‘মারব এখানে লাশ পড়বে শ্মশানে।’ কথাটি আমার নয়, সদ্য সমাপ্ত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী বিএনপি থেকে অব্যাহতিপ্রাপ্ত দলটির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা তৈমুর আলম খন্দকারের নির্বাচনের দিনের মন্তব্য। যদিও বিএনপি পরিষ্কার করে বলেনি, কেন তৈমুর আলম খন্দকারকে তাঁর দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হলো, তবে এটি যৌক্তিকভাবে মনে করে নেওয়া যায়, যেহেতু এ নির্বাচনটি দলীয় প্রতীকে হচ্ছে, বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা চাননি খন্দকার সাহেব তাঁদের প্রতীক নিয়ে এই নির্বাচনে পরাজিত হন। যখন বর্তমান সরকার তথা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করতে বিএনপি অনেকটা জিহাদ ঘোষণা করেছে, তখন যদি নৌকা প্রার্থীর কাছে ধানের শীষের প্রার্থী হেরে যান, তাহলে তাদের জন্য বিষয়টা হবে বেশ বিব্রতকর।
তৈমুর আলম খন্দকার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে হাতি মার্কা নিয়ে এই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। দল খন্দকার সাহেবকে পরিত্যাগ করলেও দলের অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা তাঁর পক্ষে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছেন। বিএনপির কৌশলটিতে বেশ মুনশিয়ানা আছে। এরই মধ্যে দেশের মানুষ জেনে গেছেন, এই নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী বিপুল ভোটে ‘স্বতন্ত্র’ প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করেছেন। এটি তাঁর তৃতীয়বার বিজয়। এর আগে তিনি নারায়ণগঞ্জের বেশ আলোচিত আওয়ামী লীগ নেতা শামীম ওসমানকে পরাজিত করেছেন।
২০০৭ সালের ৭ মে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন মেয়র নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী মনজুর আলমকে নির্বাচনের দিন দুপুর ১২টার সময় নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে নির্দেশ দিলে চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষ কিছুটা অবাক হয়েছিল। কারণ, মনজু একজন শক্ত প্রার্থী ছিলেন, যতক্ষণ তিনি নির্বাচনে ছিলেন, তিনি ভালো করছিলেন। তিনি সংবাদ সম্মেলনে যখন তাঁর সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিচ্ছিলেন, তখন তিনি ছিলেন অশ্রুসিক্ত। আসলে সার্বিক বিচারে নির্বাচন সংস্কৃতির সঙ্গে বিএনপি এখনো নিজেদের খাপ খাওয়াতে পারেনি। কারণ, বিএনপি ১৯৯১ সাল ছাড়া কখনো কোনো সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেনি। সব সময় তারা চটজলদি পদ্ধতিতে ক্ষমতায় যেতে অভ্যস্ত।
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর একাধিক ব্যক্তির হাত ঘুরে যখন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়া ক্ষমতা দখল করেন, তখন একপর্যায়ে তাঁর ইচ্ছা হলো, তিনি দেশে এক গণভোটের নির্বাচন করবেন এবং তিনি হবেন একমাত্র প্রার্থী। নাম দিলেন গণভোট। জনগণের কাছে তা ‘হ্যাঁ’ আর ‘না’ ভোট; অর্থাৎ জিয়া রাষ্ট্রপতি হিসেবে ক্ষমতায় থাকুন, ভোটাররা তা চান কি না। এমন একটি অদ্ভুত ব্যবস্থা করেছিলেন পাকিস্তানের আরেকজন ক্ষমতা দখলকারী জেনারেল আইয়ুব খান। যোগ্য গুরুর যোগ্য শাগরেদ। ১৯৭৭ সালের ৩০ মে এই তথাকথিত গণভোট অনুষ্ঠিত হলো আর সেখানে অনেক কেন্দ্রে ‘না’ ভোট দেওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। পরদিন ঘোষণা হলো জিয়া ‘জনগণের ভোটে’ রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন। পরে জানা গেল, অনেক কেন্দ্রে জিয়া ১০০ শতাংশের বেশি ‘হ্যাঁ’ ভোট পেয়েছেন। তথাকথিত গণভোটে ‘নির্বাচিত’ হয়ে একই বছর ১৫ ডিসেম্বর নিজ দল বিএনপি গঠন করেন। এর আগে তিনি তাঁর বশংবদ উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তারকে দিয়ে দেশের নানা রঙের যুদ্ধাপরাধী, স্বাধীনতাবিরোধী, অতি বাম, অতি ডান, অরাজনৈতিক পেশাজীবী, ওয়ানম্যান পার্টির নেতা প্রমুখ নিয়ে প্রথমে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট, জাগদল করেন। এরপর জিয়া তাঁর পদে তথাকথিত গণভোটের বলে বলীয়ান হয়ে বিএনপি গঠন করেন এবং ১৯৭৮ সালে তাতে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দেন। ঠিক একইভাবে তাঁর একসময়ের বস আইয়ুব খান কনভেনশন মুসলিম লীগ গঠন করেছিলেন। ১৯৭৯ সালে জিয়া তাঁর আমলে প্রথম সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করেন। আওয়ামী লীগ সব আসনে প্রার্থী দেয়। বিকেল ৪টায় নির্বাচন শেষ হলে চট্টগ্রামের একটি আসনের প্রায় দেড় লাখ ভোটের ফলাফল সন্ধ্যা ৬টার সময় বিটিভিতে পৌঁছায়। অনুষ্ঠান উপস্থাপক ফজলে লোহানীর হাতে সেই ফলটি দিলে তিনি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে যান। প্রায় দুদিন পর ফলাফল ঘোষণা করা হয়, তখন দেখা যায় আওয়ামী লীগ ৩৯টি আসনে বিজয়ী হয়েছে আর বিএনপির প্রার্থীরা ২০৭টিতে। আজ যাঁরা নির্বাচন নিয়ে গলা ফাটান, তারা কি এই সব খবর বা তথ্য জানেন? ২০০৬ সালের নির্বাচনের পরও বিএনপি ক্ষমতা থাকার চেষ্টা করেছিল। তার জন্য ভোটার তালিকায় ১ কোটি ২১ লাখ ভুয়া ভোটার তালিকাভুক্ত করেছিল। নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল তাদের বশংবদ বিচারপতি আজিজকে। তিনি ঘোষণা করেছিলেন, এই ভোটার তালিকায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সেই নির্বাচন শেষতক হয়নি। তার বদলে আসে এক-এগারোর সরকার। মূলকথা, বিএনপি ক্ষমতায় থেকে ক্ষমতায় আসে আর তারা কোনো অবস্থাতেই ক্ষমতার বাইরে থাকতে অভ্যস্ত নয়।
এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জন্যও অনেক শিক্ষণীয় বিষয় আছে। প্রথমটা হচ্ছে আগামী নির্বাচনে প্রতিটি আসনে তৃণমূলের কাছে গ্রহণযোগ্য প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া। মনোনয়নের সময় দেখতে হবে কেউ শুধু অর্থ আর উত্তরাধিকার সূত্রে যেন মনোনয়ন না পান। অন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে, দল যদি একজনকে মনোনয়ন দেয়, তাঁর বিরুদ্ধে যদি কোনো বড় ধরনের অভিযোগ থাকে, তাহলে সেই অভিযোগ যেন নিরপেক্ষ ব্যক্তি দ্বারা যাচাই করা হয়।
নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনে কোনো সহিংসতা হয়নি। এর জন্য নিশ্চয় নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনকে ধন্যবাদ দিতেই হবে। ধন্যবাদ জানাতে হয় প্রার্থীদেরও। আগামী নির্বাচনেও এমনটি হবে–মানুষ তেমনটি আশা করে। বিএনপি এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাবে না বলে প্রতিদিন ঘোষণা করে। দেশের সংবিধান মানলে তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া সম্ভব নয়। তাহলে তাদের সামনে নারায়ণগঞ্জ মডেল থাকল। তাদের প্রার্থী থাকবে, তবে তা হবে তৈমুর আলম খন্দকার মডেলের। বলা হবে, স্বতন্ত্র কিন্তু আসলে হবেন তিনি বিএনপিরই প্রার্থী। বিএনপি না বললেও জনগণের বিষয়টা বুঝতে অসুবিধা হবে না।
সবশেষে বোঝার চেষ্টা করছি, নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনের পর শ্মশানে কার লাশ পড়ল? বিএনপির, নাকি তৈমুর আলম খন্দকারের?