হোম > ছাপা সংস্করণ

ক্ষমতার দম্ভ কারও স্থায়ী হয় না

মহিউদ্দিন খান মোহন

মানুষের সুদিন-দুর্দিন নদীর জোয়ার-ভাটার মতো। আজ ভালো তো কাল খারাপ। এই সুদিনকে যাঁরা ভালো কাজে লাগান, তাঁরা মানুষের শ্রদ্ধা-ভালোবাসা পান, সমাজে সমাদৃত হন। আর যাঁরা নিজের সুদিনকে অপরের দুর্দিন বানানোর কাজে ব্যবহার করেন, একদিন তাঁকেই দুর্দিনে নিপতিত হতে হয়। আর এর ফলে একসময় ঘটে তাঁদের ভাগ্যবিপর্যয়। মানুষকে বঞ্চিত করে, অবাধ লুটপাটের মাধ্যমে যে প্রাসাদ তাঁরা গড়ে তোলেন, প্রচণ্ড ঝড়ের এক ঝাপটায় তা ভেঙে দুমড়েমুচড়ে যায়। রাজাধিরাজ থেকে মুহূর্তে তিনি পরিণত হন দীনভিখারি কাঙালে। ক্ষমতার দম্ভে যে ব্যক্তিটি একসময় অগণিত মানুষের গৃহ কেড়ে নেন, তাঁকেই একসময় আশ্রয়ের জন্য ছুটতে হয় এ দ্বারে-সে দ্বারে।

সেই একই নজির স্থাপিত হলো দ্বীপদেশ শ্রীলঙ্কায়। দেশটির দোর্দণ্ড প্রতাপশালী ক্ষমতাসীন পরিবারটি এখন রাজ্যহারা, আশ্রয়হারা। একটুখানি নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য তাদের এ দেশ থেকে ও দেশে ছুটে বেড়াতে হচ্ছে। কয়েক মাস আগেও কি কেউ কল্পনা করতে পেরেছিলেন, শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে ক্ষমতাধর পরিবারটির সদস্যদের এমন নিরাশ্রয় হতে হবে? মাহিন্দা রাজাপক্ষে ক্ষমতায় এসেছিলেন গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়েই। ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ শ্রীলঙ্কায় শান্তি প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদান কম নয়। তামিল টাইগারদের নির্মূল করে দেশটিতে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা অস্থিরতাকে দূরীভূত করতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। নজর দিয়েছিলেন দেশটির অবকাঠামোগত উন্নয়নের দিকেও। আর তা করতে গিয়ে ডুব দিয়েছিলেন বৈদেশিক ঋণের সাগরে। যে কারণে প্রবল আর্থিক সংকট ঘিরে ধরেছিল দেশটিকে। অবস্থা এমনই দাঁড়িয়েছিল যে এক দিনও সচল রাখা সম্ভব হচ্ছিল না রাষ্ট্রের চাকা। জ্বালানি, খাদ্যসহ প্রায় সব পণ্যের সংকট শ্রীলঙ্কার জনগণকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। তারা বিদ্রোহ করে রাজাপক্ষে সরকারের বিরুদ্ধে। প্রচণ্ড গণবিক্ষোভের মুখে মাহিন্দা রাজাপক্ষে ক্ষমতা ছেড়ে রাজধানী থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। ক্ষমতা থেকে মাহিন্দা বিদায় নিলেও রয়ে যান তাঁর ভাই দেশটির প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে। প্রচণ্ড গণবিক্ষোভের মুখে অবশেষে তিনিও পদত্যাগ ও দেশ ছেড়ে মালদ্বীপ হয়ে তাঁকে চলে যেতে হয়েছে সিঙ্গাপুর। সেখান থেকে তিনি আনুষ্ঠানিক পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্টের স্পিকারের কাছে। শোনা যাচ্ছে, সিঙ্গাপুর থেকে তিনি সৌদি আরবে পাড়ি জমানোর চিন্তাভাবনা করছেন। গোতাবায়ার পদত্যাগের মধ্য দিয়ে শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রক্ষমতায় দীর্ঘদিনের রাজাপক্ষে পরিবার যুগের অবসান হলো।

একটি পরিবারের স্বেচ্ছাচারিতা, একনায়কতান্ত্রিক শাসন এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয়-লুণ্ঠন একটি দেশকে কীভাবে দেউলিয়া করতে পারে, শ্রীলঙ্কা তার উদাহরণ। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেও পরবর্তী সময়ে মাহিন্দা রাজাপক্ষে হয়ে উঠেছিলেন একনায়ক-স্বৈরশাসক। কায়েম করেছিলেন পারিবারিক শাসন। মন্ত্রিসভা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে রাজাপক্ষে পরিবারের সদস্যদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পে এই পরিবারের সদস্যদের সংশ্লিষ্টতা এবং রাষ্ট্রীয় তহবিলের লুটপাটের বিষয়টি ছিল ওপেন সিক্রেট। রাজাপক্ষের অপশাসনে শ্রীলঙ্কার জনগণ এতটাই বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল যে কোনো রাজনৈতিক দল বা নেতার নেতৃত্ব ছাড়াই তারা বিদ্রোহ করে বসে। শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে রাজাপক্ষে পরিবারের এই উচ্ছেদ দেশটিতে শিগগিরই শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনবে কি না, কিংবা দেশটির রাজনীতি থেকে ওই পরিবারের এটা চির-উচ্ছেদ কি না, তা বলার সময় এখনো আসেনি। যদিও ১৫ জুলাই প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছেন। তবে তিনি কতটা সামাল দিতে পারবেন, তা বলা মুশকিল। ২০ জুলাই শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন হওয়ার কথা। রনিল তাতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। নির্বাচনে যিনিই প্রেসিডেন্ট হোন, তিনি বর্তমান বিশৃঙ্খল শ্রীলঙ্কায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে কতটা সক্ষম হবেন—বলা মুশকিল। কেননা, অন্ন-বস্ত্রসহ জীবন ধারণের জরুরি অনুষঙ্গের অভাবে ওষ্ঠাগত-প্রাণ লঙ্কানরা এখন আর কাউকেই মানতে চাইছে না। সবচেয়ে কঠিন কাজ হলো এই বিক্ষুব্ধ এবং উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে নিয়ন্ত্রণে আনা। সেটা কীভাবে সম্ভব, তা নিয়ে বিশ্বজুড়ে চলছে নানা আলোচনা, বিশ্লেষণ। অবশ্য সময়ই তার উত্তর দেবে।

বিশ্ব ইতিহাসের দিকে নজর ফেরালে আমরা এমন অনেক ঘটনারই নজির দেখতে পাই। বহু শাসক তাদের স্বেচ্ছাচারিতা বা স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের দ্বারা একটা সময় পর্যন্ত ক্ষমতার প্রাসাদ টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হলেও একপর্যায়ে তা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে। কোনো কিছুই আর সে প্রাসাদকে টিকিয়ে রাখতে পারে না। ইরানের পরাক্রমশালী শাহেনশাহ রেজা শাহ পাহলবির কথা নিশ্চয়ই সবার মনে আছে। কী দোর্দণ্ড ক্ষমতাধর শাসকই না ছিলেন তিনি! দীর্ঘ ৩৮ বছর প্রবল পরাক্রমে ইরানের রাজসিংহাসন দখলে রাখলেও শেষ পর্যন্ত বিদায় নিতে বাধ্য হন জনবিক্ষোভের মুখে। ক্ষমতা থেকে বিদায় নেওয়া এই স্বৈরশাসককেও বিতাড়িত হতে হয়েছিল দেশ থেকে। আশ্রয় নিতে হয়েছিল মিসরে। সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। এমনকি মৃত্যুর পর তাঁর লাশ দাফনের জন্যও ইরানে আনা সম্ভব হয়নি। বিংশ শতাব্দীর আরেক সাড়া জাগানো স্বৈরশাসক ছিলেন ফিলিপাইনের ফার্দিনান্দ মার্কোস। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত একজন সরকারপ্রধান যে কতটা নিষ্ঠুর স্বৈরশাসকে পরিণত হতে পারে, মার্কোস তার দৃষ্টান্ত। ১৯৬৫ সালে ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় ছিলেন ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত। যদিও ১৯৭২ সাল থেকে তিনি দেশ শাসন করছিলেন সামরিক আইনের দ্বারা। ১৯৮৩ সালে ম্যানিলা এয়ারপোর্টে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনীতিক বেনিগনো অ্যাকুইনোর হত্যাকাণ্ডের পর মার্কোস প্রচণ্ড জনবিক্ষোভের মুখে পড়েন। তারপর নির্বাচনে কারচুপিকে কেন্দ্র করে নিহত অ্যাকুইনোর স্ত্রী কোরাজন অ্যাকুইনোর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা তীব্র গণ-আন্দোলনের মুখে তাঁর ক্ষমতাচ্যুতি ঘটে। দেশত্যাগে বাধ্য হন তিনি। আশ্রয় জোটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানেই তাঁর জীবনাবসান হয়। বলা হয়ে থাকে, তাঁর শাসনামলে তাঁর চেয়ে ক্ষমতাধর ছিলেন স্ত্রী ইমেলদা মার্কোস; যাঁর হুংকারে বাঘে-মোষে এক ঘাটে জল খাওয়ার অবস্থা ছিল। কিন্তু সময় তাঁদের ক্ষমা করেনি। নিক্ষিপ্ত হতে হয়েছে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে। সেই মার্কোসের ছেলে ‘মার্কোস জুনিয়র লিমা দোস সান্তোস’ ওরফে ‘বং বং মার্কোস’

এ বছর জুন মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। এখন দেখার বিষয় হলো তিনি তাঁর পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে ফিলিপাইনে পুনরায় স্বৈরশাসন কায়েম করেন, নাকি পিতার পরিণতি থেকে শিক্ষা নিয়ে একজন গণতান্ত্রিক সরকারপ্রধান হিসেবে নিজেকে পরিচিত করেন। রোমানিয়ার প্রেসিডেন্ট নিকোলাই চসেস্কু ছিলেন মহাপ্রতাপশালী শাসক। একনায়কত্ব কায়েম করে রোমানিয়াকে শাসন করেছিলেন দীর্ঘদিন। অবশেষে ১৯৮৯ সালে গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন। তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। জেনারেল আইয়ুব খান পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ১০ বছর স্বৈরশাসনের দণ্ড ঘুরিয়ে পাকিস্তানের গদি দখলে রাখলেও ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন। তারপর পাকিস্তানের রাজনৈতিক দৃশ্যপট থেকে তাঁর চিরবিদায় ঘটে। উগান্ডার প্রেসিডেন্ট ইদি আমিন, মধ্য আফ্রিকার সম্রাট বোকাসা, চিলির স্বৈরশাসক অগাস্তো পিনোশে—তাঁরা সবাই মনে করেছিলেন তাঁদের ক্ষমতা বুঝি চিরস্থায়ী। তাই স্বেচ্ছাচারিতা ও জুলুম-নির্যাতনের মাধ্যমে জনগণের ঘৃণাই শুধু কুড়িয়েছিলেন। আর সে ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল তাঁদের শোচনীয় পতনের মধ্য দিয়ে।

পৃথিবীর ইতিহাসে এমন অনেক দুঃশাসকের দেখা পাওয়া যাবে, যাঁদের পরিণতি ভালো হয়নি। কেউ দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে, কেউ নিজের জীবন দিয়ে কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্ত করে গেছেন। তাঁরা যখন রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন, তখন ভেবেছিলেন সামনের দিনগুলোও বোধকরি এমনিভাবে যাবে। কিন্তু ওই যে কবি নজরুলের গানের বাণীর মর্মার্থ—চিরদিন কাহারো সমান যায় না...। ক্ষমতা হাতে থাকতে এ সত্যটি অনেকেরই মনে থাকে না। যখন সময় ঘনিয়ে আসে, তখন করার আর কিছুই থাকে না। যুগে যুগে এমনটিই ঘটে আসছে। চোখের সামনে জলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত থাকতেও কেউ সাবধান হয় না, সংযত হয় না। কারণ কথায় আছে, ‘ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা গ্রহণ করে না’।

লেখক: সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ