়া তার আগমনের কথা আর কেউ জানে না। ফলে সন্তান পেটে এলে ব্যভিচারিণী আখ্যা পেল কমলা। শাশুড়ি তাকে বের করে দিল বাড়ি থেকে। কমলা বনের পথে চলে, বনের পশু এসে তাকে পথ দেখায়, পৌঁছে দেয় এক কাঠুরের বাড়ি। জন্ম হয় লালচাঁদ নামে সন্তানের। বহু ঘটনা-দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যায় কাহিনি, কমলা ফিরে পায় তার সম্মান।
সৈয়দ হক বিস্মিত হয়েছেন পালার সঙ্গে দর্শকের মেলবন্ধনে। যখন লালচাঁদ অসুখে পড়ে, তখন কমলার বিলাপের ভাষা সেকাল-একালকে এক করে দেয়। পীরের দরগায় শিরনি দেওয়ার কথা বললে কমলা বলে, তার তো টাকা নেই। তখন তাকে ভিক্ষা করার উপদেশ দেওয়া হয়। কমলা আঁচল পেতে গান গায়, ‘ভিক্ষা দাও...’। দর্শকেরা সেই আঁচলে তুলে দিতে থাকে টাকা। সৈয়দ হক টাকা দিলে দর্শকদের ভেতর থেকে প্রশ্ন ওঠে, ‘স্যারে কয় ট্যাকা দিল।’ অশ্রুসজল কমলা নোটটা নিয়ে দর্শকদের দেখায়। পালা চলতে থাকে।
সূত্র: সৈয়দ শামসুল হক, হৃৎকলমের টানে, পৃষ্ঠা ৩০৯-৩১১