দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে সামনের কয়েকটি মাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় যেতে আওয়ামী লীগের সর্বাত্মক চেষ্টার বিপরীতে রাজপথ দখলে নিতে মরিয়া ১৬ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি। বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার অবস্থানে দলটি অনড়। সে কারণেই নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলন করছে দলটি। কিন্তু নির্বাচন ও আন্দোলনের বছরেও লক্ষ্য অর্জনের চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে উঠতে পারেনি তারা। ফলে চলমান আন্দোলনের সফলতা ও নির্বাচন নিয়ে দলীয় নেতা-কর্মীদের সংশয় কাটছে না। বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা যদিও প্রকাশ্যে দাবি করছেন, আন্দোলন ও নির্বাচনের বিষয়ে দলের প্রস্তুতি ও সক্ষমতা যথেষ্ট।
আন্দোলনে জনসম্পৃক্ততা বেড়েছে বলে দাবি করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন।
তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপ দেখতে জনগণ প্রতীক্ষা করছে। জনগণই চাইছে, আমরা জনগণের সঙ্গে আছি। আমাদের নেতা-কর্মীরা মাঠে আছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই সরকারের অধীনে আমরা নির্বাচনে যাব না, এটা পরিষ্কার। তবে নেতা-কর্মীরা সক্রিয় রয়েছেন। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যেকোনো সময় নির্বাচন করার জন্য বিএনপি প্রস্তুত। জনগণ ভোট দিতে পারলে বিএনপি অবশ্যই বিজয়ী হবে।’
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, বিএনপি চলমান সরকারবিরোধী আন্দোলনকে সরকার পতনের ‘সর্বাত্মক’ আন্দোলনে রূপ দিতে চায়। ঈদুল ফিতরের পর থেকে মাঠ গরম করার মহড়া দেওয়ার পরিকল্পনা আছে তাদের। সম্প্রতি দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মে দিবসের কর্মসূচি ঘিরে রাজধানীসহ সারা দেশে ব্যাপক শক্তিসমাবেশ ঘটানোর পরিকল্পনা আছে। দলের শীর্ষ নেতৃত্বের প্রত্যাশা—বিএনপি এই ‘শোডাউন’ থেকে নতুন উদ্যমে যাত্রা শুরু করবে। আর ছোট-বড় কর্মসূচি পালনের মধ্য দিয়ে বছরের মাঝামাঝি অথবা তার কিছু সময় পরে আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে যাবে। চূড়ান্ত আন্দোলনে সরকারের পতন ঘটিয়ে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর পরিকল্পনা দলের নীতিনির্ধারকদের।
আন্দোলন জোরদার হওয়ার লক্ষণ নেই
নেতৃত্বের এমন প্রত্যাশাকে চোখ রাঙাচ্ছে নানামুখী চ্যালেঞ্জ। দলীয় নেতা-কর্মীদের কথায়ই উঠে আসছে এসব চ্যালেঞ্জের কথা। তাঁরা বলছেন, আগামী নির্বাচন ও আন্দোলনের পথে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা নিয়ে দলে সংশয় আছে। যদিও শাস্তির ভয়ে নাম-পরিচয় প্রকাশ করে কেউ কিছু বলতে সাহস পান না।
বিএনপির কেন্দ্রীয় এক ভাইস চেয়ারম্যান নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘কেমনে কি? কীভাবে সম্ভব? কীভাবে আন্দোলন জোরদার হবে, লক্ষণ তো দেখি না।’
বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা বেশ আগেই দিয়েছে বিএনপি। গত ডিসেম্বর থেকে সরকারবিরোধী বেশ কয়েকটি দল সরকারের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন করছে। কিন্তু এখনো এই দাবি সরকারের কাছে পাত্তা পায়নি। দাবির পক্ষে জনমতও গড়ে ওঠেনি সেভাবে। এমনকি দলের মধ্যেই কেউ কেউ এর বিপক্ষে কথা বলছেন। তাঁদের কাউকে কাউকে বহিষ্কারও করা হয়েছে। এমনকি ‘জাতীয় সরকার’ নাকি ‘নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার’—সে নিয়ে এখনো বোঝাপড়া পাকা হয়নি যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলোর মধ্যে।
বিএনপির একাধিক নেতা মনে করেন, সরকারের অধীনে বিএনপির নির্বাচনে যেতে না চাওয়ার মূল কারণ হচ্ছে সাংগঠনিক দুর্বলতা। ক্ষমতাসীনদের প্রভাবকে টেক্কা দিয়ে মাঠ দখলের ক্ষমতা নেতা-কর্মীদের নেই। সক্ষমতা বাড়ানোর যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেখান থেকেও ভালো কিছু আসেনি। ঢাকঢোল পিটিয়ে শুরু করা যুগপৎ আন্দোলনও জমেনি। উল্টো এরই মধ্যে নানা বিষয়ে মিত্রদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দিয়েছে। বিএনপির ১০ দফা দাবি আর ২৭ দফা রূপরেখার সঙ্গে গণতন্ত্র মঞ্চের ১৪ দফার সমন্বয়ে যুগপৎ আন্দোলনের ৭ দফা একটি খসড়া ঘোষণাপত্র প্রণয়ন করা হয়েছে। তবে বিষয়টি নিয়ে অন্য দল ও জোটের আপত্তির বিষয়টি তারা বিএনপির সঙ্গে বৈঠকেই জানিয়েছে। সে কারণে যুগপৎ আন্দোলনের যৌথ ঘোষণাপত্র প্রকাশ করতে দেরি হচ্ছে।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল অবশ্য দাবি করেন, আন্দোলন ও নির্বাচন বিষয়ে বিএনপির প্রস্তুতি আছে। যেকোনো সময়ের চেয়ে দল এখন সাংগঠনিকভাবে অনেক চাঙা। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বিএনপি নির্বাচনের জন্য ১২ মাসই প্রস্তুত আছে। যেকোনো ধরনের নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত। কারণ, প্রার্থী বাছাই করতে সময় লাগবে না।’ সর্বাত্মক আন্দোলন কবে নাগাদ গড়ে উঠতে পারে, জানতে চাইলে আলাল বলেন, ‘কখনোই বলেকয়ে কিছু হয় না। টাইমফ্রেম দিয়ে হয় না। পরিস্থিতি অনুযায়ী আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ নেবে।’
কাজে দিচ্ছে না বিদেশমুখী তৎপরতা
আন্দোলন ও নির্বাচন ঘিরে গত কয়েক মাসে দফায় দফায় বিদেশিদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা। বৈঠকে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে বিভিন্ন সময়ে দলের নেতাদের নিখোঁজ হওয়াসহ নেতা-কর্মীদের ওপর মামলা-হামলা-নির্যাতনের বিষয় তুলে ধরা হয়। একই সঙ্গে আগের দুই নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ এনে বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার দাবির পক্ষে বিদেশিদের সমর্থন কামনা করা হয়। কিন্তু বিদেশি কূটনীতিকদের পক্ষ থেকে এ দাবির পক্ষে এখনো ন্যূনতম সমর্থন মেলেনি।
ধরপাকড়ের আতঙ্ক
নির্বাচন ও আন্দোলনের বছরে বিএনপিতে নতুন করে হামলা-মামলা ও ধরপাকড়ের ভয় দেখা দিয়েছে। গত বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘এই সরকার নির্বাচনের আগে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে বিএনপিকে নেতৃত্বশূন্য করার মহাপরিকল্পনা করেছে। এই পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে বিএনপির শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে মিথ্যা মামলায় সাজা দিয়ে আটক করা, আটকে রাখা। জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতাদের সাজা দিয়ে আটক রাখা। ইতিমধ্যেই তারা (সরকার) শুরু করেছে।’