চল্লিশ বছর বয়স হওয়ার আগে কোনো লেখা ছাপাবেন না, এ রকম একটা পণ করেছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। কিন্তু লিখে চলেছিলেন দেদার। চৌদ্দ বছর বয়স থেকেই গল্প-কবিতা লেখা চলছিল। এক রাতে লেখা তাঁকে পেয়ে বসল। পর পর দুটো গল্প লিখে ফেললেন। পরদিন সকালে ভবানীপুর পোস্ট অফিসে গিয়ে বড় খাম জোগাড় করে ডাকটিকিট লাগিয়ে গল্প দুটি ভরে চোখ বন্ধ করে তা ফেলে দিলেন ডাকবাক্সে। পাঠানোর ঠিকানা—‘প্রবাসী’।
যে মেসে থাকতেন, সেই মেসের ঠিকানা দেননি। দিয়েছিলেন নিজের বাড়ির ঠিকানা। কারণ, ‘অমনোনীত’ খামটা এলে মেসের ছেলেরা সেটা দেখে হাসাহাসি করবে। এরপর অপেক্ষায় অপেক্ষায় তিন মাস কেটে গেছে। এমন একসময় বাড়ি থেকে বীরু মামা এক অদ্ভুত চিঠি লিখলেন, ‘তোর প্রবাসীটা এলে আমি দু-তিন দিন রেখে পড়ে নিয়ে পাঠিয়ে দেব।’
এই কথার মানে বুঝতে পারলেন না প্রেমেন। প্রেমেন তখন প্রবাসীর গ্রাহকও নন। তাই ‘তোর প্রবাসীটা এলে’ বলতে একটা কথাই বোঝায়, যে লেখা মনোনীত হয়েছে এবং তা পাঠানো হবে বাড়ির ঠিকানায়। কিন্তু সে কথা ভাবতেও ভয় হয়।
জানতে চাইলে বীরু মামা জানিয়েছিলেন, প্রবাসী থেকে চিঠি এসেছে, দুটো লেখাই মনোনীত হয়েছে। কিন্তু সময় বয়ে যায়, প্রবাসীতে প্রেমেনের গল্প আর প্রকাশিত হয় না। প্রেমেনের সন্দেহ, বীরু মামা হয়তো ‘অমনোনীত’ শব্দটা ভুলে ‘মনোনীত’ পড়েছেন।
যখন প্রতি মাসে অপেক্ষা করতে করতে গল্পের বিষয়টা প্রায় ভুলে গেছেন প্রেমেন্দ্র মিত্র, তখন একদিন সহপাঠী অক্সফোর্ড মিশনেরই বোর্ডার বিজয় বোস রাতে ডাইনিং টেবিলে বসে বলল, ‘তোমার যে একটা গল্প বেরিয়েছে প্রবাসীতে!’
এরপর সে হেসে বলল, ‘না না, তোমার নয়, এ মাসের যে প্রবাসীটি আজ বিকেলে এসেছে, কাল সকালে রিডিং রুমে দেখো। একজন লেখকের নাম হুবহু তোমার যা তাই।’
সে রাতে কি প্রেমেন্দ্র ঘুমাতে পেরেছিলেন?
সূত্র: প্রেমেন্দ্র মিত্র, স্মৃতিকথা ও অন্যান্য, পৃষ্ঠা ১১২-১১৪