হোম > ছাপা সংস্করণ

বঞ্চনা ও বৈষম্যে ভরা চরের জীবন

আবু তাহের খান , লেখক ও প্রাবন্ধিক

১৬টি উপজেলার মোট জনসংখ্যা কাগজে-কলমে ২৪ দশমিক ৫৮ লাখ, হালনাগাদ হিসাব অনুযায়ী যা ৩৫ লাখের কাছাকাছি হবে বলেই মনে করা হয়। আর তাদের গড় মাথাপিছু আয়ও সাক্ষরতার হারের মতোই অতিকরুণ ও মানবেতর পর্যায়ের।

আকস্মিক ঘূর্ণিঝড়ে জাহাজডুবির পর সাগরের পানিতে ভাসতে ভাসতে ড্যানিয়েল ডিফোর রবিনসন ক্রুশো শেষ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিলেন জনমানবহীন এক নির্জন দ্বীপে, যেখানে তাকে একাকী কাটাতে হয়েছিল দীর্ঘ ২৮ বছর। এ সময়ে পৃথিবীর মূল জনপদের সঙ্গে তার কোনো ধরনের সংস্রব ও যোগাযোগ কোনোটাই ছিল না। নেত্রকোনার খালিয়াজুরী উপজেলার বর্তমান মানুষদের পূর্বসূরিরা কখন কী অবস্থায় গিয়ে ওই নির্জন চরে প্রথম আশ্রয় নিয়েছিলেন, আমরা তা খুব সুনির্দিষ্টভাবে জানি না। তবে এটা জানি যে ড্যানিয়েল ডিফোর মতো একাকী না হলেও দলবদ্ধভাবে তার মতোই বাংলাদেশের মূল জনপদ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন অবস্থায় তাঁরা সেখানে জীবনযাপন করছেন কয়েক শ বছর ধরে। পার্থক্য একটাই, দীর্ঘ কষ্টভোগের পরে হলেও ডিফো মূল জনপদে ফিরে যেতে পেরেছিল। কিন্তু খালিয়াজুরীর মানুষদের বিচ্ছিন্নতা বছরের পর বছর ধরে প্রায় একইভাবে অব্যাহত আছে। অমিল আরও আছে। শত কষ্টের মধ্যেও ডিফো প্রতিমুহূর্তে মূল জনপদে ফিরে যাওয়ার আশা রাখলেও খালিয়াজুরীর মানুষেরা ওই চরের বিচ্ছিন্নতাকেই জীবনের নিয়তি বলে মেনে নিয়েছেন।

চরের মানুষের অমানবিক জীবন-জীবিকা নিয়ে মাস ছয়েক আগে একটি জাতীয় দৈনিকে মর্মস্পর্শী এক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। রাজধানীতে বসে আমরা যখন ক্রমবর্ধমান ও নানামাত্রিক বৈষম্য নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছি, তখন সেই উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার পরিধিতে তাৎক্ষণিকভাবে যাদের গণ্য করি, তাদের মধ্যে খালিয়াজুরীর মতো চরগুলোতে বসবাসকারী মানুষের মুখমণ্ডল কি আদৌ দেখতে পাই? সততার সঙ্গে বললে স্বীকার করতেই হবে যে অধিকাংশ সময় ও ক্ষেত্রে আমরা তা দেখি না। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে এই, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এ দেশে ক্রমেই তীব্র হয়ে ওঠা বৈষম্যের পরিধিতে এ চরের মানুষেরাই আছে সবার আগে। এরা দেশের প্রান্তিক মানুষের মধ্যেও অধিকতর প্রান্তিক, বঞ্চনার শিকারে পরিণত হওয়া মানুষদের মধ্যেও অধিকতর বঞ্চিত, যাদের সঙ্গে এ দেশের সাঁওতাল ও অন্যান্য কতিপয় নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর মানুষদেরই কেবল তুলনা করা যেতে পারে।

সরকারি প্রজ্ঞাপনে দেশের মোট ১৬টি উপজেলাকে দুর্গম চর এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং সেগুলো হচ্ছে নেত্রকোনার খালিয়াজুরী; কিশোরগঞ্জের ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম; চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ; কক্সবাজারের কুতুবদিয়া; নোয়াখালীর হাতিয়া; সিরাজগঞ্জের চৌহালী; কুড়িগ্রামের রৌমারী ও চর রাজীবপুর; পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী; ভোলার মনপুরা; সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা, শাল্লা, দোয়ারাবাজার এবং হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ। তবে এ উপজেলাগুলোকে দুর্গম চিহ্নিত করার মূল উদ্দেশ্য কিন্তু মোটেও সেখানকার জনগণকে দুর্গম বিচ্ছিন্নতার কবল থেকে মুক্ত করা নয়। ওই সব এলাকায় যে রাজকর্মচারীরা দায়িত্ব পালন করতে যান বা যাবেন, দুর্গমতার কারণে সেখানে তাঁদের যে কষ্ট হবে, সেই কষ্টের কিছুটা হলেও কীভাবে লাঘব বা উপশম করা যায়, সে উপায় খুঁজে পাওয়ার লক্ষ্যে। এর মধ্যে একটি উপায় হচ্ছে দুর্গম এলাকায় দায়িত্ব পালনের কারণে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য বিশেষ ভাতার ব্যবস্থা করা। কিন্তু একই যুক্তিতে দুর্গম এলাকার সাধারণ জনগণের জন্য বিশেষ কী উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে বা হবে, সে প্রশ্নের উত্তর মোটেও আশাব্যঞ্জক নয়, যার কিছুটা প্রমাণ পাওয়া যাবে ওপরের বর্ণনা ও নিচের তথ্য থেকে।

সরকারি হিসাব অনুযায়ী, দেশে প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে সাক্ষরতার হার ৭৪ দশমিক ৯ শতাংশ। আর এর বিপরীতে উল্লিখিত ১৬টি চর-উপজেলার মধ্যকার ৩টিতে (মিঠামইন, ইটনা ও রাজীবপুর) তা ১৬ শতাংশের নিচে, ৯টিতে (ধর্মপাশা, মনপুরা, খালিয়াজুরী, আজমিরীগঞ্জ, শাল্লা, চৌহালী, কুতুবদিয়া, রৌমারী ও হাতিয়া) ২০-২৫ শতাংশের মধ্যে এবং বাকি ৪টিতে ৩০-৫২ শতাংশের মধ্যে। এই ১৬টি উপজেলার মোট জনসংখ্যা কাগজে-কলমে ২৪ দশমিক ৫৮ লাখ, হালনাগাদ হিসাব অনুযায়ী যা ৩৫ লাখের কাছাকাছি হবে বলেই মনে করা হয়। আর তাদের গড় মাথাপিছু আয়ও সাক্ষরতার হারের মতোই অতিকরুণ ও মানবেতর পর্যায়ের। অথচ তাদের গায়েও আমরা ২ হাজার ৫৯১ ডলার মাথাপিছু আয়ের তকমা পরিয়ে দিচ্ছি। কী নিষ্ঠুর নির্মম উপহাস!

আমরা কি নির্মোহ দৃষ্টিকোণ থেকে একবারের জন্য হলেও ভেবে দেখার চেষ্টা করতে পারি, এই ৩৫ লাখ মানুষ স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিকে কীভাবে উদ্‌যাপন করেছে? ‘সকলের জন্য শিক্ষা’র মিথ্যা বুলি কবে তাদের জন্য সত্য বলে প্রমাণিত হবে? কবে সেখানকার একজন প্রসূতি মা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে নিরাপদে সন্তান প্রসবের সুযোগ পাবেন? কবে তাঁরা ইঞ্জিনচালিত বাহনে করে দেশের মূল জনপদে যাতায়াত করতে পারবেন? কবে তাঁরা জানতে পারবেন যে তাঁদের উন্নয়নের জন্য দাতাদের কাছ থেকে সাহায্য গ্রহণের নিমিত্তে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকেরা দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াচ্ছেন এবং তাঁদের নিরাপত্তার স্বার্থে উন্নত সমরাস্ত্র কেনার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলো বাংলাদেশকে ক্রমাগত প্ররোচনা জোগাচ্ছে।

চরের মানুষের জীবন-জীবিকার উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৯৪ সাল থেকে সরকার ‘চর উন্নয়ন ও বন্দোবস্তদান’ নামে পাঁচ পর্যায়ের একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করে আসছে, যেখানে বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের যুক্ততা রয়েছে। ওই প্রকল্পের আওতায় দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে কাজ করার পরও সেখানকার অধিকাংশ উপজেলায় সাক্ষরতার হার ১৫-২৫ শতাংশ, বিদ্যালয়ে যাওয়ার পরিবর্তে পশুচারণেই ওখানকার সিংহভাগ শিশুর সংশ্লিষ্টতা, প্রশিক্ষিত ধাই বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পরিবর্তে পরিবারের নিজ দায়িত্বেই অধিকাংশ প্রসূতির সন্তান জন্মদান, খড় বা ভাঙা টিনের চালার নিচে নিত্যদিনের জীবনযাপন, যাতায়াত বলতে চিরন্তন পদব্রজ বা নৌকা, জীবিকা বলতে ভূমিমালিকের জমিতে কামলা খাটা, আর ভূমির অধিকার বলতে কতিপয় প্রভাবশালী ব্যক্তির মালিকানায় গড়ে ওঠা ভূমিব্যবস্থার অধীনে ভূমিহীন বা প্রান্তিক কৃষকের দীর্ঘ সারি। তো, এই যদি হয় ২৮ বছরের সরকারি প্রচেষ্টার ফলাফল, তাহলে মানতেই হবে যে তারা সঠিক কার্যক্রম হাতে নিতে পারেননি অথবা তা নিয়ে থাকলেও সেসবের বাস্তবায়ন যথাযথভাবে হয়নি। যতটুকু জানা যায়, অভিযোগ দুই ক্ষেত্রেই রয়েছে।

সংবিধানের ১৬ অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘নগর ও গ্রামাঞ্চলের জীবনযাত্রার মানের বৈষম্য ক্রমাগতভাবে দূর করিবার উদ্দেশ্য কৃষিবিপ্লবের বিকাশ এবং শিক্ষা, যোগাযোগব্যবস্থা ও জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলের আমূল রূপান্তর সাধনের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’ এখন প্রশ্ন হচ্ছে, উল্লিখিত রূপান্তর সাধনের কাজটি ‘আমূল’ না হোক, মোটামুটি একটি সন্তোষজনক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য গত ৫০ বছরও কি যথেষ্ট ছিল না? চরভিত্তিক উপজেলাগুলোর বর্তমান করুণ অবস্থার দিকে তাকিয়ে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকেরা এ প্রশ্নের কী জবাব দেবেন?

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ