হোম > ছাপা সংস্করণ

রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রভাষা

আবুল কাসেম ফজলুল হক

ঐতিহাসিক কালব্যাপী সর্বত্রই দেখা যায় মানুষের জীবনের সঙ্গে তার ভাষার কিংবা নিজের ভাষার সঙ্গে মানুষের জীবনের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। ভাষা ছাড়া জীবনযাপন চলে না। মানুষের আত্মবিকাশের একপর্যায়ে তার জীবনের বিমূর্ত অঙ্গরূপে দেখা দিয়েছে ভাষা। সৃষ্টির ধারায় জীবন আগে না ভাষা আগে—এ প্রশ্নে অবশ্যই জীবনকে আগে পাওয়া যায়।

মানুষ ভাষা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে না, ভাষা আয়ত্ত করে। ভাষা আয়ত্ত করার এবং ভাষাকে বিকশিত করার সামর্থ্য মানুষের আছে। ইতিহাসজুড়ে মানুষকে এক অবস্থায় দেখা যায় না। মানুষ হয়ে-ওঠা প্রাণী। এই হয়ে-ওঠার বা উন্নতির প্রক্রিয়া চলমান। পরিবেশের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার, সেই সঙ্গে সমাজের অভ্যন্তরীণ বিরোধের মধ্য দিয়ে মানুষ বর্তমান অবস্থায় উত্তীর্ণ হয়েছে। মানুষের এই হয়ে ওঠার বা উন্নতির মূলে আছে ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত জীবনের ইচ্ছাশক্তি, চিন্তাশক্তি এবং শ্রমশক্তি। চিন্তাই ভাষা, ভাষাই চিন্তা। চিন্তা ছাড়া ভাষা হয় না, ভাষা ছাড়া চিন্তা হয় না।

দেখা যায়, জীবন যেখানে উন্নত, ভাষাও সেখানে উন্নত এবং ভাষা যেখানে উন্নত, জীবনও সেখানে উন্নত। ভাষার উন্নতি সাধিত হয় ভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টির এবং জাতীয় উন্নতির মধ্য দিয়ে। নিজের ভাষাকে উন্নত না করে কোনো ব্যক্তি কিংবা জাতি উন্নতি করতে পারে না। যে ব্যক্তি ভাষায় নিপুণ, সমাজে তার সাফল্য ও মর্যাদা বেশি।

আরও দেখা যায়, ভাষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞান আর জ্ঞান-বিজ্ঞান ও ভাষা অবিচ্ছেদ্য। সাহিত্য, সংগীত, শিল্পকলা ইত্যাদি সৃষ্টির পেছনেও কাজ করে চিন্তা বা ভাষা। চিন্তা আগে না ভাষা আগে—এ নিয়ে বিতর্ক আছে ভাষা-তাত্ত্বিকদের মধ্যে। আমার ধারণা, এই বিতর্ক অমীমাংসেয়; কারণ চিন্তা ও ভাষা অবিচ্ছেদ্য, একটিকে আগে অন্যটিকে পরে বলার উপায় নেই। মানুষের সব কর্মকাণ্ডেরই মর্মে কাজ করে চিন্তা বা ভাষা। কাজের বেলায় শ্রমশক্তি পরিচালিত হয় চিন্তাশক্তি দ্বারা। চিন্তা ও ভাষা অভিন্ন, অবিভাজ্য।

জাতি ও রাষ্ট্রের উন্নতির সঙ্গে ভাষার উন্নতি কিংবা ভাষার উন্নতির সঙ্গে জাতি ও রাষ্ট্রের উন্নতি অবিচ্ছেদ্য। কোনো জাতির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উন্নতি আর ভাষার উন্নতিও অবিচ্ছেদ্য। ভাষাকে উন্নত না করে আত্মনির্ভর স্বাধীন আর্থসামাজিক-রাষ্ট্রিক উন্নতি সম্ভব হয় না। মানুষের জীবন ও পরিবেশ বিকাশশীল, ভাষাও বিকাশশীল। উন্নত জাতিগুলো তাদের ভাষার উন্নতির জন্য পরিকল্পনা নিয়ে অনেক কাজ করে। সাম্রাজ্যবাদীরা তৎপর থাকে নিজেদের ভাষার উন্নতি সাধনে এবং দুর্বল জাতিগুলোকে ভাষার দিক দিয়েও নির্ভরশীল রাখতে।

একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যমতে, এখন মাত্র ২০০ ভাষা দুনিয়ায় আছে। এসব ভাষা বিকাশমান। এগুলোর মধ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্যের দিক দিয়ে বাংলা ভাষার স্থান এখনো ওপরের দিকেই আছে। এগুলো ছাড়া বিভিন্ন মহাদেশে কয়েক হাজার ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী আছে; তাদেরও আলাদা আলাদা ভাষা আছে। তবে তাদের ভাষা বিলীয়মান।

বাংলাদেশে ৪৫টি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর ৪৫টি বিলীয়মান মাতৃভাষা আছে। এই ৪৫টি জনগোষ্ঠীর মোট জনসংখ্যা বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ১ শতাংশের সামান্য বেশি। এরা জন্মের পর থেকেই নিজেদের ভাষার মতো বাংলা ভাষাও শেখে। এদের বলা যায় দ্বিভাষিক। বাংলা ভাষাকেই তারা উন্নতির অবলম্বন মনে করে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকেরা জীবনযাত্রার ও উন্নতির প্রয়োজনে নিজেদের ভাষার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে রাষ্ট্রভাষা শিখছে। এর মধ্যে রয়েছে তাদের উন্নতির সম্ভাবনা। বিভিন্ন রাষ্ট্রে ছড়িয়ে থাকা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর উন্নতির ও মানবজাতির মূলধারায় আসার সুযোগ সর্বত্র বাড়াতে হবে। কোনো ভাষার অর্থনৈতিক ভিত্তি বিকাশশীল থাকলে সেই ভাষা বিকাশশীল থাকে। তাই কোনো ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীই তার বিলীয়মান মাতৃভাষা নিয়ে জীবিকার ব্যবস্থা করতে পারে না।

মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্রভাষা দ্বারা কেবল অফিসের ভাষা বোঝায় না, বোঝায় তার সঙ্গে আরও অনেক কিছু। রাষ্ট্রভাষার মধ্যে অফিস চালানোর ভাষা আছে, সেই সঙ্গে আছে জাতীয় জীবনে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টির ভাষা এবং কোনো জাতির আর্থসামাজিক-রাষ্ট্রিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ভাষা আছে। রাষ্ট্রভাষার উন্নতি হলে রাষ্ট্রের অন্তর্গত জাতির সভ্যতা উন্নত হয়।

আমাদের উপলব্ধি করা দরকার যে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অস্তিত্ব ও উন্নতির জন্য রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার অস্তিত্ব ও উন্নতি অপরিহার্য। চলমান বহু ঘটনা আছে, যেগুলো দেখে বলা যায়, রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা না টিকলে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ টিকবে না। দেশ থাকবে, মাটি, মানুষ, গাছপালা, পশু-পাখি, নদী-নালা ও আকাশ-বাতাস থাকবে, কিন্তু রাষ্ট্র থাকবে না। যারা বাংলাদেশে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার বদলে ইংরেজি চান, তাঁরা রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে রক্ষা করবেন?

দেশ এবং রাষ্ট্র এক নয়। দেশ প্রকৃতির সৃষ্টি, রাষ্ট্র মানুষের। আমাদের রাষ্ট্র না থাকলে, কেবল দেশ থাকলে, আমরা কি ভালো থাকব? নিজেদের রাষ্ট্র না থাকলে আমরা কি স্বাধীন থাকব? ১৯৭১ সালে কেন আমরা স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছিলাম? ছয় দফা আন্দোলনে কেন আমরা যোগ দিয়েছিলাম? কেন আমরা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করেছিলাম? কেন আমরা ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হতে চেয়েছিলাম? বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে গড়ে তোলার লক্ষ্য বাদ দিয়ে চললে এসব চাওয়া অর্থহীন হয়ে যায়।

ভৌগোলিক বাস্তবতা ও বাঙালি-চরিত্র লক্ষ করে, ১৯৭৩ সাল থেকেই কোনো কোনো চিন্তাশীল ব্যক্তি বলে আসছেন, বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকার মতো নয়। তাঁরা জোর দিয়েছেন বাঙালি-চরিত্রের নিকৃষ্টতায়। তাঁদের যুক্তি ও মত কখনো আমার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। তাঁরা অনেকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায় নাগরিকত্ব নিয়েছেন এবং প্রায় সবাই তাঁদের সন্তানদের ওই সব রাষ্ট্রের নাগরিক করেছেন। আমি সব সময় বাঙালি-চরিত্রের উন্নতি সম্ভব বলে মনে করেছি। আমি সব সময় মনে করেছি এবং এখনো মনে করি, বাংলাদেশকে অবশ্যই বাংলাদেশের জনগণের প্রগতিশীল রাষ্ট্ররূপে গড়ে তোলা যাবে। সে লক্ষ্যেই আমাদের চিন্তা ও কাজ। জাতীয় হীনতাবোধ বাংলাদেশের ধনী-গরিব, শিক্ষিত-শিক্ষাবঞ্চিত, ক্ষমতাবান-ক্ষমতাবঞ্চিত সব মানুষকে ভেতর থেকে কুরে কুরে খাচ্ছে। জনসাধারণ ঘুমন্ত। জাতীয় হীনতাবোধ থেকে জাতিকে মুক্ত করতে হবে। ঘুমন্ত জনসাধারণকে জাগাতে হবে। অবস্থার উন্নতির জন্য যা কিছু করা দরকার, সবই আমাদের করতে হবে।

বাংলাদেশকে বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে গড়ে তোলার এবং বাংলা ভাষাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষারূপে প্রতিষ্ঠা করার পথে বিরাজিত অন্তরায়গুলো দূর করতে হবে। তার জন্য নতুন সংকল্প দরকার। যাঁরা দ্বৈত নাগরিক, যাঁদের স্ত্রী অথবা স্বামী অথবা সন্তান দ্বৈত নাগরিক কিংবা বিদেশি নাগরিক, তাঁরা যাতে বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি, উপমন্ত্রী থেকে প্রধানমন্ত্রী, উপসচিব থেকে সচিব, জজকোর্ট থেকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক ইত্যাদি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হতে কিংবা অধিষ্ঠিত থাকতে না পারেন, সংবিধানে তার সুস্পষ্ট বিধান রাখতে হবে। বিধান এমন হবে যে কারও অন্য রাষ্ট্রে গিয়ে নাগরিকত্ব গ্রহণে বাধা থাকবে না; কিন্তু অন্য রাষ্ট্রের নাগরিক হলে (দ্বৈত নাগরিক) কিংবা স্ত্রী বা স্বামী বা সন্তান অন্য রাষ্ট্রের নাগরিক বা দ্বৈত নাগরিক হলে কেউ বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হতে কিংবা থাকতে পারবেন না।

রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন পর্যায়ে এবং বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরে প্রথম দুই দশকে বাংলা ভাষার উন্নতি এবং রাষ্ট্রভাষারূপে বাংলা ভাষার প্রচলন অনেকটুকু হয়েছে। কিন্তু ১৯৯১ সাল থেকে বিদেশি সহায়তায় রাজনীতি যে রূপ নিয়েছে, তাতে রাষ্ট্রব্যবস্থায় বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়নি। বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে এবং বাংলা ভাষাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষারূপে প্রতিষ্ঠা করার প্রশ্নে সিভিল সোসাইটি সংগঠনগুলোর এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মনোভাব এখন শিথিল। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র—এটাই আর মনে করা হয় না।

রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের এবং রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার বিবেচনা বাদ দিয়ে বাংলা ভাষার পক্ষে যে প্রচারকার্য চালানো হয়, তা গাছের গোড়া কেটে আগায় পানি ঢালার মতো ব্যাপার। নতুন রেনেসাঁ ও নতুন গণজাগরণের লক্ষ্যে চিন্তা ও কাজের মর্মে দরকার উন্নত চরিত্রবল ও প্রগতিচেতনা। জ্ঞানচর্চার সঙ্গে উন্নত চরিত্রবল ও কর্মমুখিনতা না থাকলে রেনেসাঁ ও গণজাগরণ হয় না।

আগেকার রেনেসাঁর লক্ষ্য ছিল মধ্যযুগের গর্ভ থেকে আধুনিক যুগকে মুক্ত করা এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য ও রাজনীতি-অর্থনীতিকে প্রগতির ধারায় বিকশিত করে চলা। এখন নতুন রেনেসাঁর লক্ষ্য হবে আধুনিক যুগের ভ্রান্তি ও অনাচার থেকে মুক্তি এবং নতুন সভ্যতা ও প্রগতির ধারায় অভিযাত্রা। নতুন রেনেসাঁর অভাবে চলছে ইতিহাসের পশ্চাদ্গতি। 

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ