হোম > ছাপা সংস্করণ

আঙুল চোষার নেশায় বুঁদ

অরুণ কর্মকার

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সরকারের মন্ত্রিপরিষদের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ওবায়দুল কাদের একাধিক সভায় বলেছেন, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে এক রাতের মধ্যে আওয়ামী লীগকে শেষ করে দেবে। তাঁর এ কথার অর্থ এটাই দাঁড়ায় যে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় না থাকলে নিজেদের রক্ষা করার ক্ষমতাটুকুও থাকবে না। রাষ্ট্রক্ষমতাহীন আওয়ামী লীগ মানে কোনো রাজনৈতিক শক্তিই নয়। ক্ষমতা হারালে এক রাতের মধ্যে তার মূলোৎপাটন সম্ভব।

আরেকটি অর্থ হতে পারে, বিএনপি যখন শেষ করার কাজ শুরু করবে, তখন আওয়ামী লীগ যথেষ্ট শক্তি-সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও বসে বসে আঙুল চুষবে। অবশ্য গত ১৪ বছরে আওয়ামী লীগের কিছু নেতা-কর্মীর (তাঁদের সংখ্যা মোটেই কম নয়) আঙুলে এত বেশি ঘৃত-মধু উঠেছে যে তা চুষে চুষে শেষ করতে পারছেন না। আঙুল চোষার নেশায় তাঁরা বুঁদ হয়ে আছেন। সুতরাং দলের বিপর্যয় দেখলেও চোষার নেশা তাঁদের ভাঙবে না। তাই আগেভাগেই যাতে সেই নেশা ভাঙে, সে জন্যই দলের সাধারণ সম্পাদক ওই শঙ্কার বাণী দিয়েছেন।

ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যের অর্থ যেটাই হোক, বাস্তবে অবস্থাটা কী। ‘নিজের খেয়ে নৌকা’র জন্য যারা সারা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন, তাঁদের আঙুলে তো নেশাগ্রস্ত হয়ে চোষার মতো তেমন কিছু লাগেনি। তাঁরা তো আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকলেই শুধু দলের শক্তি নন। তা ছাড়া আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি তো এমন কোনো রাজনৈতিক দল নয়, যারা ক্ষমতা ছাড়া জনবিচ্ছিন্ন; বরং জনগণের মনের গভীরে তাদের অবস্থান। সেখান থেকে কোনো পরিস্থিতি কি পারে তাদের মূলোৎপাটন করতে? ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মতো নেতাকে সপরিবারে হত্যা করেও কি আওয়ামী লীগকে শেষ করে দেওয়া গেছে? ২০০১ সালেও তো আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল। তাতে কি আওয়ামী লীগ শেষ হয়ে গেছে?

এসব কথা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আমার কিংবা অন্য যে কারও চেয়েই ভালো জানেন। তারপরও কেন বলে বেড়াচ্ছেন ক্ষমতা হারালে বিএনপি তাঁদের শেষ করে দেবে। তা-ও আবার এক রাতের মধ্যে! বলার কারণ নিশ্চয়ই আছে। কী হতে পারে সেই কারণ?

প্রথম এবং প্রধান কারণ হতে পারে, দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের জাগ্রত করা। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ব্যক্তিগত, দলীয় ও স্থানীয় সব বিবাদ-বিসংবাদ ঘুচিয়ে, সব ধরনের স্বার্থের দ্বন্দ্ব ভুলে গিয়ে দলের স্বার্থে সর্বশক্তি নিয়ে একযোগে দাঁড়ানোর জন্য পুরো দলকে প্রস্তুত করা। দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে এ কাজটি তাঁর এক নম্বর দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। তবে বিষয়টি তিনি যে ভাষায় উপস্থাপন করেছেন তা যেমন আওয়ামী লীগের বিরোধীপক্ষকে অনেক বেশি চাঙা করতে পারে, তেমনি নিজ দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে সৃষ্টি করতে পারে হতাশা। সাধারণ সম্পাদকের শঙ্কাবাণী থেকে নেতা-কর্মীদের ধারণা হতেই পারে যে অবস্থা মোটেই ভালো নয়। সেই হতাশা থেকে কেউ কেউ, ওবায়দুল কাদেরের ভাষায় যাঁরা কাউয়া, গত ১৪ বছরে দলের ছত্রচ্ছায়ায় থেকে যাঁরা স্বার্থান্বেষী হয়ে উঠেছেন এবং যাঁদের আঙুলে প্রচুর পরিমাণে ঘৃত-মধু উঠেছে, তাঁরা আগেভাগেই সটকে পড়তে পারেন। সেটা আখেরে দলের জন্য কল্যাণকর হলেও নির্বাচনের আগে ভালো হবে কি?

এই যে দলের ভালো-মন্দের বিষয়, একজন পোড় খাওয়া নেতা হিসেবে এ কথাও ওবায়দুল কাদেরের জানা। তারপরও তিনি ক্ষমতায় যেতে না পারলে শেষ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কার কথা বলেছেন। কারণ তিনি এ কথাও জানেন যে আওয়ামী লীগ এখন আর আগের সেই আওয়ামী লীগ নেই। থাকা সম্ভবও নয়। কেননা, আগের মতো এখন তো দলের আলাদা কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিই নেই, যার মাধ্যমে প্রতিনিয়ত জনগণের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত থাকা যায়। অবশ্য অন্য কোনো রাজনৈতিক দলেরও তা নেই। সে আলাদা প্রসঙ্গ। আওয়ামী লীগের প্রায় সকল পর্যায়ে স্বার্থের তীব্র দ্বন্দ্ব বিদ্যমান। সেই দ্বন্দ্ব থেকে নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব, গ্রুপিং। দলের মধ্যে রাজনীতির চর্চা নেই বললেই চলে।

যেটুকু আছে তা-ও অত্যন্ত সীমিত পরিসরে। দলের ‘র‍্যাঙ্ক অ্যান্ড ফাইল’ তার ধার ধারে না। তাঁদের রাজনীতির চর্চা বলতে দলীয় কর্মসূচিতে সদলবলে যোগদান এবং প্রয়োজনে সংঘাত-সংঘর্ষে অংশ নেওয়াই সবকিছু।

তবে তাঁরা অন্য অনেক কিছুই করেন। তাঁরা দলের পরিচয়ে ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত আয়-উপার্জন করেন। তাঁরা তদবির-বাণিজ্য, ঠিকাদারি প্রভৃতি করেন। অনেকে আরও বড় কিছুও করেন। জায়গা কিনে বাড়ি তৈরি করে ফ্ল্যাট বিক্রি করেন, যার অধিকাংশ ক্ষেত্রে থাকে প্রতারণা ও অবৈধ প্রভাব খাটানোর অভিযোগ। সরকারি জায়গা দখল করে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান করেন। ঘর তুলে ভাড়া দেন। যেকোনো এলাকায় যে কারও নতুন কোনো ভবন নির্মাণে তাঁদের কিছু ভূমিকা রাখতে দিতে হয়। এরও নিচের একটি গোষ্ঠী রয়েছে যাঁদের যাতায়াত বেশি দেখা যায় এলাকার বাজার, দোকান, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে। ভ্যানে করে সবজি বিক্রি করেন যাঁরা, তাঁরাও তাঁদের আওতাধীন। তাই বলা যায় রাজনীতিবহির্ভূত এবং দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার মতো কাজের তাঁদের কোনো অভাব নেই। দলের সাধারণ সম্পাদক এসবই জানেন। এসব কারণে একেবারে গোঁড়া সমর্থক ছাড়া সাধারণ মানুষের কাছে দলের ভাবমূর্তি কেমন তা-ও ওবায়দুল কাদেরের অজানা নয়।

নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের কাঁধে সবচেয়ে ভারী বোঝা হয়ে দেখা দিয়েছে এগুলো। বলতে গেলে দলই হয়ে উঠেছে দলের বড় বোঝা। অথচ সেই দলকেই নামাতে হবে নির্বাচনের ময়দানে। এবারের নির্বাচনে হয়তো পুরোপুরি নির্ভরও করতে হবে দলের ওপরই। কাজেই দলকে প্রস্তুত করার জন্যই তিনি একেবারে শেষ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কার কথা বলে থাকতে পারেন। কিন্তু তাঁর এই বক্তব্য দলের মধ্যে এমন একটি বিপরীত বার্তাও বোধ হয় দিয়েছে যে আগামী নির্বাচন আওয়ামী লীগের জন্য সব হারানোর নির্বাচনও হতে পারে। এই বার্তা দলকে এককাট্টা করতে কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখবে, সে বিষয়ে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ আছে।

বিএনপি ক্ষমতায় এলে এক রাতের মধ্যে আওয়ামী লীগকে শেষ করে দেবে কথাটি ওবায়দুল কাদের আরও একটি কারণে বলে থাকতে পারেন। সেটি হলো, বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে নানামুখী তৎপরতায় লিপ্ত বিদেশি শক্তিকে বিএনপির প্রতিহিংসাপরায়ণতা সম্পর্কে একটি বার্তা দেওয়া। এ কথা ঠিক যে এর আগে বিভিন্ন সময় নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বিএনপি এবং তার সঙ্গে জামায়াত হিংসাত্মক ঘটনাবলি ঘটিয়েছে। এ ক্ষেত্রে ২০০১ সালের নির্বাচন-পরবর্তী দাঙ্গার কথা ভুলে থাকার ভান না করলে কারোরই ভোলার কথা নয়। দেশি-বিদেশি নির্বিশেষে কারোরই না।

কিন্তু সেই দাঙ্গার শিকার হয়েছিল মূলত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী। আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংক হিসেবে আখ্যায়িত করে তাদের ওপর হামলা-নির্যাতন চালানো হয়েছিল। নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মীও তাঁদের প্রতিহিংসাপরায়ণতার শিকার হয়েছিলেন। আগামী দিনে যে তেমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না, তা-ও বলা যাবে না। কিন্তু বিদেশিদের সেই কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য দলীয় সভায় এক রাতের মধ্যে আওয়ামী লীগকে শেষ করে দেওয়ার মতো বক্তব্য দেওয়া কী সমীচীন হয়েছে। সেই বার্তা দেওয়ার থাকলে তো অন্যভাবেও দেওয়া যেত বা যায়। যদিও এই দ্বিতীয় কারণে ওবায়দুল কাদের বক্তব্যটি দিয়েছেন—এমন সম্ভাবনা কম। দলকে সতর্ক করাই হয়তো ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। তবে এ ধরনের বক্তব্য দলের মধ্যে কতটা গ্রহণযোগ্য হয়েছে, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।

অরুণ কর্মকার, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক 

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ