‘সিট খালি নেই’ অবস্থায় যখন কোনো নারী বাসে উঠে পড়েন, তখন তিনি যেমন একটি খালি সিটের আশায় চারপাশে চোখ ঘোরান, তেমনি অনেকটা আশাও করেন কোনো পুরুষ তাঁর নিজের সিটটি ওই নারীর জন্য ছেড়ে দেবেন বিনা দ্বিধায়। বাসে আর সব ঘটনার সমান্তরালে রোজ এ দৃশ্য়টা পরিচিত।
বাসে নারীর নানা হয়রানির চিত্রের পাশাপাশি এ চিত্রটিও কিন্তু সত্য যে, কোনো নারীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে অনেক পুরুষই নিজের সিটটি ছেড়ে দেন অনায়াসে। অথচ যে পুরুষ আমাদের জন্য তাঁর নিজের সিট ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে যাত্রা করেন, তাঁকে অনেক সময় ধন্যবাদটুকুও আমরা অনেকে দিই না; বরং চোখে-মুখে এমন ভাব নিয়ে থাকি–এটাই তো হওয়ার কথা। কারণ, আমি তো নারী; সুবিধা, নিয়মকানুনে ঢিলেভাব আমারই প্রাপ্য!
বাসে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় নিন্দার পাশাপাশি পুরুষের এই সম্মানের তারিফ তো করতেই পারি। বয়স্ক বা শারীরিকভাবে অতটা সক্ষম নন, তেমন নারীর ক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে বাস জার্নি করাটা সম্ভব নয়, সে কথা অস্বীকার করছি না। প্রসঙ্গটা এর বাইরে।
যেখানে বর্তমানে তরুণীরা বাইরে কাজ করছেন, আয় করছেন এবং সমানভাবে ভাবছেন পুরুষও ঘরের কাজে হাত লাগাবেন। আদর্শ ব্যাখ্যা হলো, নারী-পুরুষ উভয়েই সমান।
নারী বাইরে বের হতে পারলে, আয় করতে পারলে, সংসার চালাতে পারলে পুরুষ কেন ঘরের কাজ করবেন না? রান্না, নিজের কাপড় ধোয়া, ঘর গোছানো এগুলো লাইফ স্কিল। নারী-পুরুষনির্বিশেষে প্রতিটি মানুষেরই লাইফ স্কিল থাকা প্রয়োজন। এটা যখন এ সময়ের স্মার্ট নারী ভাবছেন, সেখানে সেই নারীই কেন মনে করছেন, তিনি সিটপূর্ণ কোনো বাসে উঠলেও সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও দাঁড়িয়ে যেতে পারবেন না? পুরুষ উঠে দাঁড়িয়ে নিজ সিট তাঁকে সমর্পণ না করলে সেটা অভদ্রতা হিসেবে গ্রহণ করা হবে বা পারলে তাঁকে দুটো কথা শুনিয়ে দেওয়া যায়। অথচ তিনি সমান ভাড়া দিয়েই যাত্রা করছেন।
অন্যদিকে, বাসে যখন কোনো বয়স্ক পুরুষ উঠছেন, তখনো আমরা নিজেদের নারী দাবি করে ঠায় সিটে বসে থাকি। অধিকাংশ তা-ই করে। কজন দাঁড়িয়ে যেতে সক্ষম নারী একজন বয়স্ক পুরুষের জন্য নিজের সিট ছেড়ে দেন? বরং এখানেও আশা থাকে নিশ্চয়ই কোনো পুরুষ উঠে গিয়ে বয়স্ক ব্যক্তিকে বসতে দেবেন। এ ভাবনাও তো অমানবিক।
নারী-পুরুষ সমানের কট্টর হিসাব কষলে বাসে আলাদা করে নারীর জন্য সিট বরাদ্দ থাকার কথা নয়; বরং শিশু, প্রতিবন্ধী ও বয়স্কদের (নারী ও পুরুষ) জন্য থাকা উচিত। অনেকেই যুক্তি তোলার চেষ্টা করবেন যে বাসে নারীর সঙ্গে নানান অপ্রিয় ঘটনা ঘটে বলে নারীর সিট সংরক্ষিত থাকে বা নারী বাসে উঠলে দাঁড়িয়ে যেতে চান না। সে ক্ষেত্রে একটা বিষয় বলার আছে, সংরক্ষিত সিট দিয়ে বা অন্য়ের সিট দখল করে আসলে অপ্রিয় ঘটনা এড়ানো সম্ভব না। মানুষ যদি না মানুষ হয়। আর যদি সংরক্ষিত সিট থেকেই থাকে তাহলে নারী-পুরুষের প্রায় সমান সমান ভাগে সিট থাকা উচিত।
শুধু বাসের প্রসঙ্গই বা বলছি কেন, সেদিন অফিস থেকে ফেরার পথে দেখলাম এক ভদ্রলোকের হাতে দুটো ভারী কাপড়ের ব্যাগ। সম্ভবত কোথাও বেড়াতে যাচ্ছেন বা ফিরছেন। আর তাঁর পেছনে সতেরো-আঠারো বছর বয়সী একটি মেয়ে ও আরেকজন ভদ্রমহিলা অবলীলায় গল্প করতে করতে এগোচ্ছেন সেই ব্যাগ বহনকারী পুরুষের পেছন পেছন। তাঁরা হয়তো ভেবে নিয়েছেন ব্যাগ তাঁরাই-বা টানবেন কেন, এটা তো পুরুষের কাজ। ওদিকে বেচারা ভদ্রলোকও ধরে নিয়েছেন এটাই তাঁর নিয়তি, কারণ তিনি পুরুষ। যাবতীয় ভার তাঁর হাতেই!
অথচ এদিকে সমান সমান বলে দাবি চলে। আদৌ কি আমরা সমান হতে চাই? নাকি সুবিধা নিতেই চাই, দিতে নয়।
সানজিদা সামরিন: সহসম্পাদক, আজকের পত্রিকা