হোম > ছাপা সংস্করণ

ভালো থাকুক বাংলাদেশ

অজয় দাশগুপ্ত

আমি তখন ১২ বছরের বালক। চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লার মোড়ে দাঁড়িয়ে। ভোরের সূর্য তখন গনগনে হয়ে উঠছে। এখনকার চট্টগ্রাম আর তখনকার চট্টগ্রামে দুস্তর ব্যবধান। আন্দরকিল্লা তখন শহরের প্রাণকেন্দ্র। একপাশে জামে মসজিদ। আরেক পাশে নবাব সিরাজউদ্দৌলার নামে সড়ক। সেই সড়কের অপর প্রান্ত থেকে ঘন ঘন মিছিল আসছিল। ছাত্র-যুবক-তরুণ-তরুণীদের সেই মিছিলে সবাই উচ্চকিত স্লোগান আর বজ্রনিনাদে ধ্বনি তুলছিল—জয় বাংলা। 

আমি বলছি, একাত্তরের কথা। সেই যে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি আমাদের কানে অমৃত ঢেলে দিয়েছিল, তার প্রমাণ মিলল নয় মাস পর। তখন সারা দেশে ‘জয় বাংলা’ পরিণত হয়েছিল জয়ধ্বনিতে। একসময় সাহস আর শক্তির প্রতীক হয়ে উঠল এই স্লোগান। আজ ৫৩ বছর পর বহুল ব্যবহারে দীর্ণ স্বার্থপরতায় ক্লান্ত সুবিধাবাদের কণ্ঠে ধ্বনিত হতে হতে এটি তার মর্যাদা হারিয়ে ফেলেছে প্রায়। হয়তো সে কারণেই তরুণ প্রজন্মের মাঝে এখন আর তা পুলক জাগায় না।

কী আশ্চর্য! যে স্লোগান বা ধ্বনি আমরা গালাগালি অর্থে ব্যবহার করতাম, ঘৃণাসহকারে উচ্চারিত হতো, সেই ‘রাজাকার’ ফিরে এসেছে। যারা রাজাকার তারাও ‘রাজাকার’ শব্দটি বলতে কুণ্ঠিত ছিল। মনে রাখতে হবে, ইতিহাস লেখেন বিজয়ীরা। যেকোনো যুদ্ধেই দুটি দল থাকে। শ্রীকৃষ্ণ না থাকলে আর মহাভারতের যুদ্ধে কৌরবেরা জয়ী হলে পাণ্ডব বা অর্জুন কি বীর বলে গণ্য হতেন? বিশ্বযুদ্ধে যদি হিটলার জিতে যেতেন, আমরা কি আজকের ইতিহাসকে ইতিহাস বলে জানতাম? তখন আমাদের মনে হতো হিটলারই ছিল সর্বজন মান্য এক বীর। তেমনি একাত্তর সালে বাঙালিরা হেরে গেলে, পাকিস্তানিরা জয়ী হলে ইতিহাসে আমরা হতাম ‘গাদ্দার’! আমরা যে তাদের চোখে গাদ্দার, তার প্রমাণ এখনো আছে। আমাদের বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের কবর বহুদিন ছিল পাকিস্তানে। তারা সেই কবরে লিখে রেখেছিল, এখানে শায়িত আছে এক ‘গাদ্দার’ বা বেইমান। 

আমরা জিতেছি আর স্বাধীন হয়েছি বলেই মুক্তিযোদ্ধা আর মুক্তিযুদ্ধ সম্মান পেয়েছে। এই সম্মানের ধারাবাহিকতা কেবল একটি দল বা সরকারের কাজ হতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ। যে যুদ্ধে বাংলাদেশের সব মানুষেরই ভূমিকা ছিল। আমরা আমজনতার দলে। আমার বাবা ছিলেন সাধারণ একজন ব্যাংকার। পাঁচ সন্তান ফেলে রেখে যুদ্ধে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি ছিল না তাঁর। কিন্তু যে অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট আর যন্ত্রণা সহ্য করে আমরা সীমান্ত পাড়ি দিয়েছিলাম, তা কোনো যুদ্ধের চেয়ে কম কিছু না। শুধু কি তাই? সে সময় আমাদের কম করে হলেও একাধিকবার মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়ানোর মতো পরিবেশে পড়তে হয়েছিল। দেশের ভেতরে-বাইরে এমন অজস্র মুক্তিযোদ্ধা বা পীড়িতদের আমরা ধীরে ধীরে ‘আউট’ করে দিয়েছি। এর জন্য দায়ী সমাজের নিয়ন্ত্রকেরা। তারা কোটা আর অকোটার ভেতর দিয়ে এমন এক পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছে, যেখানে আজ ভাই ভাইয়ের দুশমন।

মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযোদ্ধা আমাদের গর্ব। তাঁদের লড়াই-অবদানের তুলনা হয় না। তাঁরা দেশ এনে না দিলে কী হতো সবাই জানে। কিন্তু ৫৩ বছর পর যখন তরুণ-তরুণীরা ‘রাজাকার’ বলে মাঠে নামে বা তাদের রাগ-অভিমান এভাবে তাদের মাঠে নামায়, আমরা কি বলব না যে এ আমাদের ভুল? আমাদের পাপের কারণে আজ এই দশা? বাংলাদেশ একসময় প্রগতিশীলদের হাতের বাইরে চলে গিয়েছিল। যৌবনে আমরা মনে করতাম বিরোধী দল হয়েই দিন কাটাবে আওয়ামী লীগ। শুধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আর মুক্তিযুদ্ধের কারণেই মানুষ তাদের প্রতি মনোযোগী হতো। জামায়াত-শিবিরের সর্বত্রগামী কানেকশন আর বিএনপির দাপটের পরও এ দুই কারণে আবারও আওয়ামী লীগ দেশ শাসনে ফিরে আসে। এই শাসন যে ২০০৯ থেকে এত দীর্ঘ হবে, সেটা হয়তো দলও ভাবেনি। এর নাম হওয়া উচিত ছিল দেশ শাসনের সুবর্ণ সুযোগ। সেই সুযোগ যে পুরোপুরি ব্যর্থ, তা বলব না। কিন্তু তা আদর্শিকভাবে সার্থকও হয়নি।

উন্নয়ন হয়েছে। রাস্তাঘাট, উড়ালসড়ক, মেট্রোরেল—বহু শানদার উন্নয়ন আমরা দেখেছি। একটি আধুনিক রাষ্ট্র বা দেশের অবকাঠামো হয়তো আমরা পেয়েছিও। কিন্তু মনোজগৎ বা যুবমানস বলে যে বিষয়, তা নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না। আমি বহুবার এ কথা লিখেছি ও বলেছি, পাশের বঙ্গে কমিউনিস্টরা ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে রাজত্ব করতেন। তাঁরা আমাদের এসব নেতা-উপনেতাদের চেয়ে হাজার গুণ মেধাবী আর নিষ্ঠাবান ছিলেন। সেসব মেধাবীও জনগণের ভোটের চাপে শাসন ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। আজ এমন হাল যে তাঁদের দুরবিন দিয়েও খুঁজে পাওয়া যায় না। শাসন যত দীর্ঘ হয়, মানুষ ততই হাঁপিয়ে ওঠে। তাদের ক্লান্তি আর হতাশা ততই বাড়তে থাকে। এ জন্য তাদের কথা শুনতে হয়। তাদের মনের ভাষা বুঝতে হয়। আর একটা সমস্যা হচ্ছে, সবকিছু এককেন্দ্রিক করে ফেলা। বাংলাদেশে এ দুই সমস্যা প্রকট। প্রধানমন্ত্রী ব্যতীত কোথাও কোনো সমাধান মেলে না! তিনিও তো একজন মানুষ। সব সময় সঠিক কথা বা সমাধান দিতে পারা সম্ভব না-ও হতে পারে। সে কারণেই একটি কথার রেশ ধরে শিক্ষার্থীরা পথে নেমেছিল। প্রাণ হারায় আমাদের কোমলমতি সন্তানেরা।

দেশে-বিদেশে এ ঘটনা যে কুপ্রভাব ফেলেছে, তা সহজে নিরাময় হওয়ার মতো নয়। আরেকটা বিষয় পরিষ্কার, পদ-পদক আর অর্থপ্রত্যাশী স্তাবকেরা খারাপ সময় পাশে থাকে না। সেটা আমরা পঁচাত্তর থেকে আজ পর্যন্ত বারবার দেখে আসছি। তবু এরাই ঘিরে থাকে। এবারের দুর্যোগে তাদের কেউ দাঁড়ায়নি। যারা মার খেয়েছে, তারা সাধারণ। আর যারা কোটা আন্দোলনের জন্য মারা গেছে, তারা আরও সাধারণ। তাদের ভেতর কে ঢুকে আছে আর কে ঢুকে নেই, এসব বলে পার পাওয়া যাবে না। ঘটনা বলে দিচ্ছে কাচের স্বর্গে বসবাস করে কেউ নিরাপদ থাকে না। আর সম্মান ভেঙে পড়তে সময় লাগে না। এ জন্যই সুশাসনের বিকল্প নেই। দুর্নীতি বন্ধের বিকল্প নেই।

আমরা যারা প্রবীণ বা প্রবীণ হওয়ার পথে, আমাদের মনে একটা প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে—কার কাছে আমরা বিচার চাইব? যে দেশে বঙ্গবন্ধুর মতো নেতা ছিলেন, যে সমাজে হাজারো জ্ঞানী-গুণী বিবেকবান বাঙালি আছেন, সে দেশে এমন ক্রাইসিস হয় কী করে? কী করে অস্তিত্ব নিয়ে টানাটানি হয়? বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মকে দোষারোপ করার আগে এগুলোর জবাব পাওয়া জরুরি। শুরুতেই লিখেছি অন্ধকার এক দিনে ঘনীভূত হয়নি। সেই অন্ধকারকে যারা লালন করেছিলেন, আজ তাঁরাই ভুগবেন। তা ছাড়া, কোনো চাওয়া-পাওয়া না মিললে সেটা নিয়ে কথা বলা মানেই কি দেশদ্রোহিতা? এসব প্রশ্ন আর উত্তরের ভেতরেই ভবিষ্যতের শান্তি লুকিয়ে। বাংলাদেশ তুমি ভালো থেকো। থেকো রক্তপাতহীন শান্তিতে।

লেখক: অজয় দাশগুপ্ত
অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী কলামিস্ট

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ