মফিজ, বোকাসোকা, আয়োডিনের অভাব, পরিশ্রমী কিংবা ভালো মানুষ। এই ডাকগুলোর সঙ্গে বেশ পরিচিত উত্তরাঞ্চলের মানুষ; বিশেষ করে রংপুর বিভাগের মানুষেরা। পরিশ্রম আছে, উন্নতি নেই। নেই কর্মসংস্থান। ঢাকায় নাকি টাকা ওড়ে। কিন্তু উত্তরের মানুষগুলো তা ধরতে জানেন কই? অধিকাংশই আসেন রিকশা চালাতে কিংবা কঠোর কাজগুলো ধরতে। শুধু কি রাজধানী? বাইরের জেলাতেও অল্প টাকায় কাজ করতে জুড়ি নেই তাঁদের।
মঙ্গা এলাকার মানুষ। এই নামটাও শুনে থাকবেন হয়তো। খাতা-কলমে দূর হয়েছে মঙ্গা। কিন্তু ভাগ্য পরিবর্তন হয়েছে আর কই। বইছে শীতের হাওয়া। ঠক ঠক করে কাঁপছেন উত্তরের মানুষেরা। নেই শীত তাড়ানোর অস্ত্র। শরীর ঢাকার কাপড়ে যেখানে কয়েক ছত্র ছেঁড়া, শীতে কাঁপতে তো হবেই। শীত আসবে, কষ্ট পাবে জেনেও তাঁরা বিক্রি করে দেন কম্বল। ভাত জোটাতে যে চাই চাল। শীত পেরোলেই উত্তরে সাহায্যের কম্বল বিকিকিনির হাট বসে। অভাবের সংসারে কটা টাকার জন্য পরের শীত পর্যন্ত রাখা হয় না হাত পেতে নেওয়া কম্বলটা।
শীত পেরোলে আসবে তীব্র গরম। কৃষিপ্রধান মানুষগুলোকে নির্ভর করতে হবে সেচের ওপর। এমনকি এতটাই খরা যে তিস্তা নদীর বুকে চাষ করতেও দিতে হয় সেচ। নদীতে মিলছে ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ, এ তো এখন রূপকথা। নদীর
বুকে যেখানে গভীরতা হওয়ার কথা অতল, সেখানেই ওড়ে ধুলা। পানির যে বড্ড অভাব!
পানির অভাবটাও একসময় থাকে না। এত পানি আসে যে ভাসিয়ে নিয়ে যায় ছোট্ট বাড়িটা। নদী নয়, যেন সমুদ্র। শোবার ঘরটাতে আঘাত হানা দেয় বুক অবধি পানি। বন্যার তোড়ে নদীভাঙনও যেন প্রতিবছরের ঘটনা।
উত্তরের অসহায় মানুষগুলোর জীবনে শীত, খরা ও বন্যা যেন নিত্যবছরের পঞ্জিকা। আসবে, দেখা দেবে, চলে যাবে। ধরে নিই, উত্তরের কোনো জেলার নদীপারের এক পরিবারের চার ভাইয়ের চার স্ত্রী। তিন বউই ভীষণ অভিমানী। প্রতিবছর একবার করে আসেন। অশান্তি দিয়ে আবার বাবার বাড়ি চলে যান। আর বড় ভাইয়ের বউয়ের নাম অভাব। তিনি বাড়িতেই থাকেন।
ধানমন্ডি লেকে কি আপনার যাতায়াত আছে? যদি থাকে খেয়াল করে দেখবেন লেকজুড়ে ভাসমান মানুষের জীবন। দীর্ঘদিন পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি, তাঁরা অতিকষ্টে খোলা আকাশের নিচে থাকেন; কিন্তু তাঁদের খাবার অতীব সুস্বাদু ও মানসম্মত। কারণ উচ্চবিত্তের এই এলাকায় তাঁদের খাবার নিয়ে ভাবতে হয় না। আর শুক্রবারে তো নতুন নতুন লোক ভিড় করেন অর্থ ও খাবারের আশায়।
এই ভাসমান মানুষেরা যা খান উত্তরের গেরস্ত বাড়ির বউয়েরা হয়তো বছরে একবারও রান্না করেন না তা। আর অধিকাংশ মানুষের মাংসের স্বাদ নেওয়া মানে কোরবানির ঈদ।
উত্তরে একেবারে যে উন্নতি হচ্ছে না, তা না। কিন্তু মনে রাখতে হবে, উন্নতির পাশাপাশি অনুন্নয়নের পাল্লায় থেকে যাচ্ছে সিংহভাগ মানুষ। শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে তাঁরা। ঘরে চার-পাঁচ সন্তান যেন স্বাভাবিক বিষয়। আয় ও শিক্ষার অভাবে তাঁরা এখনো ধরে রেখেছেন দরিদ্রতার রশি।
বিনা মূল্যে বই, উপবৃত্তি। এসবের কারণে বাচ্চাদের পা পড়ছে স্কুলের বারান্দায়। তবু তাদের শিক্ষাটা কিন্তু আটকেই আছে। স্কুল আছে, আছে বই-খাতা। নেই শিক্ষিত হওয়ার তাগাদা। ঘরে যে ভাত নিয়ে যুদ্ধ! স্বল্প জমি আছে, আবাদে দিতে হয় সেচ। আঘাত হানে বন্যা। আয়টা হবে কীভাবে?
নেই গ্যাস। গড়ে ওঠেনি শিল্পকারখানা। শ্রমটা দেবেন কোথায় তাঁরা? শুধু বাড়ছে আইল (জমির সীমানা)। বাড়ছে, কারণ বাবার জমির ভাগ হচ্ছে একাধিক। মাটিতে নেই রস। বড়ই বিপদে তাঁরা।
উত্তরে মন্ত্রী আছেন। আগেও ছিলেন। দেশপ্রধানদের উত্তরে পারিবারিক যোগাযোগ আছে, ছিল। তবু এত বিস্তর এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয় মাত্র দুটি। রংপুর ও দিনাজপুরে। ছোট্ট একটা দেশ, কেন এত শৈত্যপ্রবাহ?
পিয়াস সরকার, সাংবাদিক