হোম > ছাপা সংস্করণ

সংযমের মাসে অসংযমী কারবার

মহিউদ্দিন খান মোহন

ভদ্রলোক প্রায়ই ফোন করেন, বিশেষ করে পত্রিকায় আমার লেখা বেরোলে সেদিন অবধারিত। বলা যায় আমার লেখার একজন অনুরক্ত পাঠক তিনি। রাজধানীর মিরপুরের বাসিন্দা কবিরুল ইসলাম নামের এই ভদ্রলোক একজন ছোটখাটো ব্যবসায়ী। সমাজ এবং দেশকে নিয়ে ভাবেন। চারদিকের অবক্ষয় তাঁকে বেশ পীড়া দেয়। ফোনে সেসব কথা বলেন। সেদিন ফোন করে বললেন, ‘ভাইজান, সামনে রোজার মাস। জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বাড়ছে, তাতে এবার রোজাদারদের যে কী পরিস্থিতিতে পড়তে হবে, কে জানে!’ বললাম, ‘এবার তো রোজার আগেই সব জিনিসের দাম বেড়ে গেছে, আরও হয়তো বাড়বে। আমাদের আর কী হবে? দ্রব্যমূল্যের জাঁতাকলে আমরা যেমন পিষ্ট হই, তেমনি হব। তাতে কার কী এসে-যায় বলেন?’ তিনি বললেন, ‘যদিও আমি খাদ্যপণ্য বিক্রি করি না। তারপরও রমজান মাসে কোনো পণ্য বাড়তি দামে বেচব না।’ ইতিবাচক এ সিদ্ধান্তের জন্য তাঁকে ধন্যবাদ দিয়ে কথা শেষ করলাম।

কবিরুলের ফোনকল কেটে দেওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলাম। রমজান মাস এলেই আমাদের দেশে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির এক অঘোষিত ঘোড়দৌড় শুরু হয়ে যায়। সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিবারই বলা হয়, রমজান মাসে দ্রব্যমূল্য বাড়তে দেওয়া হবে না, পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে ইত্যাদি। কিন্তু সবকিছু শেষ পর্যন্ত পর্যবসিত হয় অষ্টরম্ভায়। সরকারের হুঁশিয়ারি এবং কঠোর নির্দেশকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী রোজার মাসে পণ্যমূল্যের হাই জাম্প প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়।

রমজান মাস মুসলমানদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র মাস। এই মাসে রোজা রেখে, অর্থাৎ সিয়াম সাধনার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য ও কৃপা লাভের আশায় ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা ইবাদত-বন্দেগিতে নিমগ্ন হন। দিনের বেলায় পানাহার থেকে বিরত থেকে তাঁরা সংযমের অনুশীলন করেন। হাদিস শরিফে রোজাকে ঢাল হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। যুদ্ধক্ষেত্রে ঢাল যেমন শত্রুর আক্রমণ থেকে সৈনিককে রক্ষা করে, তেমনি রোজাও সংযমী হওয়ার শিক্ষা দিয়ে মানুষকে পাপ থেকে রক্ষা করে। শুধু দিনের বেলা পানাহার থেকে বিরত থাকাকেই সিয়াম সাধনা বলে না। পাশাপাশি অন্য সব দৈনন্দিন কাজকর্মেও একজন মুমিনকে সংযমী হওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে কোরআন-হাদিসে। শুনেছি বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম দেশে রমজান মাসে পণ্যমূল্য কমিয়ে দেওয়া হয় রোজাদারদের সুবিধার জন্য। সেসব দেশের সরকার নিশ্চয়ই এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। পাশাপাশি ব্যবসায়ীরাও নৈতিক মূল্যবোধের প্রতি দায়বদ্ধতাহেতু রমজান মাসে অতিমুনাফার আশায় অহেতুক মূল্য বৃদ্ধির মতো অনৈতিক তৎপরতায় লিপ্ত হয় না।

আমাদের দেশে ঘটে ঠিক উল্টোটা। রমজান মাস এলেই নিত্যপণ্যের বাজারে শুরু হয় নানা রকম কারসাজি। পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে অতিরিক্ত মুনাফা অর্জনের চেষ্টায় রত হন এক শ্রেণির ব্যবসায়ী। ফি বছর এই একই চিত্র দেখা যায়। এবার তো বিরাজ করছে ভিন্ন এক পরিস্থিতি। রোজা আসার আগেই নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যের দাম হয়েছে আকাশছোঁয়া। অবশ্য বেশ কয়েক বছর ধরেই পণ্যের বাজারে বিরাজ করছে একধরনের অস্থিরতা। হঠাৎ হঠাৎ একেকটি পণ্যের দাম আকাশে উঠে যায়। একবার তা ওপরে চলে গেলে আর আগের অবস্থানে ফিরে আসে না। কেউ কেউ রসিকতা করে বলেন, আমাদের দেশের পণ্যমূল্যের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর চরিত্রের একটি দিক বেশ সাযুজ্যপূর্ণ। রাজনৈতিক দলগুলো যেমন একবার রাষ্ট্রক্ষমতায় গেলে আর নামতে চায় না, তেমনি দ্রব্যমূল্যও একবার ওপরের দিকে গেলে আর নামতে চায় না।

বর্তমান বাজার পরিস্থিতি সবারই জানা। যাঁরা প্রতিদিন থলে হাতে বাজারে যান, তাঁরা হাড়ে হাড়ে টের পান জীবন যাপন কত কঠিন। এক বছরে দাম বৃদ্ধি পায়নি এমন একটি পণ্যেরও নাম বলা যাবে না। চাল, ডাল, তেল, আটা, চিনি, লবণ, সাবান, সোডা, মাছ, মুরগি, হাঁস, গরু-খাসি-ভেড়ার মাংস, এমনকি পাতিল মাজুনি-ঝাড়ুসহ সব জিনিসের দামই বেড়েছে। যে ব্রয়লার মুরগির দাম মাসখানেক আগেও ছিল ১৪০ টাকা কেজি, এখন তা কিনতে হচ্ছে ২৬০ টাকায়। সোনালি জাতের মুরগির কেজি ছিল ২২০ টাকা, এখন তা ৩৫০ টাকা। গরুর মাংস বছর দুয়েক ধরে ৭০০ টাকা কেজিতে স্থির হয়েছিল। এখন তা ৮০০ টাকায় বিকোচ্ছে। ডিমের হালি ৫০ ছুঁয়ে একটু নেমে আবার ৪৫-এ ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। যে তেলাপিয়া ও পাঙাশ মাছকে বলা হতো গরিবের মাছ, দামের তাপে এখন ধনীদেরও ওগুলোর কাছে যেতে ভয় পাওয়ার অবস্থা। কদিন আগেও পাঙাশ বিক্রি হতো ১২০ টাকা কেজি দরে, এখন তা ২০০ টাকা। তেলাপিয়া ছিল ১৩০ টাকা, তা বিক্রি হচ্ছে ২২০ টাকায়।

নিত্যপণ্যের এই অগ্নিমূল্য নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষদের নাভিশ্বাস তুলেছে বলা যায়। সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, সব চলছে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে, যেন দেখার কেউ নেই। বাজার নিয়ন্ত্রণের কোনো উদ্যোগ আয়োজন লক্ষ করা যাচ্ছে না। ব্যবসায়ীরা তাদের খেয়ালখুশিমতো পণ্যের দাম বাড়িয়ে চলেছে। কোনো জবাবদিহি নেই। সরকারকে তারা তোয়াক্কা করছে বলে মনে হয় না। জিনিসপত্রের দাম নিয়ে গণমাধ্যমে খবর বেরোচ্ছে, সমালোচনা হচ্ছে। কিন্তু সরকার নির্বিকার। মাঝেমধ্যে বাজারে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের নড়াচড়া দেখা যায়। তবে তার কোনো ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া বাজার দরে লক্ষ করা যায় না।

কেউ কেউ বলতে পারেন, বাজার অর্থনীতির দেশে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। তা ছাড়া পণ্যের দর সরবরাহের সঙ্গে সম্পর্কিত। যুক্তি হিসেবে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। তবে বর্তমান বিশ্বের প্রায় সব দেশেই এখন বাজার অর্থনীতি অনুসৃত। কিন্তু কোথাও দ্রব্যমূল্য লাগামহীনভাবে বৃদ্ধি করার একচ্ছত্র অধিকার ব্যবসায়ীদের নেই। সেসব দেশে হঠাৎ কোনো পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঘটলে উৎপাদক বা সরবরাহকারীদের রীতিমতো কৈফিয়ত দিতে হয় সরকারের কাছে। এই তো কয়েক দিন আগে একটি খবর পড়েছিলাম পত্রিকায়। হঠাৎ করে ডিমের দাম একটু বেড়ে যাওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুজন কংগ্রেসম্যান ডিম উৎপাদনকারী দুটি কোম্পানিকে ব্যাখ্যা তলব করে নোটিশ ইস্যু করেছেন। তারপর কী হয়েছে সে খবর আমরা পাইনি। তবে এটাকে একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা যায়। আমাদের দেশের এমপি সাহেবরা যদি জনদুর্ভোগ সৃষ্টিকারী কাজ বা ঘটনাবলির দিকে একটু দৃষ্টি দেন, তাহলে অন্তত এ সান্ত্বনাটুকু পাওয়া যেতে পারে, আমাদের প্রতিনিধিরা জনগণের ভালোমন্দের প্রতি প্রখর দৃষ্টি রাখেন। কিন্তু হা হতোষ্মি! যা শুনি তাতে কানকে বিশ্বাস করাই কঠিন হয়ে পড়ে।

যাঁদের দায়িত্ব মুনাফাখোর, মজুতদার, কালোবাজারিদের দমন করে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ নেওয়া, সেই সব মাননীয় ব্যক্তিরা উল্টো সাফাই গান মূল্যবৃদ্ধির পক্ষে। কেউ বলেন করোনার প্রতিক্রিয়ার কথা, আবার কেউ আঙুল তোলেন ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের দিকে। আবার কেউ কেউ তো বলেই বসেন, পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনায় আমাদের দেশে পণ্য নাকি বেজায় সস্তা। কিন্তু তাঁরা এটা তলিয়ে দেখেন না যে ওই সব দেশের মানুষের আয় আর আমাদের দেশের মানুষের আয়ের পার্থক্য কত। কর্তাব্যক্তিদের এহেন কথাবার্তায় মুনাফাখোরেরা অধিকতর উৎসাহী হয়, নির্ভয়ে পণ্যমূল্য বাড়াতে থাকে। ফলে অবস্থা থাকে তথৈবচ।

সংযমের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধির চেষ্টায় ব্রতী হওয়াই রমজানের শিক্ষা। কিন্তু সে শিক্ষা অনেকেই আত্মস্থ করে না। সংযমী হওয়ার পরিবর্তে তারা অসংযমী কারবারে লিপ্ত হয়। আর তাই রোজার মাসেও সমাজে ঘটতে দেখা যায় অনৈতিক ও অমানবিক সব ঘটনা। ধর্মীয় অনুশাসনকে যত দিন মানুষ আত্মস্থ না করবে, তত দিন এসব অনাচার ঘটতেই থাকবে।

লেখক: সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ