ধর্ম বিষয়টি সারা বিশ্বেই ইদানীং চোখে পড়ার মতো বড় বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সেই সঙ্গে ধর্মের মূল শান্তির বাণীকে অগ্রাহ্য করে একহাত দেখে নেওয়ার প্রবণতাও দেখা যাচ্ছে বেশি। খোদ যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে উগ্র খ্রিষ্টান মতাবলম্বীদের উত্থান ঘটছে, পাশের দেশ ভারতে উগ্র হিন্দুত্ববাদের প্রসার ঘটছে, আমাদের দেশও জঙ্গিবাদী তৎপরতা আর ইসলামের ভুল ব্যাখ্যার হাত থেকে মুক্ত নয়। যেকোনো সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, যে কথাগুলো ধর্মের নামে বলা হচ্ছে, তার অনেক কিছুই কথকের মনগড়া।
মৌলবাদ ইসলামের নিজস্ব সম্পত্তি নয়। যুক্তরাষ্ট্রে প্রোটেস্ট্যান্টরা, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ক্যাথলিকেরা, ইসরায়েলে ইহুদিরা, ভারতের শিবসেনা-আরএসএস ধরনের সংগঠনগুলোও কট্টর দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ক্রিয়াশীল। অনেকে তো বলে থাকেন, জন ম্যাককেইন রিপাবলিকান পার্টি থেকে মনোনয়ন পাননি স্রেফ এই উগ্র মৌলবাদের বিপক্ষে থাকায়, ফলে সে সময় রিপাবলিকান পার্টি থেকে মনোনয়ন পেয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। আর হোয়াইট অ্যাংলো-স্যাক্সন প্রোটেস্ট্যান্টদের কাজ-কারবার জানার জন্য একটু গুগলের শরণাপন্ন হলেই চলবে।
আমাদের উপমহাদেশে ধর্মকে ব্যবহার করে নানা সময় যে ফায়দা লোটার চেষ্টা করা হয়েছে, তা প্রতিরোধ করা হয়েছে দৃঢ়ভাবেই। কিন্তু যাঁরা প্রতিরোধ গড়েছেন, তাঁদেরও কেউ কেউ এই ধর্মব্যবসাকে আক্রমণ করতে গিয়ে খোদ ধর্মকেই আক্রমণ করে বসেছেন। ধর্মের সঙ্গে সংস্কৃতিকে যুদ্ধের ময়দানে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। এ কারণে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও দেশের জনগণকে বিভ্রান্ত করতে পারছেন ধুরন্ধর ধর্মব্যবসায়ীরা। তাঁরা ইসলামকে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছেন।
অথচ ব্যাপারটা এ রকম নয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদের ওপর ভর করে পাকিস্তানি অপশাসন থেকে মুক্ত হতে চেয়েছিল এই দেশ। পাকিস্তানিরা ধর্মকে করেছিল হাতিয়ার। যে কারণে পাকিস্তান ভাগ হলে ইসলাম বিপন্ন হবে—এ রকম কথাও বলেছিলেন পাকিস্তানপন্থী রাজনীতিবিদদের কেউ কেউ। মুক্তিযুদ্ধের পরও সেই পথ থেকে সরে আসেনি অনেকে। ফলে বিএনপির নির্বাচনী প্রচারাভিযানে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে মসজিদে উলুধ্বনি শোনা যাবে। কতটা অবিবেচক হলে এ ধরনের বক্তৃতা দেওয়া যায়, সেটা আমলেই নেওয়া হয়নি। স্রেফ নির্বাচনে জয়লাভ করার অভিপ্রায়ে এ দেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীকে উত্তেজিত করতে চেয়েছে একটি রাজনৈতিক দল! অথচ সেই নির্বাচনে জয়লাভ করেছিল আওয়ামী লীগ এবং সত্য হলো, আওয়ামী লীগের বিজয়ের পর মসজিদ থেকে উলুধ্বনি শোনা যায়নি। মুসলমানরা স্বচ্ছন্দেই মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করেছেন।
ধর্ম ও সংস্কৃতিকে যুদ্ধের মাঠে দাঁড় করিয়ে দিলে লাভ হয় কার? সব ধরনের ভণ্ডের তাতে লাভ হয়। শুধু ধর্মব্যবসায়ীদের নয়, রাজনীতি ব্যবসায়ী, সংস্কৃতি ব্যবসায়ীদেরও লাভ হয়। কারণ, বিবদমান দুই পক্ষই জনগণকে বিভ্রান্ত করে ফায়দা লুটতে পারে। ইতিহাস-বিস্মৃত করে দিতে পারলে জনগণ আর কোনো প্রশ্ন তোলে না। প্রশ্ন না তুললেই এই ধূর্ত মানুষেরা অবাধে তাদের দুষ্কর্মগুলো করে যেতে পারে। কথার ছল-চাতুরীতে মানুষের মস্তিষ্কের ওপর এক মায়াজাল বিস্তার করে তারা অনেকটা ‘মগজধোলাই’-এর কাজটা করে ফেলে। তখন শোনা কথাতেই বিশ্বাস স্থাপন করে সাধারণ মানুষ, যাচাই-বাছাইয়ের ধার ধারে না।
ইদানীং আমাদের ইতিহাসে হিন্দু-মুসলিম সংকট নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে। কেউ একজন শেষ কথা বলে দেবে এবং সবাই তা মেনে নেবে, এমনটা হয়তো হবে না। কিন্তু এ কথা তো সত্য, আমাদের ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার মূল খুঁজতে হলে যেতে হবে ইতিহাসের গভীরে। একটি দেশে বাইরে থেকে একটি ধর্মবিশ্বাসের মানুষ এল এবং বিশালসংখ্যক মানুষ সেই ধর্ম গ্রহণ করল, এ তো ইতিহাসের বিশাল গবেষণার বিষয়। গবেষণা একেবারে হয়নি, তা নয়। কিন্তু একমত হননি বিশেষজ্ঞরা। নানা মতবাদের মধ্যে কোনটা বেছে নেওয়া যায়, তা নিয়েও নানা জনের নানা মত।
তবে, ইতিহাস পর্যালোচনায় ধারণা করি, মূলত বাংলার খেটে খাওয়া মানুষ অন্য ধর্মবিশ্বাস (হিন্দু, বৌদ্ধ, লোকায়ত) থেকে সরে এসে মুসলমান ধর্মে বিশ্বাস এনেছে। বাইরে থেকে যারা এসেছে, তাদের সংখ্যা ছিল ধর্মান্তরিত মুসলমানদের চেয়ে অনেক কম। সুফিবাদের বিকাশের মাধ্যমে, ইসলাম ধর্মের সাম্যের প্রতিশ্রুতিতেই মূলত এই ধর্মান্তর প্রক্রিয়া ঘটেছে। তলোয়ারের জোরেও কিছু মানুষকে হয়তো ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য করা হয়েছে। কিন্তু স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে ধর্মের কোনো সংঘাত বাধেনি। লোকাচারকে জীবন থেকে বিদায় করে দেওয়ার কথা ভাবতে হয়নি। এই ভূখণ্ডে সেটা ছিল জনগণের শক্তি।
শুরুতে এ দেশে ইসলাম ছিল মিশ্র, সহনশীল। মৌলবাদী ইসলামের আগমন ঘটে মোগল শাসনের শেষদিকে। এর আগে ইসলামীকরণের একপর্যায়ে মিশ্র ধর্মবিশ্বাসের সৃষ্টি হয়েছিল। লৌকিক ধর্মবিশ্বাস আর ইসলামের মধ্যে একটা সমঝোতাও গড়ে উঠেছিল। মনে রাখতে হবে, দীর্ঘ সময় মোগলরা শাসন করার পরও সে সময় ভারতে ধর্মীয় ও সামাজিক সহনশীলতা ছিল। তবে মোগল সাম্রাজ্যের পতনকে মুসলমানরা নিজেদের পরাজয় হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করেছিল। অথচ প্রত্যন্ত অঞ্চলের হিন্দু-মুসলমানের সঙ্গে রাজরাজড়াদের গভীর কোনো সম্পর্ক ছিল না। রাজা-বাদশাহদের কাছে ‘যাহা মুসলমান, তাহাই হিন্দু ছিল’। এই জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে খাজনা আদায় করতে হয়।
ব্রিটিশের হাতে ক্ষমতা যাওয়ার পর মুসলিমরা নিজেদের পরাজিত বলে ভাবতে লাগল। ইংরেজি শিক্ষাকে গ্রহণ করল না। এর সুযোগ নিল ভারতীয় হিন্দুরা। ব্রিটিশরা কীভাবে ভারতের প্রধান দুই সম্প্রদায়কে ভাগ করে শাসন চালিয়ে গেল, সে ইতিহাসও সবার জানা। সেখানে এসে খুঁজতেই পাওয়া যাবে দুই সম্প্রদায়ের পারস্পরিক ঘৃণার প্রকৃত বীজটা।
দেশভাগের সময় ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের পক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুসলমান সম্প্রদায়। হিন্দু জমিদারদের কাছ থেকে জমির মালিকানা চলে আসবে মুসলমানদের হাতে, অর্থনৈতিকভাবে সুখে-শান্তিতে বসবাস করবে মুসলিমরা—এটাই ছিল মূলত পাকিস্তান কায়েমের পক্ষে মুসলমানদের মূল ভাবনা। ধর্মীয় কারণে নয়, অর্থনৈতিক কারণেই মুসলিমরা পাকিস্তান চেয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ইসলামের নাম ভাঙিয়ে যে অনাচার, অত্যাচার, শোষণ করতে লাগল, তাতে বাঙালির মোহভঙ্গ হতে সময় লাগেনি। ইসলামকে রাজনীতির স্বার্থে ব্যবহার করা শুরু হলে তার বিরুদ্ধেই দাঁড়িয়ে গেল তৎকালীন পূর্ববঙ্গের মানুষ। বাঙালি জাতীয়তাবাদের আলোকে সে খুঁজতে শুরু করল নিজের পরিচয়। লক্ষণীয়, কোনো ধর্মকেই খাটো করে দেখার কথা ভাবেনি তৎকালীন স্বায়ত্তশাসনপিয়াসী মানুষ। সবচেয়ে বড় কথা, সব ধর্মের সব মানুষের জন্য বাসযোগ্য দেশ গড়ার অঙ্গীকার ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফার মধ্যে যে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের কথা উঠে এসেছিল, তাতেও ছিল সবার মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। বাঙালি জাতীয়তাবাদের সাফল্যের অন্তর্নিহিত কারণ হলো জাতির অভ্যন্তরীণ সংহতি গড়ে তোলা গিয়েছিল এবং অন্য জাতি থেকে এই জাতির ভিন্নতা নির্ণয় করে তা দিয়ে জনগণকে সচেতন করে তোলা গিয়েছিল। কেন ও কী কারণে পাকিস্তানের অন্যান্য জাতি থেকে বাঙালিরা ভিন্ন, কোন কোন সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে তাকে ভিন্ন একটি রাষ্ট্র গড়ে তুলতে হবে, সেটা আপামর বাঙালির কাছে পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল।
এ রকম একটি জায়গায় আসার পর কেন মানুষ বিভ্রান্ত হলো, সেটা কোটি টাকার প্রশ্ন। ধর্ম ও সংস্কৃতিকে, এমনকি বিজ্ঞানকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়ার ঘটনা তো স্বাভাবিক কিছু নয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ এখনো টিকে আছে। গণ শব্দটি কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সম্পত্তি নয়, এটি সব জনগণের। এই আবাসভূমিতে সব ধর্মের মানুষ স্বাধীনভাবে বসবাস করবে। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, সে বিশ্বাসে চিড় ধরেছে। এর দায় পুরোপুরি মৌলবাদের ওপর চাপিয়ে দিলে হবে না। নিজেদের ব্যর্থতাগুলোও খতিয়ে দেখতে হবে। মৌলবাদের উত্থান হলো কোন পথে, আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও অভ্যন্তরীণ রাজনীতির অভিঘাতে আমরা সব সময় নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেছি কি না, সে প্রশ্নেরও উত্তর খুঁজতে হবে। শুধু বাঙালি নয়, এই ভূখণ্ডে বসবাসকারী প্রত্যেক জাতি-ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসহ সবার জন্য বসবাসযোগ্য করে তুলতে পারলাম না কেন, সেটাও দেখতে হবে। অন্যের শোষণ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য দেশ স্বাধীন করা হলো, অথচ শোষণমুক্তি কি আদৌ ঘটেছে? কেন ঋণখেলাপি, ব্যাংক উজাড় করে হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎকারীদের রমরমা, সেটাও খতিয়ে দেখতে হবে। দেশ তো মানবশরীরের মতোই, একটা যন্ত্র বিকল হলে অন্য সব যন্ত্রেই তার প্রতিক্রিয়া হয়। আমরা তো সেই গাড্ডায়ই পড়ে গেছি।
নিজের যুক্তিনির্ভর বিশ্বাসকে বিভ্রান্ত হতে দেওয়া যাবে না। কিন্তু এ মুহূর্তে সব মহলেই যে অধঃপতন ঘটেছে, তাতে দেশপ্রেমী হওয়াটাই সবচেয়ে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিবারে, বিদ্যায়তনে যে শিক্ষা দেওয়ার কথা ছিল, সে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে না। অন্য ধর্ম বা সম্প্রদায় সম্পর্কে ঘৃণাও ছড়ানো হচ্ছে এই দুই প্রতিষ্ঠানে। তাই কিছুদিন পর পর এমন সব বিষয় নিয়ে আমাদের আলোচনা করতে হচ্ছে, মনে হচ্ছিল বহু আগেই যার সমাধান হয়ে গেছে। আমাদের ট্র্যাজেডির শুরু এখানেই।