হোম > ছাপা সংস্করণ

ডা. সংযুক্তা সাহা বনাম সেন্ট্রাল হাসপাতাল

স্বপ্না রেজা

বাংলাদেশের চিকিৎসাসেবা বা স্বাস্থ্যসেবা, যা-ই বলি না কেন, এই সেবা নিয়ে অনেক অসন্তোষ আছে, আছে অভিযোগ। যদিও এই অসন্তোষ, অভিযোগ নতুন নয়, অনেক দিনের। স্বাস্থ্যসেবার গুণগতমান বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যসেবাকে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে প্রতিবছর বাজেটে অর্থ বরাদ্দ, পরিকল্পনার সমাহার থাকে। এটা বলতেই হয়, পাকা সড়কের মতো স্বাস্থ্যসেবার সাইনবোর্ড প্রত্যন্ত অঞ্চল, গ্রামগঞ্জে পৌঁছে গেলেও এই সেবার গুণগতমান মানুষের হৃদয়াঞ্চলে সেভাবে পৌঁছাতে পারেনি, যা দুঃখজনক।

এমনকি নগরে অভিজাত আকাশছোঁয়া হাসপাতালগুলোতেও একই অবস্থা। ‘সেবা’ শব্দটা সঙ্গে নিয়ে চলা এই কার্যক্রম মোটেও তার গুরুত্ব কিংবা মহত্ত্ব বহন করে না। তেমন দৃষ্টান্ত চারপাশে। বলা যায়, সেবা শব্দটা তার মানবিক ও সামাজিক দিকটা হারাতে বসেছে, কিংবা কোনো দিন সে ছিল না হয়তোবা এবং তা লক্ষণীয়। গুণগতমান এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছে গেছে যে অসুস্থ হলেই মানুষ এখন পাশের দেশ ভারতে চলে যাচ্ছে চিকিৎসা করাতে। অল্প খরচে ভালো চিকিৎসা, এমন মনোভাবে রোগীদের ছুটে যাওয়া। এখানে একটা কথা বলা জরুরি, বাংলাদেশেও আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসক আছেন, তবে তেমন স্বাস্থ্যব্যবস্থা নেই বিধায় অনেকেই তাঁদের সন্ধান পায় না।

চোখধাঁধানো আধুনিক অবকাঠামো ও যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হলেও চিকিৎসাসেবার মানটা তাতে আড়াল হয়ে পড়ছে। ভেতরে কী হচ্ছে, কেমন হচ্ছে তার কোনো জবাবদিহি যেমন নেই, তেমনি নেই এই সব মনিটরিং করার দায়বদ্ধতা। প্রতিটি ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল ব্যক্তি থাকলেও তাদের দায়িত্ববোধ থাকে না। কিংবা থাকলেও দায়িত্ব পালনে তারা দুর্নীতি নামের ভয়ংকর ছাউনিতে সমবেত হচ্ছে। চিকিৎসা প্রাপ্তি তখন সাধারণের কাছে দুষ্প্রাপ্য হয়ে দাঁড়ায়। এভাবে কিছু অসৎ, অসাধু চিকিৎসক ও চিকিৎসা ব্যবস্থাপকের কারণে গোটা চিকিৎসাসেবা নানাভাবে বিতর্কিত, প্রশ্নবিদ্ধ, সমালোচিত। ফলে সাধারণ মানুষের ধারণা ইতিবাচক হতে পারছে না। অন্যদিকে চিকিৎসাসেবা বা স্বাস্থ্যসেবা, এককথায় দুর্দান্ত ব্যবসায়িক মুডে সক্রিয় হয়ে উঠছে। ওতে মানবসেবার ব্রত নেই, আছে কাঁড়ি কাঁড়ি নোটের বুঁদস্বপ্ন। বেহুঁশ আচরণ।

সম্প্রতি ডাক্তার সংযুক্তা সাহাকে নিয়ে চলছে তোলপাড়। রোগী ছাড়া তাঁর কথা কজনইবা জানত? সেন্ট্রাল হাসপাতালের কার্যক্রম নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। যেটা সব সময় হয়, দুর্ঘটনা ঘটার পর চারদিকে আওয়াজ ওঠে এবং সেই আওয়াজটা হলো দায়িত্বে অবহেলার আওয়াজ।

রোগীর মৃত্যুর পর লোকে জানতে পারে অবহেলার মাত্রা। আর অবহেলার বিষয়টি দেখা হয় গভীর মনোযোগে। দুর্ঘটনা ঘটার আগে যার ছিটেফোটা থাকে না। জানা গেছে, ডাক্তার সংযুক্তা সাহা সেন্ট্রাল হাসপাতালের একজন গাইনি বিশেষজ্ঞ। অনেক প্রসূতি রোগী তাঁর। দিনে তাঁর অস্ত্রোপচার ও প্রসব রোগীর সংখ্যা নাকি ১৬-১৭ জন। বায়োনিক চিকিৎসক কি না, প্রশ্ন ওঠে। একে তো ঢাকা শহরের হাসপাতাল সেন্ট্রাল, তার ওপর রয়েছে নাম হওয়া চিকিৎসকের দল। এই নাম হওয়ার বিষয়টি নিয়েও কিছু কথা আছে। ফি ও রোগী বেশি হলে অনেকেই তাঁকে ‘ভালো চিকিৎসক’ বলে মনে করে।

যেমন বাজারে গিয়ে দামি পোশাকটি অনেকেই কেনে টেকসই ভেবে। কেউ কেউ আবার অর্থের মানদণ্ডে, স্ট্যাটাসের কারণে অভিজাত, অত্যাধুনিক খ্যাত হাসপাতালকে বেছে নেয় চিকিৎসার জন্য। তাদের এক পা অবশ্য দেশের বাইরে থাকে। যা-ই হোক, সুসজ্জিত, অভিজাত হাসপাতাল দেখে মনে হয়, এখানে নিশ্চয়ই উন্নত মানের চিকিৎসা হয়। অথচ উন্নতমানের দুরবস্থা, দুর্দশার বিষয়টি বের হয়ে আসে তখন, যখন চিকিৎসায় দারুণ অবহেলার বিষয়টি প্রকাশ পায় এবং রোগীর অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু হয়। একজন প্রসূতি রোগী আঁখি ও তাঁর নবজাতকের অবহেলাজনিত অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু না হলে সম্ভবত একজন ডাক্তার সংযুক্ত সাহা বিতর্কিত হতেন না। সেন্ট্রাল হাসপাতাল নিয়েও কর্তৃপক্ষ তেমন নড়েচড়ে বসত না। অনুপযোগিতার অজুহাতে বা প্রশ্নে সেন্ট্রালের সব অস্ত্রোপচার বন্ধের ঘোষণাও দেওয়া হতো না; বরং বহাল তবিয়তে সংযুক্তা ও সেন্ট্রাল হাসপাতাল তাদের চিকিৎসা কার্যক্রম চালিয়ে যেত।

অভিযোগের পর ডাক্তার সংযুক্তা সাহা সম্প্রতি মিডিয়ার সামনে উপস্থিত হয়েছেন। সেন্ট্রাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আঁখি ও তাঁর নবজাতকের মৃত্যুর জন্য সংযুক্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে। অভিযোগ হলো, আঁখি তাঁর রোগী। অপারেশনের সময় সংযুক্তা হাসপাতালে আছেন বলে জানানো হয়। অথচ তিনি ছিলেন না। তাঁর পক্ষে আনাড়ি হাতে আঁখির অস্ত্রোপচার করা হয় বলে জানা গেছে।

আঁখির মূত্রনালি, কিডনি কেটে ফেলা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এমন অভিযোগ নতুন কিছু নয়। সুস্থ মানুষকে মেরে ফেলার গল্প বহু আছে। সংযুক্তাও বসে নেই। উদয় হয়ে অভিযোগ করেছেন সেন্ট্রালের বিরুদ্ধে। বলেছেন, তাঁকে দিয়ে অসংখ্য রোগী দেখানো হতে।

বিছানার ব্যবস্থাও করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অপারেশন থিয়েটারের পাশে। তাঁর মৌখিক-লিখিত সম্মতি ছাড়াই আঁখির অপারেশন করা হয়েছে। বেশ অনুযোগের সুরেই কথাগুলো বলছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁর কাছে প্রশ্ন, তিনি কেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অনুরোধে অতিরিক্ত রোগী দেখার সম্মতি দিয়েছিলেন? আর এখন কেন সে কথা স্মরণ করছেন? বিবেকের তাড়নায় তাঁর তো আগেই সংযত হওয়া বা বোধোদয় হওয়ার দরকার ছিল। ডাক্তার সংযুক্তা একজন ইউটিউবার, তিনি টিকটকের মাধ্যমে রোগী সংগ্রহের কাজ করতেন বলে জানা যায়।

তেমন কিছু নমুনা ইতিমধ্যে ভাইরাল হয়েছে। তবে এটা ঠিক যে ডাক্তার সংযুক্তা সাহাকে জনপ্রিয় ও তাঁর নাম ছড়ানোর পেছনে নিশ্চয়ই সেন্ট্রাল হাসপাতালের অগ্রণী ভূমিকা ছিল এবং সেটা হাসপাতালের ব্যবসায়িক স্বার্থে। উভয় পক্ষই টাকা কামাইয়ে বেপরোয়া নেশাগ্রস্ত ছিল—কথাটা কোনোভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই। আজ আঁখির করুণ মৃত্যুতে তারা পরস্পর পরস্পরের শত্রু এবং সেটা নিজেদের দোষমুক্ত করার ফন্দি। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে ফাটল ধরলে যেমন দোষারোপের কাদা ছোড়াছুড়ি শুরু হয়, তেমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে এখন সংযুক্তা ও সেন্ট্রাল হাসপাতালের মধ্যে। সম্পর্কের চূড়ান্ত অবনতি হয়তো আরও অনেক তথ্য দেবে। শুধু যে সেন্ট্রাল হাসপাতাল তা নয়, চিকিৎসাসেবার গুণগতমান আর্থিক মানদণ্ডে বিচার-বিশ্লেষণ করলে ফলাফল ভালো কিছু হবে না, সেই সুযোগ নেই কোথাও।

যদিও এখন সংযুক্তা ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের মুখোমুখি অবস্থান এবং মাঝখানে রয়েছে বিশাল অভিযোগ। আমরা চাইছি, এই দুই আপনের পাল্টাপাল্টি লড়াইয়ে হাসপাতালের মূল ক্ষত, অযোগ্যতা, অব্যবস্থাপনা ও অবহেলাজনিত আচরণ দৃশ্যমান হোক। ডাক্তার সংযুক্তা ও সেন্ট্রাল হাসপাতাল, কেউই জবাবদিহি, দায়বদ্ধতা ও আইনের ঊর্ধ্বে নয়। রাষ্ট্রকে শক্তভাবে সেই সত্য অরাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। নতুবা রাষ্ট্রও এই হত্যা প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে প্রকৃতির নিয়মে বিবেচিত হয়ে পড়বে, যা কারোরই কাম্য নয়।

এ ধরনের ঘটনায় বারবার প্রতীয়মান হয় যে চিকিৎসাসেবা যেনতেনভাবে, ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ইচ্ছেমতো চলছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পর্যবেক্ষণ, পরিবীক্ষণ কিংবা পরামর্শ কোনোটাই নেই। এমন অবস্থার অবসান হওয়া বাঞ্ছনীয়। স্বাস্থ্যসেবা যেনতেনভাবে বাস্তবায়নের দায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকেও নিতে হবে। চিকিৎসাসেবাকে ব্যবসায়িক মনোভাব থেকে বের করে আনতে না পারলে চিকিৎসক ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কখনোই মানবিক হতে পারবে না। স্বাস্থ্যব্যবস্থা নেহাতই প্রহসন হয়ে থাকবে। আর অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ