১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের ক্র্যাকডাউনের পর পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু হলেও মুক্তিযোদ্ধারা আগস্টের আগে নিজেদের পূর্ণাঙ্গরূপে সংগঠিত করতে পারেননি। প্রবাসী সরকার গঠনের পর সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে সেক্টরভিত্তিক যুদ্ধ শুরু হলেও দেশের বিভিন্ন অংশে স্থানীয় পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা নিজেরা সংগঠিত হয়ে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। এলাকাভিত্তিক গড়ে ওঠা মুক্তিযোদ্ধাদের এসব দল আঞ্চলিক বাহিনী হিসেবেই পরিচিত। এসব বাহিনী ভারত সরকার, বাংলাদেশ সরকার কিংবা সেক্টর হেডকোয়ার্টার্সের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থেকে এবং তাদের কাছ থেকে কোনো ধরনের সমর্থন বা সাহায্য ছাড়াই নিজ উদ্যোগে গড়ে উঠেছিল। মুক্তিযুদ্ধকালীন এসব বাহিনীর সদস্যরা স্থানীয় লোকজনকে মোটিভেট করে, তাঁদের মনোবল চাঙা করে আঞ্চলিক বাহিনীতে যোগদানে উৎসাহিত করেছিলেন। সম্পূর্ণ ব্যক্তি-প্রচেষ্টায় স্থানীয় লোকজনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় এসব বাহিনী শুধু গড়েই ওঠেনি; মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত দেশের মাটিতে থেকেই পাকিস্তানি হায়েনা ও এ-দেশীয় দালালদের বিরুদ্ধে তারা যুদ্ধ চালিয়ে গেছে। এই বাহিনীর প্রশিক্ষণ, অস্ত্র ও যুদ্ধের রসদ স্থানীয়ভাবেই জোগান বা সংগ্রহের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। হানাদারদের সঙ্গে যুদ্ধ করে দখল করা অস্ত্র ও রসদই ছিল তাদের অস্ত্র জোগানের মূল উৎস। এসব আঞ্চলিক বাহিনীর মধ্যে কাদেরিয়া বাহিনী, হেমায়েত বাহিনী, আকবর বাহিনী, লতিফ মির্জা বাহিনী, জিয়া বাহিনী ও বাতেন বাহিনীর নাম বেশি শোনা যায়। এ ছাড়াও অনেক ক্ষুদ্র মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপ ছিল, যারা সেক্টর বা সাব-সেক্টরের বাইরে থেকে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে গেছে।
ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এবং তাদের দেওয়া অস্ত্র নিয়ে সেক্টরের অধীন থেকেই যুদ্ধ করেছেন—এমন অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছেন, যাঁরা নিজ গুণাবলি ও সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করে পাকিস্তানি বাহিনী ও স্থানীয় দালালদের নাস্তানাবুদ করে তুলেছিলেন। উপর্যুপরি আক্রমণ করে শত্রুর অপারেশনাল ও লজিস্টিকস মুভমেন্টও বিপজ্জনক করে তুলেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালে সুনামগঞ্জে বীর মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি দাসের ‘দাস পার্টি’ এবং দিনাজপুরের ‘জর্জ বাহিনী’ এর মধ্যে অন্যতম। মুক্তিযুদ্ধের বীর মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি দাস বীর বিক্রম ১৯৭১ সালের ১৬ নভেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ সমরে নিহত হয়েছিলেন। মৃত্যুর পর তাঁর মৃতদেহের ওপর যে পৈশাচিক আচরণ করা হয়েছিল, তা সত্যিই অবর্ণনীয়। জগৎজ্যোতি প্রকৃত অর্থেই একজন সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।
তিনি বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত যোদ্ধাদের নিয়ে গঠিত একটি চৌকস গেরিলা দলের কমান্ডার ছিলেন। তাঁর নামের শেষাংশ নিয়েই তাঁদের এ দলটির নাম দেওয়া হয়েছিল ‘দাস পার্টি’। মুক্তিযুদ্ধকালীন মাত্র ৩৬ সদস্য নিয়ে গঠিত দাস পার্টি উল্লিখিত এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ওপর প্রচণ্ড প্রভাব বিস্তার করতে সমর্থ হয়েছিল। ভৈরব-সুনামগঞ্জ নৌপথটি ছিল পাকিস্তানিদের লজিস্টিকস সাপ্লাই রুট। দাস পার্টির অব্যাহত অভিযানের মুখে পাকিস্তানিরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত নৌচলাচল বন্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছিল। জগৎজ্যোতি যোগ্য নেতৃত্ব দিয়ে দিরাই, শাল্লা, রানীগঞ্জ ও কাদিরগঞ্জ এলাকায় সফল অভিযান চালিয়ে অসংখ্য রাজাকার সদস্যকে আটক করেন। সত্যিকার অর্থেই গেরিলাযুদ্ধবিদ্যায় তিনি ছিলেন পারদর্শী। একক চেষ্টায় মাত্র একটি হালকা মেশিনগান নিয়ে তিনি জামালগঞ্জ থানা দখল করে নেন। মাত্র এক সেকশন (১০-১২ জন) গেরিলা যোদ্ধা নিয়ে তিনি শ্রীপুর ও খালিয়াজুরী শত্রুমুক্ত করেন। মোটকথা, মুক্তিযুদ্ধকালে বিস্তীর্ণ ভাটি অঞ্চলে জগৎজ্যোতি ও তাঁর দাস পার্টি পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও রাজাকারদের কাছে মূর্তিমান এক আতঙ্কের নাম ছিল।
বিস্মৃতপ্রায় এমনই এক মুক্তিযোদ্ধার নাম জর্জ জে এম দাস। যাঁর নেতৃত্বে স্বতন্ত্র একটি দল দিনাজপুরে বেশ দাপটের সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলাযুদ্ধ করে মুক্তিযুদ্ধে উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছে। তাঁর নামে নাম ‘জর্জ বাহিনী’র তিনিই ছিলেন প্রধান। তিনি তৎকালীন ইপিআরের একজন সাবেক সদস্য। ১১ বছরের চাকরিজীবন শেষে শারীরিক অসুস্থতার জন্য ল্যান্স করপোরাল হিসেবে অবসর নেন। তিনি অস্ত্রচালনা প্রশিক্ষণ, ফিল্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ওপর বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিলেন। এ কারণে তিনি এক্সপ্লোসিভ সম্পর্কে ভালো জ্ঞান রাখতেন, যা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বিশেষ কাজেও লেগেছে। এই অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধার জন্ম দিনাজপুর জেলার বিরল উপজেলায়। তাঁর পিতার নাম পিটার ডিসি দাস। জর্জ দাস সবার বড়। তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে চার ছোট ভাই—জেমস এম দাস, রবার্ট আর এন দাস, জন এস কে দাস ও অ্যান্টনি এন দাসও মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। একই পরিবারের সব সন্তান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে এক অন্যান্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছিলেন তাঁরা।
১৯৭১ সালের মার্চ মাসের প্রথম থেকেই জর্জ দাস স্বাধীনতাসংগ্রামে জড়িয়ে পড়েন। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে দিনাজপুরের তরুণদের অস্ত্র প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর দিনাজপুরে রাজনৈতিক নেতারা সিদ্ধান্ত নেন জেলার তরুণদের অস্ত্র প্রশিক্ষণের। সে সময় আনুমানিক ৫০০ তরুণকে বিভিন্ন পর্বে গোপনে অস্ত্রচালনার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। জর্জ দাসকে তখন সেই প্রশিক্ষণের সার্বিক দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। জর্জ দাস নিজস্ব অভিজ্ঞতার আলোকে এই তরুণদের প্রশিক্ষণ দেন। উল্লেখ্য, জর্জ দাসের অধীন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অধিকাংশ তরুণই পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
ইপিআরের সাবেক সদস্য হিসেবে দিনাজপুরের কুঠিবাড়িতে ইপিআর সেক্টর হেডকোয়ার্টার্সের বাঙালি সৈনিকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল জর্জ দাসের। তখন সেখানকার বাঙালি জোয়ানদের মধ্যে সুবেদার আরব আলী, হাবিলদার ভুলু, হাবিলদার আবু সাঈদ, হাবিলদার নাজেম জর্জের মাধ্যমে দিনাজপুরের স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন। ২৫ মার্চ ঢাকায় ক্র্যাকডাউনের পর থেকে কুঠিবাড়িতে অবস্থিত বাঙালি জোয়ানরা অস্ত্রাগারের অস্ত্র লুট করে বিদ্রোহ করার পরিকল্পনা করেন। তাঁদের এই পরিকল্পনায় জর্জ দাসও তাঁর এক ভাইসহ শামিল হন। পরিকল্পনা মোতাবেক ইপিআরের সদস্যরা অস্ত্র লুট করে বিদ্রোহ করলে, জর্জ দাস স্থানীয় বাঙালি তরুণদের একত্র করে এই বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করবেন।
পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৭ মার্চ বেলা ৩-৪টার মধ্যে অবাঙালি জোয়ানরা কিছু বোঝার আগেই প্রচণ্ড গোলাগুলির মাধ্যমে ক্যাম্প দখল করে নেন এবং ক্যাম্পে অবস্থিত সব অবাঙালি সদস্যকে হত্যা করেন। জর্জ পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী তাঁর দলবল নিয়ে বিদ্রোহে যোগ দেন এবং কুঠিবাড়ির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিতে বাঙালি জোয়ানদের সাহায্য করেন। কুঠিবাড়ি বিদ্রোহের পর ইপিআর সদস্য ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের অব্যাহত চাপে পাকিস্তানিরা দিনাজপুর ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। দিনাজপুর ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত শত্রুমুক্ত ছিল। ১২ এপ্রিল সৈয়দপুর সেনানিবাস থেকে সাঁজোয়া গাড়ি ও ট্যাংক নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর পাকিস্তানিরা আক্রমণ করে। একই দিন দিনাজপুরের দশমাইল এলাকায় উভয় পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড লড়াই হয়। জর্জ দাসও জীবনবাজি রেখে তাঁর দলবল নিয়ে শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। কিন্তু শত্রুর ট্যাংক, মর্টার ও কামানের গোলাবর্ষণের মুখে টিকতে না পেরে পিছু হটেন এবং শেষ পর্যন্ত রামচন্দ্রপুর ও কিশোরগঞ্জ বর্ডার আউট পোস্ট (বিওপি) হয়ে ভারতের রাধিকাপুরে আশ্রয় নেন।
ভারতে যাওয়ার পর জর্জ দাসকে ৬ নম্বর সেক্টরের অধীন শিববাড়ি ক্যাম্পের ইনচার্জ করা হয়। তিনি শিববাড়ি ইয়ুথ ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের দায়িত্ব পান। জর্জ দাসের গেরিলা ট্রেনিং কৌশল ছিল ব্যতিক্রমী। তাঁর সাংগঠনিক তৎপরতা, মোটিভেশন, ব্যক্তিগত আচরণ ও সাহসিকতার জন্য শিববাড়ি ক্যাম্পে সবার প্রিয় নেতায় পরিণত হন। জর্জ আনুমানিক ৪০০ মুক্তিযোদ্ধার সমন্বয়ে জর্জ বাহিনী গড়ে তোলেন। তাঁর মেজ ভাই জেমস এন দাস, সেজ ভাই রবার্ট আর এন দাসও তাঁর এই বাহিনীর সদস্য ছিলেন। টানা নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে জর্জ দাস কুঠিবাড়ি যুদ্ধসহ, দশমাইলের যুদ্ধ, বিরল, খানপুর, গোয়ালবাড়ি, ধর্মপুর, জামালপুর, হাকিমপুর, রামসাগর ও সরস্বতী এলাকায় শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন।
জর্জ দাস কোনো সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না। তিনি মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগ থেকে যুবকদের সংগঠিত করে অস্ত্র চালনা প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তিনি যেহেতু ব্যাটল ফিল্ড ইঞ্জিনিয়ারিং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন, এ জন্য দখলদার বাহিনীর পুঁতে রাখা স্থলমাইন অপসারণের বিপজ্জনক ও ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্বটিও তাঁকে পালন করতে হয়েছে। স্বাধীনতার পর অসীম ধৈর্য ও সাহসের সঙ্গে দিনের পর দিন দিনাজপুরের বিভিন্ন স্থানে পুঁতে রাখা স্থলমাইন অপসারণের কাজটি তিনি করেছেন। যে স্বপ্ন ও উদ্দেশ্য নিয়ে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন; স্বাধীনতার পর তাঁর সেই স্বপ্ন যেন সুবিধাভোগী ক্ষমতালোভীদের পায়ের নিচে পিষ্ট হয়েছে।
এই অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধার জীবনের শেষ পরিণতি ভালো ছিল না। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদানের যোগ্য স্বীকৃতি তিনি পাননি; বরং দারিদ্র্যের কশাঘাতে জীবন হয়েছে জর্জরিত। অভাব-অনটনে কোনোরকমে জীবন কাটিয়েছেন। বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগে অনেকটা বিনা চিকিৎসায় জীবনের কাছে পরাজয় মেনে নিয়েছেন এই বীর যোদ্ধা। আমরা যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এত বড়াই করি, তাঁরা জর্জ দাসের মতো মুক্তিযোদ্ধাদের নাম কতজনই-বা জানি। অনেকে হয়তো তাঁদের নামও শোনেননি। আমরা এখন শুধু মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথার ফুলঝুরি ফোটাতেই ব্যস্ত! মনে রাখতে হবে, প্রান্তিক এই যোদ্ধাদের প্রকৃত মর্যাদা দিতে যদি না পারি, তাহলে গর্বিত নাগরিক হিসেবে আমাদের মর্যাদাই-বা থাকে কোথায়?
এ কে এম শামসুদ্দিন, অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল