১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ পতাকা উত্তোলন দিবস হিসেবে আমাদের ইতিহাসে অক্ষয় হয়ে আছে। এই প্রজন্মের সবাই হয়তো জানে না, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবস হিসেবে পালন করা হতো। পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানে রাষ্ট্রপতি থাকলে তিনি, না থাকলে তাঁর প্রতিনিধিত্ব যিনি করতেন, অর্থাৎ গভর্নর সামরিক বাহিনীর কুচকাওয়াজের অভিবাদন নিতেন। সারা দেশে পাকিস্তানের পতাকা উড়ত। কিন্তু একাত্তরে আমরা স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের তরফ থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে ইশতেহারের মাধ্যমে জানিয়ে দিলাম যে এবার ২৩ মার্চ পাকিস্তানের পতাকার পরিবর্তে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়বে।
১৯৭১ সালের মার্চ মাসে প্রতিদিনই একেকটা সিদ্ধান্ত আসত। কিছু আসত বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে। কিছু কথা ছিল সংসদীয় রাজনীতির কারণে বঙ্গবন্ধু বলতে পারতেন না, বাধানিষেধ ছিল; যেমন ২৩ মার্চ পাকিস্তানের পতাকা না স্বাধীন বাংলার পতাকা উঠবে—এ কথাটি তাঁর শাসনতান্ত্রিক বাধ্যবাধকতার জন্য তাঁর পক্ষে ঘোষণা করা সম্ভব ছিল না। তা ছাড়া, স্বাধীন বাংলার পতাকা ওড়ালে তাঁকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যায়িত করতে পারে—এ আশঙ্কা তো ছিলই।
আমরা তখন আশঙ্কা করেছিলাম, ইয়াহিয়ার দল ২৫ মার্চ হোক, ২৬ মার্চ হোক, ২৭ মার্চ হোক আমাদের ওপর আক্রমণ করবেই। তারা সব ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অস্ত্র আনছিল। জাহাজ বোঝাই করে সৈন্য আনছিল। আমরা কিন্তু সবকিছু অবহিত ছিলাম। তারা এটাকে তাদের শক্তির বাহন হিসেবে ব্যবহার করেছে। তারা বিশ্বাস করত যে এই নিরীহ, নিরস্ত্র বাঙালিকে হত্যা করলেই, তাদের ওপর নির্মমভাবে ঝাঁপিয়ে পড়লেই আন্দোলন স্তব্ধ হয়ে যাবে। অপরপক্ষে আমরা বিশ্বাস করতাম, জনগণকে যদি ঐক্যবদ্ধ করতে পারি, একটি চেতনার মোহনায় এনে দাঁড় করাতে পারি, তাহলে ওদের ওই অস্ত্রের শক্তিকে এই নিরস্ত্র মানুষই মোকাবিলা করবে। সে কারণে ২৩ মার্চে পতাকা উত্তোলনের সিদ্ধান্তটি স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে আসে এবং আমি বহু অনুষ্ঠানে বলেছি, বহুবার বলেছি এবং এটা আমি বলতেই থাকব যে স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ শুধু একটি আন্দোলন পরিচালনা করার কোনো সংগঠন ছিল না; বঙ্গবন্ধুর হৃদয়ের প্রতিধ্বনি ছিল। যে কথাটি শাসনতান্ত্রিক বাধ্যবাধকতার জন্য উনি বলতে পারতেন না বা বলা সম্ভব হতো না, সেটি উচ্চারিত হতো, প্রতিধ্বনিত হতো, জনসমক্ষে প্রচারিত হতো স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী। আমরা অবশ্য তাঁর কাছ থেকে পরামর্শ এমনকি অনুমতিও নিতাম বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যাপারে।
ওদের শক্তিকে পুরোপুরি চ্যালেঞ্জ করার জন্য আমরা কর্মসূচি দিলাম, পল্টন ময়দানে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলার পতাকা উঠবে, ব্যান্ড বাজবে, কুচকাওয়াজ হবে, যে কুচকাওয়াজ পাকিস্তান সামরিক বাহিনী করত, সেই কুচকাওয়াজ হবে। জয় বাংলা বাহিনী কুচকাওয়াজ করে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে অবস্থিত বঙ্গবন্ধুর বাসভবন পর্যন্ত যাবে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলার পতাকা বঙ্গবন্ধুর হাতে প্রদান করা হবে। সেদিন মঞ্চে আমরা চারজন ছিলাম। আমি, আ স ম আব্দুর রব, আব্দুল কুদ্দুস মাখন ও শাজাহান সিরাজ। আমাদের খসরু, মন্টু, সেলিম জয় বাংলা বাহিনীর জেনারেল সেজে ব্যান্ডের তালে তালে পতাকাটা নিয়ে মার্চপাস্ট করে গেল। আমরা অভিবাদন নিলাম। পল্টন তখন আর ওই কুচকাওয়াজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকল না, এক বিশাল জনসমুদ্রে পরিণত হলো।
ওখান থেকে আমরা ৩২ নম্বরের উদ্দেশে রওনা হলাম। রাস্তা যত পার হচ্ছি, জনতার ঢল তত নামছে, জনতার স্রোত তত বাড়ছে। বঙ্গবন্ধু নিচে গেটের কাছে নেমে এলেন। ছোট্ট পরিসরে লাখ লাখ লোক। ওর মধ্যে আমাদের সেই সামরিকভাব বজায় রেখে বঙ্গবন্ধুর হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে পতাকাটি তুলে দিলাম।
এরপর হাইকোর্ট থেকে শুরু করে, প্রধান বিচারপতির বাসভবন, সচিবালয় থেকে শুরু করে বাঙালিদের ৯৯ শতাংশ গৃহে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ৫৪ হাজার বর্গমাইলের মানচিত্র আঁকা পতাকাটি উড়ল। কিন্তু মিরপুর আর মোহাম্মদপুর, যে এলাকাগুলো অবাঙালি-অধ্যুষিত ছিল, সেই সব জায়গায় উড়ল পাকিস্তানের পতাকা। আমরা বেদনাহত চিত্তে তা লক্ষ করলাম। এরপর আমরা ইশতেহারে বলে দিলাম, যারা ২৩ মার্চকে সম্মান করেনি, পতাকা দিবসকে সম্মান করেনি, যারা এখনো পাকিস্তানের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করছে, তাদের গ্যাস, পানি এবং বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দাও।
এ কথা নিশ্চয়ই সেদিন কোনো সংসদীয় দলের নেতার পক্ষে বলা সম্ভব ছিল না। যা-ই হোক, সঙ্গে সঙ্গে তাদের সব বিদ্যুৎ-সংযোগ, গ্যাস-সংযোগ এবং পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।
পরদিন দৈনিক ইত্তেফাকে যে প্রতিবেদনটি উঠেছিল, সেটির কয়েকটি বাক্য ছিল এ রকম: ‘‘বিক্ষুব্ধ বাংলার বুকে অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের উত্তাল তরঙ্গের আঘাতে আঘাতে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব গ্রহণের স্মারক দিবস ২৩ শে মার্চ গতকাল (মঙ্গলবার) চিরাচরিত আনুষ্ঠানিকতায় আর পালিত হয় নাই। বাংলার মুক্তি ও স্বাধিকার আন্দোলনের রক্তঝরা পটভূমিকায় ‘স্বাধীন বাংলা দেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ ও স্বাধীন বাংলা দেশ কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদের ডাকে গতকালের দিনটি বাংলা দেশব্যাপী ‘প্রতিরোধ দিবস’ হিসাবে পালিত হইয়াছে। বাংলা দেশের রাজধানী ঢাকায় সরকারী-বেসরকারী ভবনসমূহে, বাড়ী-ঘরে, যানবাহনে কালো পতাকার পাশাপাশি গতকাল সংগ্রাম পরিষদ পরিকল্পিত স্বাধীন বাংলার পতাকা উড্ডীন করা হয়। ঢাকা শহরে সামরিক কড়া বেষ্টনীর ছত্রচ্ছায়ায় বিমানবন্দর ভবনটিতে পাকিস্তানের পতাকা উড়িতে দেখা যায়। সংরক্ষিত এলাকা প্রেসিডেন্ট ভবন ও লাট ভবনে পাকিস্তানের পতাকা ছিল। এ ছাড়া রাজধানীর সকল সরকারী ভবন—বাংলা পরিষদ ভবন, সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট, সেক্রেটারিয়েট, শেখ সাহেবের বাসভবন, ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেল, ঢাকা বেতারকেন্দ্র, টেলিভিশন কেন্দ্র প্রভৃতি স্থানে কালো পতাকার পাশাপাশি ‘স্বাধীন বাংলা’র পতাকা উড্ডীন করা হয়। গতকাল প্রতিরোধ দিবস পালন উপলক্ষে রাজধানী ঢাকার গণ-জীবনে গণ-আন্দোলনের সাগরে ভরাকাটালের জোয়ার দেখা দেয়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ব্যবস্থাপনায় আউটার স্টেডিয়ামে স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রসৈনিক ছাত্রছাত্রীরা যে বীরোচিত কুচকাওয়াজ পরিবেশন করেন, স্বাধিকার পিপাসু হাজার হাজার নরনারী আনন্দ উচ্ছল কিন্তু বজ্রকঠোর শপথের দ্যুতিতে দীপ্ত এবং অপূর্ব পরিবেশে তাহা অবলোকন করেন।’’
এই দিনটি জাতির জীবনে চির অক্ষয় হয়ে থাকবে।
নূরে আলম সিদ্দিকী, সাবেক ছাত্রলীগ সভাপতি