হিন্দি চলচ্চিত্র জগতের সফল অভিনেতাখানের ছেলে আরিয়ান খানের গ্রেপ্তার-রহস্য রুপালি পর্দার যেকোনো সিনেমাকে হার মানাতে বাধ্য। ২ অক্টোবর মুম্বাইয়ে প্রমোদতরি থেকে মাদককাণ্ডে তাঁকে গ্রেপ্তারের পর থেকে ঘটনাপ্রবাহ যেভাবে প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত বাঁক খাচ্ছে, তাতে করে আরও বেশি রহস্যময় হয়ে উঠছে মামলাটি। নিম্ন আদালতে দু-দুবার জামিন খারিজের পর টানা তিন দিন শুনানির পর বোম্বে হাইকোর্ট আরিয়ানের জামিন মঞ্জুর করলেও ছাড়া পেতে সময় লেগে যায় আরও দুদিন। ভারতের মাদক নিয়ন্ত্রণ ব্যুরোর (এনসিবি) কর্তারা দাবি করেন, তাঁরা আরিয়ানের মাধ্যমেই নাগাল পেতে চান আন্তর্জাতিক মাদক চোরাকারবারিদের। অন্যদিকে, মহারাষ্ট্রের প্রভাবশালী মন্ত্রী নবাব মালিকের সরাসরি অভিযোগ, অর্থ আদায়ই আরিয়ানকে গ্রেপ্তারের একমাত্র কারণ। তিনি সরাসরি অভিযোগ করেন, বিজেপিই শাহরুখদের বিরুদ্ধে এনসিবিকে ব্যবহার করছে। ফলে সন্দেহের উপাদান রয়েছে পরতে পরতে।
এদিকে, এই মামলার অন্যতম সাক্ষী কিরণ গোসাভিকে গ্রেপ্তার করেছে পুনের পুলিশ। তাঁর বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ করেছেন তাঁরই দেহরক্ষী হিসেবে পরিচিত প্রভাকর সইল। অভিযোগ করেন, ফোনে ২৫ কোটি রুপি ঘুষ নিয়ে গোসাভিকে স্যাম ডিসুজা নামের একজনের সঙ্গে তিনি কথা বলতে শুনেছেন। শেষে ১৮ কোটিতে তাঁদের রফা হয়। সেই ১৮ কোটির মধ্যে ৮ কোটি রুপি দেওয়ার কথা হয়েছিল সমীর ওয়াংখেড়েকে। তবে সব অভিযোগ অস্বীকার করেন কিরণ গোসাভি ও সমীর ওয়াংখেড়। ঘুষের কথা বিবৃতি দিয়ে এনসিবিও অস্বীকার করেছে। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। শাহরুখের বিরুদ্ধে প্রভাব খাটানোর অভিযোগ তুলেছে এনসিবি। অভিযোগ উঠেছে তাঁর ম্যানেজার পূজা দালানির বিরুদ্ধেও। পূজা নাকি ঘুষ দিয়ে মামলাকে প্রভাবিত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শাহরুখ একটিবারের মতো প্রকাশ্যে এই মামলা নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। পেছন থেকে শুধু মামলায় বাবার দায়িত্ব পালন করেছেন। এমনকি মান্নতে বিনা পরোয়ানায় মাদক-কর্তারা প্রবেশ করলেও তাঁদের সহযোগিতা করেছেন বলিউডের এই সুপারস্টার। তাঁর স্ত্রী গৌরীকেও দেখা গেছে, নীরবে মায়ের স্নেহ আর কর্তব্য দিয়ে ছেলেকে বিপদ থেকে উদ্ধারের মানবিক ভূমিকায়।
অভিযোগ আর পাল্টা অভিযোগ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অঙ্গ। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় দাঁড়িয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সংস্থা এনসিবি এবং রাজ্য সংস্থা পুলিশ আরিয়ান-কাণ্ড নিয়ে এমন লড়াই শুরু করেছে, বিষয়টি উদ্বেগের। শাহরুখপুত্রকে গ্রেপ্তারে নেতৃত্বে ছিলেন এনসিবির কর্তা সমীর ওয়াংখেড়। এখন গ্রেপ্তারের ভয়ে তিনি নিজেই আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন। এই সমীরের বিরুদ্ধে সরাসরি দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছেন আরেক সমীর, সমীর খানের শ্বশুর, রাজস্থানের মন্ত্রী নবাব মালিক। ওয়াংখেড়কে জেলে পাঠানোর প্রতিজ্ঞাও করেছেন তিনি। কারণ এনসিবির এই বিতর্কিত কর্তার জাত-ধর্ম নিয়েও তিনি প্রশ্ন তুলেছেন। নবাবের অভিযোগ অনুযায়ী, ওয়াংখেড়ের জন্মের শংসাপত্র ঠিক নেই। হিন্দু হয়েও মুসলিম ধর্মমতে তিনি নাকি বিয়ে করেছেন মুসলিম নারীকে। ঠিক তেমনি কর্মজীবনেও নাকি অত্যন্ত দুর্নীতিগ্রস্ত বলে অভিযোগ তুলেছেন তিনি। মহারাষ্ট্রের এনসিপি নেতা ও মন্ত্রী নবাবের রাগের কারণ, কিছুদিন আগে তাঁর জামাতাকেও একই কারণে গ্রেপ্তার করেছিলেন ওয়াংখেড়। পরে অবশ্য জামিনে মুক্তি পান তিনি। শাহরুখপুত্রের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসতেই নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে।
অমিতাভ বচ্চনের পর মুম্বাই চলচ্চিত্র জগতের সবচেয়ে সফল অভিনেতার নাম শাহরুখ খান। জনপ্রিয়তায় তাঁর ধারে-কাছে কেউ নেই। শাহরুখ মানেই সিনেমা হিট। প্রযোজকেরা কোটি কোটি টাকা লগ্নি করতে ভরসা পান শাহরুখকে পেলেই। তাঁর স্ত্রী গৌরী খান পাঞ্জাবি হিন্দু পরিবারে জন্মিয়েও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী। শাহরুখের বিলাসবহুল আবাসন মান্নতে সব ধর্মের আরাধনা হয়। ঈদ বা দিওয়ালিতে মান্নত মেতে ওঠে আনন্দে। চলচ্চিত্র জগতে শাহরুখের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। কিন্তু তাঁদের বৈবাহিক জীবনে কখনো কোনো বিতর্ক দেখা দেয়নি। রাজনীতির থেকে অনেকটাই দূরে থাকেন ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে কলকাতা নাইট রাইডার্সের মালিক। এই মুসলিম অভিনেতার গায়ে কোনো কালির দাগ লাগাতে পারেনি কেউ। তাঁর সাফল্যে শুধু হিংসাই করে গিয়েছেন শাহরুখবিরোধীরা। বহুকাল ধরেই হিন্দি সিনেমায় খানদেরই রাজত্ব চলছে। দিলীপ কুমার-পরবর্তী সময়ে সালমান, আমির ও শাহরুখদের দাপটে অন্যরা কিছুটা হলেও পিছিয়ে পড়েছেন। আগের মতো কাপুরদের রমরমা নেই। এ অবস্থায় হিন্দুত্ববাদীরা অনেকেই চাইছেন বলিউডের দখল নিতে। কিন্তু তাঁদের বিকল্প মিলছে না সহজে। ভারতের আপামর জনসাধারণের মন জয় করে নিয়েছেন শাহরুখেরা। ভারতীয় বিনোদনে কোনো কালেই ধর্ম বাধা হয়নি সাফল্যের ক্ষেত্রে। কিন্তু হিন্দুত্ববাদীদের সেটা সহ্য হচ্ছে না। তাই শাহরুখ-বিরোধিতার চাপা স্রোত ছিলই। সেই স্রোতেই কি ডুবতে হলো আরিয়ানকে? প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, বিশেষ করে মাদক মামলায় ঘটনাচক্রের অসংলগ্নতা এবং ঘটনাপ্রবাহ সেদিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছে।