হোম > ছাপা সংস্করণ

মহত্তম কল্যাণের কাজ

মামুনুর রশীদ

নরসিংদীর ঘটনাটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বিষয়টির মধ্যে একটা বড় রাজনৈতিক আভাস পাওয়া যায়। বাংলাদেশের সর্বত্র হিজাব-বোরকার যে ব্যাপক প্রচলন দেখা যাচ্ছে তা একেবারেই নারীদের স্বেচ্ছায় হয়েছে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই।

হাতাহাতি, মারামারি, লাঞ্ছনা থেকে শুরু করে জুতাপেটা, কান ধরে ওঠবস করা, বিচারে দোররা মারা—এসব আজ যেন আমাদের সংস্কৃতির একটা অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। 
এক দিনেই পত্রিকায় দেখা গেল জনৈক সাংসদ একজনকে মারধর করেছেন, নরসিংদীর ঘটনা ঘটেছে এবং একটু খোঁজ করলেই দেখা যাবে এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘটে গেছে। নরসিংদীতে প্রকাশ্য দিবালোকে শুধু কারও অপছন্দের পোশাক পরার কারণে প্রথমে একজন নারী এবং পরে আরও অনেকে এক তরুণীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। পুলিশ দ্রুত এসে তাদের উদ্ধার করে ট্রেনে তুলে না দিলে বিষয়টি আরও অনেক দূর যেতে পারত।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কেউ একজন ছবি তুলে প্রচার করলে সারা দেশের মানুষ এটা জানতে পারে। মাদ্রাসা বা স্কুলে ছাত্রদের ওপর বেত্রাঘাত এক নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। সিলেটে এক বালককে অভিনব কায়দায় শাস্তি দিয়ে মেরেই ফেলা হয়েছিল। গ্রামবাংলার বিভিন্ন জায়গায় নারীকে দোররা মারা, চুল কেটে দেওয়া এগুলোর বিস্তর ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে আমরা দেখেছি গান গাওয়ার অপরাধে বাউলদের চুলও কেটে দেওয়া হয়েছে। এসব ঘটনায় অসহায় মানুষেরা ভয় পেয়ে আরও বেশি অসহায়বোধ করে এবং সমাজের একশ্রেণির ক্ষমতাবান লোক নিজেদের ক্ষমতার গর্বে আরও বেশি এসব কাজে উৎসাহিত হয়। কখনো কখনো দেখা যায়, পুলিশি নির্যাতনে হাজতিদের মৃত্যু ঘটে।

অতীতে, বিশেষ করে সেনা শাসনের সময় নানা ধরনের অত্যাচারের ব্যবস্থা থাকত। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে রীতিমতো সন্দেহভাজনদের নিয়ে গিয়ে টর্চার সেলে নানাভাবে নির্যাতন করা হতো। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের অনেক নির্যাতনের ঘটনা শুনলে এখনো গা শিউরে ওঠে। শহীদ আলতাফ মাহমুদকে যেভাবে নির্মম অত্যাচার করতে করতে হত্যা করা হয়েছিল, তার বিবরণ আমাদের চমকে দেয়। স্বাধীন বাংলাদেশেও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তায় থেকে চার নেতার মৃত্যুর বিবরণে আমরা আরও অসহায়বোধ করি। কিন্তু এই যে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বাইরে একেবারে জনগণের মধ্যে যে ঘটনাগুলো ঘটছে, তা সমাজের একটা বড় অংশকে ভীত করে তুলছে। জনপথ, বাজার, ঘাট, বাসস্টেশন, রেলস্টেশন যেখানে নিরাপত্তা বাহিনীর অবস্থান খুব কাছেই, সেখানেও এসব ঘটনা ঘটায় একটা বড় নিরাপত্তার অভাব বোধ তৈরি হয়েছে।

নরসিংদীর ঘটনাটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বিষয়টির মধ্যে একটা বড় রাজনৈতিক আভাস পাওয়া যায়। বাংলাদেশের সর্বত্র হিজাব-বোরকার যে ব্যাপক প্রচলন দেখা যাচ্ছে তা একেবারেই নারীদের স্বেচ্ছায় হয়েছে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। দিনের পর দিন বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে ওয়াজ মাহফিল এবং মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া বেকার জনগোষ্ঠী একধরনের কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, এর সঙ্গে ইংরেজি স্কুলে উচ্চশিক্ষায় পাঠ করেও একদল তরুণ হোলি আর্টিজানের মতো ঘটনাও ঘটিয়েছে। বিপুল সংখ্যক গ্রামবাংলার শ্রমিক মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে চাকরিবাকরি করেছেন এবং সেখানকার শিক্ষার আদলে নিজের মানসভূমি গড়ে তুলেছেন। এই মানসভূমি গড়ে তোলার পেছনে নেতিবাচক আরও কিছু মনোভাব সৃষ্টি করেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অবাধ প্রচার। এই প্রচারাভিযানের সাফল্য হিসেবে প্রচুর মাদ্রাসা গড়ে উঠেছে এবং নারী মুক্তির ক্ষেত্রে কোনো ইতিবাচক কিছু না ঘটে নারী সমর্পিত হচ্ছেন গভীর অন্ধকারে! অভিযোগ আছে, আজকাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া কোনো মেয়ে যদি হিজাব-বোরকা ছাড়া গ্রামে যান, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে নিয়োজিত হন, তাঁদের দল বেঁধে গ্রামের মাদ্রাসার ছেলেমেয়েরা নানাভাবে উত্ত্যক্ত করতে থাকেন। তাঁদের বোঝানোর চেষ্টা করেন স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া পাপের কারণ এবং মাদ্রাসায় পড়ালেখা করাটাই একমাত্র মুক্তির উপায়!

ওই সমাজের পরিবারটি যদি দুর্বল হয়, তাহলে ছুটির মধ্যেও সেই মেয়ের পক্ষে গ্রামে থাকা বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। আজ থেকে ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগেও বাংলাদেশে এই চিত্র দেখা যায়নি; বরং মাদ্রাসায় শিক্ষাকে নিরুৎসাহিত করা হতো বাস্তবজীবনের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে। অবশ্য এ কথাও ঠিক যে হেফাজতে ইসলাম বা তাদের অনুসারীদের নানা ধরনের চাপের মুখে সরকার কিছু আপস করেছে; বিশেষ করে পাঠ্যপুস্তকে তার প্রভাব পড়েছে। যদিও আজকাল মাদ্রাসায় ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি বাংলা, গণিত, ইংরেজি, বিজ্ঞান এসব যুক্ত হয়েছে আলিয়া মাদ্রাসায়, কিন্তু কওমি মাদ্রাসা পাঠ্যসূচি পরিবর্তন করেনি। তবুও সংখ্যায় তারা বেশি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে এখন ক্রমাগতভাবে মাদ্রাসা শিক্ষার প্রসার হচ্ছে বটে, কিন্তু ধর্মীয় আচার-ব্যবহার ও চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট বিভাজনকে উসকে দিচ্ছে। আমাদের ইসলাম ধর্মে যে শান্তির বাণী যুগ যুগ ধরে যা চলে আসছে, তা আর খুঁজে পাওয়া যায় না।

আজকাল গ্রামাঞ্চলে রাজনীতি করতে গিয়ে অনেকে অবৈধ অর্থে মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণ করে থাকেন। মুসল্লিরা জেনেশুনে সেই সব মসজিদে নামাজ আদায় করেন। সেটা করা কতটা সমীচীন, তা-ও তাঁরা ভাবেন না। যেহেতু বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম নিয়েছিল, তাই এসব ধর্মভিত্তিক দল রাজনীতিতে বহুদিন পর্যন্ত খুব সুবিধা করতে পারেনি। কিন্তু রাজনীতির কারণেই একটি গণতান্ত্রিক দল বলে পরিচিত হয়ে ধর্মভিত্তিক সংগঠনগুলোকে ক্ষমতায় যাওয়ার সোপান হিসেবে নিজেদের মধ্যে জায়গা করে দেয়। এই সুযোগে সংগঠনগুলোর সদস্যরা বিভিন্ন দলে ঢুকে যান এবং দলটিকে নানা কলাকৌশলে তাঁদের আয়ত্তের মধ্যে নিয়ে আসেন।

সরকারি দলের নেতা-নেত্রীরা এলাকায় খুব একটা যান না। তাঁদের কর্মীরাও শহরাঞ্চলে বসবাস করেন। নানা কারণে তাঁরা গ্রামকে আর নিরাপদ মনে করেন না।

এখন গ্রামে অসাধু, অনৈতিক ব্যবসায়ীরা ধর্মীয় লেবাসে নিরাপদে জীবনযাপন করেন। তাঁরাই বাংলার সংস্কৃতিকে ভয় পান এবং হেলিকপ্টারে করে আলেম-ওলামাদের এনে ওয়াজ মাহফিল করান। এই আলেম-ওলামাদের আগমনকে কেন্দ্র করে গ্রামাঞ্চলে একটা নতুন অর্থনীতি গড়ে ওঠে এবং দেখা যায় তাঁদের বিস্তর সম্পত্তি। খাঁটি আলেম-ওলামারা খুব সাধারণ জীবনযাপন করেন এবং ওই সব আলেমের শক্তির সামনে তাঁরা নিঃসঙ্গবোধ করেন। এই বিত্তবান হুজুরদের মধ্য থেকেই জঙ্গিবাদের সৃষ্টি হয়। এসব হুজুর মাদ্রাসার শিক্ষার ক্ষেত্রেও কোনো ধরনের সুশিক্ষার চেষ্টা করেন না। মাদ্রাসাগুলোতে খেলার মাঠ নেই, ছোট্ট দুটি ঘরের মধ্যেই মাদ্রাসা গড়ে তোলা সম্ভব। আবার আছে বোর্ডিং বা আবাসিক মাদ্রাসা, যেখানে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। যদিও এসব বোর্ডিং থেকে ছাত্ররা নিম্নমানের খাবার ও থাকার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে থাকে। অনেক এমপিওভুক্ত মাদ্রাসা আছে, যার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। অথচ মাসের পর মাস মাদ্রাসার শিক্ষকেরা বেতন-ভাতাও পেয়ে যাচ্ছেন। ধর্মনিরপেক্ষ একটি দেশে এত মাদ্রাসার অনুমোদন দেওয়ার কী প্রয়োজন ছিল?
রাষ্ট্র শিক্ষায় লগ্নি করে শিক্ষার্থীদের সমাজের বিভিন্ন স্তরে আধুনিক জীবনযাত্রার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য। বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষা নিয়ে তারা রাষ্ট্রকে নানাভাবে সেবাদান করবে। কিন্তু এর পরিবর্তে এই শিক্ষা বিপুল পরিমাণ বেকারত্বের সৃষ্টি করে থাকে।

নরসিংদীতে যারা ওই তরুণীকে আঘাত করল, তারা কোন শিক্ষা পেয়েছে? যদি ওই তরুণীর পোশাক তার অপছন্দের হয়, তাহলে ধর্মের নিয়মানুসারে তাকে নসিহত করতে পারত। নসিহত না করে সরাসরি আক্রমণ করার বিধান কি ইসলাম ধর্মে আছে? অর্থাৎ ধর্মীয় শিক্ষাও তাদের মাঝে প্রবেশ করেনি। বুখারি শরিফে উল্লেখ আছে: 
মহানবী (সা.) প্রকৃত মুসলমানের পরিচয় বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে দিয়েছেন। ব্যক্তি মুসলমান হতে হলে এক আল্লাহর ওপর বিশ্বাসের পাশাপাশি উত্তম কাজ করতে হবে। জিহ্বা সংযত রাখতে হবে। অনর্থক কারও ওপর হাত তোলা যাবে না। মানুষকে কোনোভাবেই কষ্ট দেওয়া ইসলাম সমর্থন করে না। মহানবী (সা.) বলেন, ‘সে-ই মুসলমান, যার জিহ্বা ও 
হাতের অনিষ্ট থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ থাকে।’ এ কথাও বলা আছে যে জুলুম বড় গুনাহের কাজ। কাউকে অকারণে কষ্ট দেওয়া জুলুমের অন্তর্ভুক্ত, যার পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ।

আল্লাহ তাআলা জালিমদের পছন্দ করেন না। নরসিংদীর ঘটনাটি অবশ্যই জুলুমের মধ্যে পড়ে। যদি ওই আক্রমণকারীরা মনে করে থাকে যে তারা একটি ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করেছে, তাহলে তা মারাত্মক ভুল হবে। তারপরেও একটা বড় দায়িত্ব এসে যায়—এ দেশে যাঁরা অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন এবং সর্বোচ্চ মানবিক কল্যাণের জন্য নিয়োজিত, সেই সব রাজনীতিবিদ, সাংস্কৃতিক কর্মী এবং সচেতন মানুষের ওপর। যে যাঁর জায়গা থেকে মহত্তম নাগরিক কল্যাণের জন্য নিরন্তর সংস্কৃতির কাজ করে যেতে হবে।

মামুনুর রশীদ, নাট্যব্যক্তিত্ব

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ