দেশের প্রায় সব জাতীয় দৈনিকে চমকপ্রদ সচিত্র খবরটি প্রকাশিত হয়েছে। বগুড়ার ধুনট উপজেলার একটি বিয়ের খবর। আজকের পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদটির শুরুতে লেখা হয়েছে, ‘তাঁদের ৯ মাসের প্রেম তারপর বিয়ে।
বিয়েতে দেনমোহর ১০১টি বই। কনের ইচ্ছা, বই দিয়ে বানাবেন একটি পারিবারিক পাঠাগার। তাঁর সেই ইচ্ছার বাস্তবায়নে বর ৭০টি বই নগদ এবং ৩১টি বই বাকি রেখে গত শুক্রবার বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন দুজন।’ এই দম্পতির নাম নিখিল নওশাদ ও সান্ত্বনা খাতুন। বর নিখিল কবি এবং ‘বিরোধ’ শীর্ষক একটি সাহিত্যবিষয়ক লিটলম্যাগের সম্পাদক। কনে সান্ত্বনা স্থানীয় একটি মাদ্রাসার ইংরেজির শিক্ষক। শুরুতে নিখিলের কবিতার জাদুতে মুগ্ধ হন সান্ত্বনা, পরে হাবুডুবু খান কবির প্রেমে। এই প্রেম পারিবারিক আয়োজনে পরিণয়ে পরিণতি পেয়েছে।
সন্দেহ নেই, এই নবদম্পতি সংস্কৃতিমান। তাতেই এ-বিয়ের দেনমোহরের বিষয়টি সুধীমহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। শুধু তা-ই নয়, অসংখ্য সুশীল পাঠক ফেসবুকে মন্তব্য করেছেন, অভিনন্দন জানিয়েছেন। বড় কথা, এই দম্পতি নাগরিক সমাজের তথাকথিত শিক্ষিত মানুষ নন। তাঁরা গ্রামীণ জনপদে বেড়ে ওঠা কুসংস্কারমুক্ত প্রকৃত আধুনিক মানুষ। নওশাদের বাড়ি বগুড়ার ধুনট উপজেলার গোসাইবাড়ী ইউনিয়নের সাতরাস্তা গ্রামে। আর সান্ত্বনার বাড়ি একই জেলার সোনাতলা উপজেলার কামালেরপাড়া গ্রামে। উপরন্তু তিনি দাখিল মাদ্রাসার ইংরেজির শিক্ষক—যে মাদ্রাসাকে আমরা সাধারণত কুসংস্কারের আকর বলে মনে করি। এখানেও তিনি অন্য জাতের মানুষ।
আজকের পত্রিকার খবর থেকে জানা যায়, কনে সান্ত্বনা দেনমোহর বাবদ ১০১টি সুনির্দিষ্ট বইয়ের তালিকা বরের কাছে দিয়েছিলেন। সেই তালিকা ধরে বগুড়া ও ঢাকায় খুঁজে তিনি ৭০টি বই সংগ্রহ করতে পেরেছেন। বাকি ৩১টি পরে পরিশোধযোগ্য শর্তে তাঁদের বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। অথচ এই একুশ শতকের আধুনিক মনস্কতার যুগেও আমরা প্রায়ই পত্রপত্রিকায় খবর পাই, দেনমোহর ও যৌতুক নিয়ে কত কেলেঙ্কারি ও নারী নির্যাতনের ঘটনা! কেবল মানসিক নির্যাতন নয়; শারীরিক নির্যাতন—পিটিয়ে মারা, শরীরে ছ্যাঁকা দেওয়া, গায়ে পেট্রল ঢেলে পুড়িয়ে মারা, আরও কত-কী! এমন খবর কেবল গ্রামজীবনে নয়, নাগরিক সমাজেও একালে অহরহ ঘটছে। সব ঘটনার খবর তো আর পত্রপত্রিকায় আসে না! অথচ এই তরুণ জুটি কত মুক্তমনা, আধুনিক, সাহিত্যরসিক ও শিক্ষানুরাগী যে দেনমোহরের বই দিয়ে তাঁরা একটি পারিবারিক পাঠাগার গড়ে তুলতে চান। জীবন-সাধনায় এই চিন্তা চমকপ্রদ বৈকি!
বুদ্ধিবাদী প্রাবন্ধিক প্রমথ চৌধুরী তাঁর ‘বইপড়া’ প্রবন্ধে বলেছেন: ‘... কেননা বইপড়া ছাড়া সাহিত্যচর্চার উপায়ান্তর নেই। ধর্মের চর্চা চাইকি মন্দিরের বাইরেও করা চলে, দর্শনের চর্চা গুহায়, নীতির চর্চা ঘরে এবং বিজ্ঞানের চর্চা জাদুঘরে; কিন্তু সাহিত্যের চর্চার জন্য চাই লাইব্রেরি; ও-চর্চা মানুষ কারখানাতেও করতে পারে না; চিড়িয়াখানাতেও নয়। এই সব কথা যদি সত্য হয়, তাহলে আমাদের মানতেই হবে যে সাহিত্যের মধ্যেই আমাদের জাত মানুষ হবে। সেই জন্য আমরা যত বেশি লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করব, দেশের তত বেশি উপকার হবে। আমার মনে হয়, এ দেশে লাইব্রেরির সার্থকতা হাসপাতালের চাইতে কিছু কম নয় এবং স্কুল-কলেজের চাইতে একটু বেশি।’
যুক্তি দিয়ে প্রায় একই ধরনের কথা বলেছেন বহুভাষাবিদ প্রাবন্ধিক সৈয়দ মুজতবা আলী: ‘ধনীর মেহনতের ফল হলো টাকা। সে ফল যদি কেউ জ্ঞানীর হাতে তুলে দেয়, তবে তিনি সেটা পরমানন্দে কাজে লাগান এবং শুধু তা-ই নয়, অধিকাংশ সময়ই দেখা যায়, জ্ঞানীরা পয়সা পেলে খরচ করতে পারেন ধনীদের চেয়ে অনেক ভালো পথে, ঢেড় উত্তম পদ্ধতিতে। পক্ষান্তরে জ্ঞানচর্চার ফল সঞ্চিত থাকে পুস্তকরাজিতে এবং সে ফল ধনীদের হাতে গায়ে পড়ে তুলে ধরলেও তারা তার ব্যবহার করতে জানে না। বই পড়তে পারে না।’ অবশেষে মুজতবা আলীর সিদ্ধান্ত হলো: ‘অতএব সপ্রমাণ হলো, জ্ঞানার্জন ধনার্জনের চেয়ে মহত্তম।’ এবং ‘বই কিনে কেউ কোনো দিন দেউলে হয় না।’
প্রবাদপ্রতিম এসব বাণীতুল্য কথা এখন আমরা বক্তৃতা-বিবৃতি ও অন্যকে উপদেশ খয়রাতের জন্যই ব্যবহার করি—মানি কজন? যারা মুখে বলি, তারাও সিংহভাগ মানি না! এ যুগে উপদেশের ধর্মই বোধ করি এমন যে তা নিজে পালন করার জন্য নয়। তাই আমরা অন্যকে পড়তে বলি, শিক্ষকেরা উপদেশ দিই ছাত্রদের, কিন্তু নিজেরা পড়ি না! তাই সৈয়দ মুজতবা আলী দুঃখ করে বলেছেন, বই এখন দোকানে কাটে না—পোকায় কাটে। সখেদে সরস করে আরও বলেছেন, এ জন্যই মাঝেমধ্যে তিনি নিজের বই নিজে কেনেন; অর্থাৎ নিজে প্রডিউসার এবং নিজেই কনজ্যুমার। সেই সময়ের অবস্থা থেকে এখন আমাদের পাঠাভ্যাসের উন্নতি তো হয়ইনি; বরং আরও অবনতি ঘটেছে। প্রমথ চৌধুরী বা সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘বইপড়া’ বা ‘বইকেনা’ প্রবন্ধ এখনো পাঠ্যসূচির অন্তর্গত থাকলেও আমরা এর কোনো গুরুত্বই দিচ্ছি না!
কিশোর-তরুণ ও যুবসমাজের মধ্যে এখন কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে ফেসবুক। গণযোগাযোগমাধ্যম নামের এই আন্তর্জালিক ‘বদনবই’-এর প্রতি ওদের মুগ্ধতা ও মনোযোগ এখন এতই প্রবল যে তা করোনা মহামারির চেয়েও ভয়াবহ! তা ‘আউট বই’ তো দূরের কথা, পাঠ্যবইকেও প্রায় অস্পৃশ্য করে ফেলেছে। এই দুরারোগ্য ব্যাধির নিরাময় কীভাবে, তা আমরা কেউ জানি না, বোধ করি সমাজবিজ্ঞানীদেরও অজানা।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে কতজন শহীদ হয়েছেন, মা-বোন সম্ভ্রম হারিয়েছেন, কতশত ব্রিজ-কালভার্ট ধ্বংস হয়েছে, কতশত কিলোমিটার রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কিংবা কত হাজার দালানকোঠা ও বাড়িঘর ধ্বংস হয়েছে, তার হিসাব আছে। কিন্তু কয় শ পাঠাগার বিধ্বস্ত হয়েছে এবং কত লাখ মূল্যবান বই ধ্বংস হয়েছে, তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। স্বাধীনতার পর পাঠাগার পুনর্নির্মাণ এবং নতুন পাঠাগার গড়ে তোলার কোনো কার্যকর উদ্যোগও নেওয়া হয়নি। পাঠাগার প্রতিষ্ঠার সক্রিয় আন্দোলনের মাধ্যমে পাড়ায়-মহল্লায় নতুন পাঠাগার গড়ে তোলার কার্যকর পদক্ষেপও দুর্লক্ষ। মফস্বলের স্কুল-কলেজে এবং প্রতিটি উপজেলায় লাইব্রেরি নামমাত্র যা-ও আছে, তা সঠিক তত্ত্বাবধান, পরিচর্যা ও পাঠকের অভাবে ধূলি-ধূসরিত এবং তা উই-ইঁদুরের নিরাপদ আবাসস্থল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে ইদানীং অফিস-আদালত, সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং স্কুল-কলেজে তাঁর স্মৃতিধন্য বই দিয়ে নির্মিত হচ্ছে ‘বঙ্গবন্ধু কর্নার’। তা-ও লোকদেখানো ও প্রদর্শনধর্মী, সেখানেও পাঠক প্রায় শূন্যের কোঠায়।
আমাদের পাঠাগার ও পাঠমনস্কতার এই যখন অবস্থা, তখন সান্ত্বনা খাতুন ও নিখিল নওশাদের বিয়ের দেনমোহরে ১০১টি বই আমাদের বিলুপ্ত পাঠাভ্যাসের রুদ্ধ দরজায় করাঘাতের মতো মনে হয় নাকি? এ দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে না হোক, অন্তত প্রতিটি উপজেলায় যদি নিখিল-সান্ত্বনার মতো একটি দম্পতি পাওয়া যেত, তবে বোধ করি আমাদের পাঠাভ্যাসের চেতনার নিস্তরঙ্গ পুকুরে একটি ঢিল অন্তত ছোড়া হতো।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক, গ্রন্থকার