বাংলা সাহিত্যে সবচেয়ে বেশি ‘ব্যর্থ বাক্যরচনা’ করেছেন সম্ভবত রবিঠাকুর। আমাদের জীবনের প্রতিটি দিক, প্রতিটি অনুভব-অনুভূতি নিয়ে তিনি অজস্র কবিতা-গান লিখেছেন। সেসব কবিতা-গান এখনো জনপ্রিয়। কিন্তু তাঁর কবিতা বা গানের বাণীকে আমরা মোটে গ্রহণ করিনি। তিনি বলেছেন, ‘যে তোরে পাগল বলে/তারে তুই বলিস নে কিছু।/আজকে তোরে কেমন ভেবে/অঙ্গে যে তোর ধুলো দেবে/কাল সে প্রাতে মালা হাতে/আসবে রে তোর পিছু-পিছু’।
কবিগুরুর এমন নিষেধ সত্ত্বেও দেশের উত্তরের জেলা নওগাঁয় স্রেফ ‘পাগল’ বলাকে কেন্দ্র করে হামলা ও মারধরের ঘটনায় দুজন নিহত হয়েছেন। ৯ অক্টোবর নওগাঁর পত্নীতলা উপজেলার আমাইড় ইউনিয়নের নালাপুর দক্ষিণপাড়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। জানা যায়, সত্তর বছর বয়সী আছির উদ্দিন পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সী ফয়জুলকে দেখে ‘পাগল’ বলে ডাক দেন। পাগল বলায় আছির উদ্দিনের ওপর খেপে যান ফয়জুল।
এ নিয়ে তাঁদের দুজনের মধ্যে কথা-কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে ফয়জুল কুড়াল দিয়ে আছির উদ্দিনের পিঠে কোপ দেন। স্থানীয় লোকজন আশঙ্কাজনক অবস্থায় আছিরকে দ্রুত পত্নীতলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করেন। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পর রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে তাঁর মৃত্যু হয়। এ ঘটনার পর স্থানীয় জনতা ফয়জুলকে নালাপুর মোড়ে একটি গাছের সঙ্গে বেঁধে মারধর করেন। মারধরের একপর্যায়ে ফয়জুল অজ্ঞান হয়ে পড়েন এবং সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়।
একজন আরেকজনকে ‘পাগল’ বলার কারণে এমন মর্মান্তিক ঘটনা ঘটতে পারে, তা সত্যিই শিউরে ওঠার মতো। আমাদের দেশের মানুষগুলো সত্যিই খ্যাপাটে হয়ে গেল? এ কোন দেশ, কোন সমাজে আমরা বসবাস করছি? কারও মধ্যে সহনশীলতা নেই, শুভবুদ্ধি নেই!
অথচ ‘পাগল’ আমাদের সমাজে খুবই প্রচলিত একটি শব্দ। কবিতায়, গানে, প্রবাদ-প্রবচনে-সাহিত্যে পাগল শব্দটি হামেশাই ব্যবহার করা হয়। ‘পাগল’ শব্দটি যেমন কোনো ‘মাথা খারাপ’ ব্যক্তির মনের এক বিপর্যস্ত অবস্থাকে নির্দেশ করে থাকে, একই সঙ্গে তা সৃষ্টিশীল খেয়ালি মানুষকেও বুঝিয়ে থাকে। কখনো অপমানজনক গালি হিসেবে এর ব্যবহার হয়; আবার এ শব্দ দিয়ে পরম মমতারও প্রকাশ ঘটে। করুণাময়ী মায়ের কাছে প্রতিটি সন্তানই পাগল। আমার ‘পাগল ছেলে’ বলে প্রত্যেক মা-ই নিজ সন্তানের প্রতি তাঁর পক্ষপাত প্রদর্শন করেন। আমাদের সমাজে বিভিন্ন ধরনের অর্থ নিয়ে ‘পাগল’ শব্দটি টিকে আছে। আমাদের সমাজে ‘গানের পাগল’, ‘বইয়ের পাগল’, ‘প্রেমের পাগল’, ‘ক্ষমতার পাগল’, ‘নেশার পাগল’, ‘টাকার পাগল’ ইত্যাদি নানা কিসিমের পাগল দেখা যায়।
পাগল শব্দটি ব্যবহারেও আছে নানা ব্যঞ্জনা। ‘পাগল ছেলে, মা পড়ে আর হাসে, তোর ওপর কী রাগ করতে পারি?’ এই বাক্যে ‘পাগল’ শব্দটি সন্তানের প্রতি মায়ের সীমাহীন মমতারই বহিঃপ্রকাশ। স্বামীর খুনসুটিতে বিগলিত স্ত্রী যখন বলে, ‘কী পাগলামি শুরু করেছ’, তখন তা হয়ে ওঠে পাগলামির উষ্ণতম এক প্রকাশ। মান্না দের কণ্ঠে যখন উচ্চারিত হয়, ‘তুমি যখন পাগল বলো ধন্য যে হয় সে পাগলামি’, তখন আক্ষরিক অর্থেই সেই পাগলামি রোমান্টিকতার এক অনন্য দ্যোতনা পেয়ে যায়। দিলরুবা খানের ‘পাগল মন’ তো একসময় সব সংগীত পাগলকেই পাগল বানিয়েছিল।
আমাদের সংগীতে ‘পাগল’ শব্দটি এসেছে নানাভাবে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে, পাগল আমার মন জেগে ওঠে...’ কিংবা জাতীয় কবি কাজী নজরুলের ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ গানে ‘ওরে ও পাগলা ভোলা দে রে দে প্রলয় দোলা’য় আমরা পাগল শব্দের ব্যবহার দেখতে পাই। স্বাধীনতার পরপর যখন এ দেশে পপসংগীতের অভিষেক হয়, তখন পপগুরু আজম খান গেয়েছিলেন, ‘পাগলীরে ফেলিয়া, পাগলা যায় চলিয়া, পাগলীর মন ঘরে থাকে না রে পাগল’।
আধ্যাত্মিক জগতে গুরুগণ শাগরেদদের আদর করে পাগল বলে সম্বোধন করে থাকেন। এই সম্বোধনে কেউ রাগ করেন না; বরং এ সম্বোধনে মুরিদেরা ধন্য হন। সেই আধ্যাত্মিক জগতের একটি বিখ্যাত গান, ‘বাবায় হরেক রকম পাগল দিয়া মিলাইছে মেলা, বাবা তোমার দরবারে সব পাগলের খেলা’ মানুষকে এখনো আনন্দ দেয়। সংগীতের পাশাপাশি সাহিত্যেও জায়গা করে নিয়েছে পাগল। সুকুমার রায় তাঁর ‘বিষম চিন্তা’ কবিতায় লিখেছেন, ‘ভূত যদি না থাকবে তবে কোত্থেকে হয় ভূতের ভয়?/মাথায় যাদের গোল বেঁধেছে তাদের কেন “পাগোল” কয়?’
আধুনিক তুরস্কের জন্মদাতা কামাল পাশার কীর্তিতে উচ্ছ্বসিত নজরুল তাঁর উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে গিয়ে ‘কামাল পাশা’ কবিতায় লিখেছেন, ‘ঐ ক্ষেপেছে পাগলী মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই’। রবিঠাকুরের রক্তকরবীর বিশু বা বিশু পাগলা তেমনই অমর এক চরিত্র।
একসময় লোককবিরা নিজে নিজেকে পাগল বা পাগলা নামে পরিচিত করতে চাইতেন। ঊনবিংশ শতকের এক প্রখ্যাত লোককবি কানাই শেখ নাম ধারণ করেন পাগলা কানাই। অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতকে ময়মনসিংহের শেরপুর অঞ্চলে টিপু পাগলা ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে পাগলপন্থী আন্দোলনের সূচনা করেন। অবশ্য গূঢ় বা নিগূঢ় পাগলের কথা আলাদা ‘তিন পাগলে হল মেলা নদে এসে’-র ভাবার্থ জানেন কেবল লালন সাঁই। ‘হাসন রাজা হইল পাগল লোকের হইল জানা’ বললেও আমরা কি আসলেই জানি তাঁর পাগলামির রহস্য?
আবার বিভিন্ন পশুর ক্ষেত্রে পাগলা শব্দটি যথার্থই খ্যাপা অর্থে ব্যবহৃত হয়, যেমন ‘পাগলা কুত্তা’, ‘পাগলা ঘোড়া’, ‘পাগলা হাতি’ ইত্যাদি। আমাদের সমাজে কাউকে ‘পাগলা কুত্তা’ বলা এক জবরদস্ত গালি, কিন্তু অনেক দেশে এ শব্দটিকে বীরত্বসূচক বলেই গণ্য করা হয়। যেমন মার্কিন জেনারেল জেমস মেটিস যিনি ‘ম্যাডডগ’ নামে খ্যাত। আবার রূপক অর্থে মনকে অনেক সময় ‘পাগলা ঘোড়া’র সঙ্গে তুলনা করা হয়, যেমন ‘আমার পাগলা ঘোড়ারে কইর মানুষ কই লইয়া যাও’।
এই পাগল নিয়ে আমাদের দেশে অসংখ্য কৌতুকও চালু আছে। তেমনই একটি প্রচলিত কৌতুক।
দীর্ঘদিন চিকিৎসা করার পর তিন পাগলকে নিয়ে বসেছেন চিকিৎসক।
চিকিৎসক: বলো তো, ৩ কে ৩ দিয়ে গুণ করলে কত হয়?
প্রথম পাগল: ৩৯৮হতাশ চিকিৎসক দ্বিতীয়জনকেও একই প্রশ্ন করলেন।
দ্বিতীয় পাগল: মঙ্গলবারততোধিক হতাশ হয়ে চিকিৎসক তৃতীয়জনকেও একই প্রশ্ন করলেন।
তৃতীয় পাগল বললেন, ‘নয়।’চিকিৎসক খুশি হয়ে বললেন, ‘ভেরি গুড! এবার বলো তো, তুমি এটা কীভাবে বের করলে?’
তৃতীয় পাগল: খুবই সহজ! ৩৯৮ থেকে মঙ্গলবার বিয়োগ করেছি!
মানসিকভাবে অসুস্থ লোকদের আমরা সহজে ‘পাগল’ বলে সম্বোধন করি। অবজ্ঞা বা উপেক্ষা করি। আমরা আসলে মনকে, মনের সমস্যা বা অসুখকে গুরুত্ব দিই না। অথচ শরীরের চেয়ে মন কখনো কখনো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। শরীর আর মন দুটি আলাদা বিষয়। কখনো কখনো আমাদের শরীর খারাপ থাকে, কখনো কখনো মনও খারাপ থাকে। কিন্তু আমরা শরীরের সুস্থতা নিয়ে যতটা চিন্তিত, মনের বিষয়টি ততটাই উপেক্ষিত। শরীর খারাপ হলে আমরা উতলা হয়ে যাই, মন খারাপকে পাত্তাই দিতে চাই না। নিজেরা তো মনকে পাত্তা দিই-না, কেউ যদি মনের অসুখটা ধরিয়ে দেন, আমরা কৃতজ্ঞ হওয়ার বদলে তাঁর ওপর খেপে যাই। শরীরের যেমন ডাক্তার আছে, মনেরও ডাক্তার আছে। কাউকে মনের ডাক্তারের কাছে যেতে বললে তিনি রেগে যান, মুখের ওপর বলে বসেন, আমাকে কি পাগল মনে হয়? মন নিয়ে এই মানসিকতা আমাদের বিপদে ফেলে দেয়।
যেমন বিপদ ঘটিয়েছেন নওগাঁর পত্নীতলার কিছু মানুষ। এ ঘটনাটি প্রমাণ করে, আমাদের মনের যত্ন, মনের চিকিৎসা আজ খুব বেশি দরকার।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট