জামাকাপড় নিয়ে একটা সংকোচ ছিল স্কুলপড়ুয়া জসীমউদ্দীনের। তাঁর বাবা খলিফাদের দোকান থেকে একটিমাত্র পকেটওয়ালা যে জামা কিনে দিতেন, সেটা অন্য ছাত্রদের হালফ্যাশনের জামার পাশে ছিল একেবারেই বেমানান। অন্য ছাত্রদের সামনে নিজেকে লাগত অবাঞ্ছিত। ক্লাসের ভালো ছাত্ররা তো বটেই, সাধারণ ছাত্ররাও জসীমউদ্দীনের সঙ্গে মিশতেন না। মিশতেন শুধু ধীরেন।
জসীমউদ্দীনের হাতের লেখা ভালো ছিল না। লিখতেনও ধীরে ধীরে। ক্লাসের নোট টুকে নেওয়া হতো খুব কম। তখন ধীরেনই তাঁর নোটগুলো জসীমউদ্দীনকে দিতেন। বাড়ি গিয়ে সেই নোটগুলো টুকে নিতেন তিনি। ধীরেনের মা জসীমকে খুব ভালো বাসতেন।
একবার গ্রীষ্মের ছুটির সময় জসীমউদ্দীন তাঁকে বললেন, ‘মা! বাড়ি বসে আমার পড়াশোনা হয় না। আপনি যদি অনুমতি করেন, ছুটির কয়টি দিন আপনাদের এখানে থেকে পড়াশোনা করব। প্রতিদিন বাড়ি থেকে আমি খেয়ে আসব। সে জন্য আপনাকে কিছু করতে হবে না।’
তিনি বললেন, ‘বেশ তো, তুমি আমার ছেলের সঙ্গে এসে পড়াশোনা কোরো।’ রাতে ধীরেনদের বাড়িতে থেকে পড়াশোনা শুরু করলেন জসীমউদ্দীন। বেলা এগারোটা-বারোটার দিকে বাড়ি গিয়ে খেয়ে আসতেন। আবার সন্ধ্যার সময় আরেকবার যেতেন খেতে।
ধীরেনদের বাড়িতে খুব ভালো একটি বাংলা বইয়ের লাইব্রেরি ছিল। সেখানে রবীন্দ্রনাথের বই পেলেন। অবসরে সে বই পড়ে শেষ করলেন তিনি। ধীরেনের ভাই ইন্দ্রমোহন রবীন্দ্রনাথের কবিতা খুব ভালো আবৃত্তি করতেন। পুরাতন ভৃত্য, বধূ, সোনার তরী, দুই বিঘা জমি।
জসীমের তা খুব ভালো লাগত। কবিতার শব্দগুলো মনে থাকত না, কিন্তু পদ্মার পাড়ে গিয়ে ইন্দ্রমোহন দাদার আবৃত্তির অনুকরণে যা মনে হয় বলতেন।
পড়াশোনা শেষ হলে ধীরেনের খুড়তুতো ভাই রাসমোহন উপন্যাস পড়ে শোনাতেন। সেভাবেই শরৎচন্দ্রের সঙ্গে জসীমউদ্দীনের পরিচয়। আর পড়াশোনা? হ্যাঁ, সেটা হলো। এই গ্রীষ্মের ছুটিতে যেসব বিষয়ে কাঁচা ছিলেন, এক মাসেই তা আয়ত্ত করে ফেললেন তিনি।
সূত্র: জসীমউদ্দীন, জীবনকথা, পৃষ্ঠা ২১৩-২১৫