১৭ ও ১৮ ডিসেম্বর ২০২১ তির্যক নাট্যদলের আয়োজনে চট্টগ্রাম গিয়েছিলাম। দুই দিনব্যাপী এই আয়োজনে সারা দেশের ৫০ জন সৃজনশীল নাট্যকর্মী একত্র হয়েছিলেন। উদ্দেশ্য মুক্তিযুদ্ধের ফসল নাটক নিয়ে দুই দিনব্যাপী সৃজনের আলাপন এবং সেই সঙ্গে চট্টগ্রামের নাট্যনির্দেশক, অভিনেতা, সংগঠক আহমদ ইকবাল হায়দারের একুশে পদক প্রাপ্তির অর্জনকে ভাগ করে নেওয়া। বাংলাদেশে যা কিছু হয় তা ঢাকাকেন্দ্রিক। ঢাকার বাইরের নাট্যকর্মীরা অনেক বড় বড় আয়োজন, উৎসব করলেও ঢাকায় বা জাতীয়ভাবে সংবাদে জায়গা পান না, স্বীকৃতিও পান না। নাটকের ক্ষেত্রে ঢাকার বাইরের নাট্যকর্মীরা সবকিছু থেকেই বঞ্চিত হন। প্রথমবার বরিশাল থেকে একুশে পদক পেয়েছিলেন নাটকের ক্ষেত্রে নিখিল সেন এবং দ্বিতীয়বার পেলেন চট্টগ্রামের আহমদ ইকবাল হায়দার।
প্রথম দিন সৃজনের আলাপন শীর্ষক আলোচনায় নাট্যকর্মীরা তাঁদের সৃজনশীল সংকট এবং সংগ্রামের কথা তুলে ধরেন। আলোচনা শেষে এবং মাঝখানে বারবার সংকটের কথা উঠে আসে। যে সংকটগুলোর সুরাহা সরকার ইচ্ছে করলেই করতে পারে।
গত ৪৯ বছর নাট্যকর্মীরা একেবারে নির্ভেজালভাবে নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়েছেন। কেউ কেউ অবশ্য থিয়েটার বিক্রি করে ব্যবসা-বাণিজ্যে ফুলে-ফেঁপে উঠেছেন। অযোগ্য লোকদের হাতে বিভিন্ন সাংগঠনিক দায়িত্ব পড়েছে। তারা বিকাশের পথকে রোধ করেছে। আর নাটকের বিষয়বস্তু আলোচনায় বারবার এসেছে রাজনৈতিক সমস্যা। যে পথনাটক আন্দোলনের হাতিয়ার ছিল, তা এখন নিষ্প্রভ। এখন যেন আর সংকট নেই, তাই পথনাটকেরও প্রয়োজন নেই। পথের নাটকের কাজই হচ্ছে রাজনৈতিক পালাবদলে ভূমিকা রাখা। কথাটি আদৌ সত্যি নয়।
দেশে দুর্নীতি চরম আকার ধারণ করেছে, দ্রব্যমূল্য মধ্যবিত্তের নাভিশ্বাস তুলে ফেলেছে। কোভিড-১৯-এর সময়ে যে দুঃসহ, অমানবিক, দুর্নীতি ঘটেছে, তার বিচারের জন্য জনগণ সরকারের দিকে চেয়ে থেকেছে। সমস্যাটি সামাজিক সমস্যায় পরিণত হয়নি। নাটক এ কাজগুলো করতে পারেনি। সমাজকে সচেতন করে কাজের প্রতি ঘৃণার উদ্রেক করতে পারে। সে কাজটি এখন অনুপস্থিত। রাজনৈতিক সমস্যায় যে জনগণ প্রতিমুহূর্তে পীড়িত হচ্ছে, সেই সমস্যাগুলো নাটকে আসছে না। নাটক শেকড়ের কথা বলছে, সেখানে আখ্যান রচিত হচ্ছে কিন্তু মানুষের প্রাণের কথা উচ্চারিত না হলে, দর্শক কেন নাটক দেখতে আসবে। এখনো যেসব নাটকে জীবনের কথা আসে, সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহের কথা আসে, সেই নাটকগুলো দর্শকনন্দিত হয়, মানুষ নাটক দেখে নতুন ভাবনায় উজ্জীবিত হয়।
নাটকের যে প্রবল শক্তি তা পরের দিন কবি ওমর কায়সারের বরণের কথকতায় স্পষ্ট হয়ে উঠল। তিনি গান্ধীর উদাহরণ দিয়েছেন–যে চরকার পাশে গান্ধীর ছবিটি দেখা যায়, সেই গান্ধীর চরিত্রকে জীবন্ত করার জন্য একজন অভিনেতার প্রয়োজন হয়, তিনি বেন কিংসলে। আবার আহমদ ইকবাল হায়দার যখন মঞ্চে দাঁড়িয়ে অসহ্য যন্ত্রণায় কাতর হন, সফোক্লিসের ইডিপাস শক্তিটি তখন প্রবল অনুভব করা যায়। মানুষ সেই চরিত্রকে দেখে যন্ত্রণায় পীড়িত হয়, তার অনুভবের মধ্যে প্রবিষ্ট হয় একজন দুর্ভাগা মানুষের। নাটকের শক্তি সেখানেই। ১৯৩০ সালে নবাব সিরাজ উদদৌলা নাটকে একজন অভিনেতা যখন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবের চরিত্রে মঞ্চে অথবা যাত্রার প্যান্ডেলে আবির্ভূত হন, দর্শক তখন তাই দেখে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হন।
প্রায় ৫০ বছরে আমাদের নাট্যমঞ্চে ও পথনাটকে অনেক চরিত্র মানুষকে শুধু বিমোহিত করেনি, অনুপ্রাণিত করেছে। বোঝা যায়, নাটকের শক্তিটা কোথায়? জীবনের রূঢ় সত্যকে যখন সাহসের সঙ্গে কোনো নাটক প্রকাশ করে, তখনই চিন্তার এক নবদিগন্ত সৃষ্টি হয়। এসব কথার মাঝে মলয় ভৌমিক বিশাল বাংলায় নাট্যচর্চার একটি খতিয়ান ও বিশ্লেষণ তুলে ধরেন। সেখানে মঞ্চনাটক প্রসারিত হয়ে পথনাটকের মুক্ত নাটকে রূপান্তর ঘটে। বিশাল বাংলার কার্যক্রমকে যখন তিনি তুলে ধরলেন, তখন মনে হয় ৫০ বছরে এ দেশের নাট্যকর্মীরা কত বিশাল কর্মকাণ্ড করেছেন। সেই বিশালতার কথা ভাবলে তার পেছনে কত কম পৃষ্ঠপোষকতা ছিল সরকারের। একেবারেই ছিল না বললে কোনো কোনো ক্ষেত্রে অত্যুক্তি হবে না, শুধু দর্শকের পৃষ্ঠপোষকতায় এত দূর এগিয়ে আসা।
৫০ বছরের সরকারি উদ্যাপনের জৌলুশ দেখে একেবারেই অনুমান করা ঠিক হবে না যে এমনি সরকারি অর্থের বিপুল ব্যয় দুদিনেই নিঃশেষিত হয়েছে। এই যে নাট্যকর্মীদের অসাম্য, জনগণের চোখে পড়েছে। আবার এ কথাও ঠিক, নাটকের লোকেরা চিরকালই শাসকগোষ্ঠীর চক্ষুঃশূল। তাঁরা প্রতিবাদী সেটাও পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক—এ দুটি ব্যবস্থায়ই শাসকের রক্তচক্ষু দেখেছে। যে কারণে ১৮৭৬ সালে ব্রিটিশ অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন চালু করেছিল। আজকের বাস্তবতায় অর্থ একটি বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। নাটক করতে গেলে অর্থ লাগে, নাটকের কলাকুশলীরা অর্থ না নিলেও আরও অনেক খরচ আছে। সেগুলোর দায় মেটাতেই হয়, যে কারণে অতীতে নাটকের লোকেরা স্ত্রীর গয়না থেকে শুরু করে ঘরবাড়ি বিক্রি করে সর্বস্বান্ত হয়েছেন।
চট্টগ্রামের থিয়েটার ইনস্টিটিউটে দুদিন কাটিয়ে নিজেকে খুব সুখী মনে হয়েছে। এত স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ, ভাববিনিময়, তর্কবিতর্ক এবং শিল্পীদের হৃদয়ের তাপ পেয়ে বারবারই একটা ভাবনা মনে এসেছে—থিয়েটার মানুষকে কত মুক্ত করে দেয়! মনে পড়ল, বহরমপুরের এক সেমিনারে একজন অভিনেত্রী বলে ফেললেন, ‘নাটক নারীকে মুক্তি দেয়।’ শুনে একটু অবাক হয়েছিলাম। পরে তিনি ব্যাখ্যা করলেন এভাবে: নারীর শৃঙ্খল সর্বত্র–পরিবারে, সমাজে ও রাষ্ট্রে।
কিন্তু এই নারীই যখন অভিনয় করেন, নিজেকে প্রকাশ করেন, দর্শক যখন তাঁর অভিনয়ে প্রভাবিত হন, তখন অভিনেত্রী তাঁর শক্তিকে অনুভব করতে পারেন। যে অনুভবটা সংসারে হয় না, মাতৃত্বে হয় না, স্বামীর কাছে হয় না অথচ নাটকে হয়, যখন তিনি সেই উত্তাপ ছড়াতে পারেন এবং নিজেও তা অনুভব করেন।
থিয়েটারে যাঁরা আসেন, তাঁরা কেমন হন? কবি ওমর কায়সারের ভাষায়, আহমদ ইকবাল হায়দারকে ব্যাখ্যা করার সময় তিনি বলেন, তাঁর নাট্যব্যক্তিত্ব হওয়ার পেছনের গল্পটা এই ঘুড়ি ওড়ানোর বালকের মতো। মা-বাবার আদরের লালিত বালকের ইচ্ছে হলো ছেলে ঘুড়ি ওড়াবে, বাবা পকেট থেকে টাকা বের করে বললেন, ‘যা, বাজার থেকে সব কিনে নিয়ে আয়।’ না, না এ রকম কোনো সহজপ্রাপ্যতা হায়দারের হয়ে ওঠার মধ্যে নেই। মাটি কেটে কেটে সে পাহাড় করেছে। থিয়েটার কোনো একার সাধনা নয়, এটা আমাদের আদি সমাজের সংস্কৃতির মতো-যূথবদ্ধ মানুষের কর্মযজ্ঞ, তাদের সংগ্রাম, অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম। এর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সহস্র রকমের সীমাবদ্ধতা, শত শত বাধার ভেতরে যূথবদ্ধতা, ঐক্য টিকিয়ে রাখা। আমাদের মতো সমাজে থিয়েটারের দল মানে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সাগরে ভাসমান এক একটি জাহাজ। সেই জাহাজকে সচল রাখতে ক্যাপ্টেনের যে কী অপরিসীম শ্রম, তা থিয়েটারের মানুষ ছাড়া আর কারও বোঝার উপায় নেই।
এত সব প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আমাদের দেশে থিয়েটারে কোনো পেশাদারত্ব গড়ে ওঠেনি। কিছুদিন আগেও থিয়েটার শেখার জন্য কোনো একাডেমি ছিল না। এখন বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে থিয়েটারের ডিপার্টমেন্ট হয়েছে। সেখানে অনার্স ও মাস্টার্সের ডিগ্রিও দেওয়া হয়। পাস করার পর তাঁদের অধিকাংশের আর থিয়েটার করা হয় না। জীবিকার জন্য দু-একজন হয়তো শিক্ষকতার চাকরি পান। বহুবার চেষ্টা করেছি স্কুল-কলেজে নাট্যশিক্ষা চালু করার। তাহলে চারুকলা থেকে পাস করা ছেলেরা যেমন স্কুলে ড্রয়িং শিক্ষকের চাকরি পান, তেমনি ড্রামা শিক্ষকেরও চাকরি হতো। উন্নত দেশগুলোয় এ ব্যবস্থা চালু আছে।
সরকারের শিক্ষা বিভাগ এ ব্যাপারে কানে ভালো করে তুলা দিয়েছে। অথচ ধর্মীয় শিক্ষায় সব রকমের সুযোগ-সুবিধা দিতে তারা ভীষণ উদার। দুর্ভাগ্য, দেশে পেশাদারত্ব নেই বলে থিয়েটারের লোকেদের জীবিকার জন্য অন্য একটি পেশায় কাজ করতে হয়। যদিও আহমদ ইকবাল হায়দারের মতো হাতে গোনা কয়েকজন সার্বক্ষণিক থিয়েটার চর্চায় যুক্ত আছেন। মুক্তিযুদ্ধের এক উজ্জ্বল ফসল এই থিয়েটার। থিয়েটারের লোকেদের কাছে জীবন্ত হয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, গণতান্ত্রিক সংগ্রামে নাট্যকর্মীরা চিরজাগ্রত। মুক্তিযুদ্ধে পাশের যে যোদ্ধা প্রাণ দিলেন, তাঁর রক্তাক্ত দেহকে এখনো চোখের সামনে এনে আমরা বলি, তোমাদের এই রক্তদান বৃথা যেতে দেব না। মঞ্চে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে একটি সংলাপও উচ্চারিত হতে দেব না। চট্টগ্রামের তির্যকের আয়োজনে আহমদ ইকবাল হায়দারের অনুষ্ঠানে আবার সেই চেতনা নতুন করে জাগ্রত হলো।
মামুনুর রশীদ, নাট্যব্যক্তিত্ব