গ্রামটির নাম চরিলাম। ঠিক কেমন করে এই নাম তার কোনো ইতিহাস বা কার্যকারণ আমি আমার পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে উদ্ধার করতে পারিনি। তবে গ্রামটির বয়স যে দুই-আড়াই শ বছরের বেশি না, সেটি মোটামুটি নিশ্চিত। গ্রামের মাঝামাঝি অংশে ছিল একটি বিশালাকৃতির বটগাছ, যেটিকে বয়স নির্ধারণের মাপকাঠি হিসেবে অনেকেই মনে করেন। সেই বটগাছ ছিল ঘন বনজঙ্গলে আচ্ছাদিত। কথিত আছে এই জঙ্গলে একদা বাঘ দেখা যেত, তাই এখনো বাঘবাড়ি>বাগবাড়ি হিসেবে পরিচিত।
ছোটবেলায় প্রবাদ শুনেছিলাম, ‘আপথ পথ হয়, জঙ্গল হয় মঙ্গল’।
আমাদেরও তা-ই হয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালে বটগাছটি রেখে বাকি জঙ্গল পরিষ্কার করে এখানে একটি প্রাইমারি স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়। আমি যখন স্কুলে ভর্তি হই তখন চাটাইয়ের ওপর বসে পাঠ নিতাম। চতুর্থ-পঞ্চম শ্রেণিতে দুই-চার জোড়া বেঞ্চ ছিল বলে মনে পড়ে। সেই স্কুলের ছাত্ররা আজ শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, বিসিএস ক্যাডার, ব্যবসায়ী হয়ে সুনামের সঙ্গে কাজ করছে। এখনকার নীল-সাদার মিশেলে সুন্দর ড্রেস পড়ুয়া ছোট্ট ছোট্ট সোনামণিদের পদচারণে সেই বাগবাড়ি এখন মুখর।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার নাটঘর ইউনিয়নে এর অবস্থান। কালজয়ী উপন্যাস ‘তিতাস একটি নদীর নাম’–এর লেখক অদ্বৈত মল্লবর্মণের গ্রাম গোকর্ণঘাট থেকে তিতাসের যে অংশটি মেঘনার দিকে পা না বাড়িয়ে বাঁদিক ঘুরে সোজা দক্ষিণে চলে গেছে, তার উজানে আমাদের এই গ্রাম।
অনুন্নত যোগাযোগব্যবস্থার কারণে গ্রামের কৃষিব্যবস্থাও ছিল পুরোপুরি প্রকৃতিনির্ভর। চৈত্র-বৈশাখ মাসে বৃষ্টির জন্য চাতক পাখির মতো বসে থাকত কৃষকেরা। কয়েক গ্রাম মিলে মাঠে যেমন হতো বৃষ্টির নামাজ, তেমনি রং মেখে সং সেজে উঠানে উঠানে ‘আল্লাহ মেঘ দে, ছায়া দে, পানি দেরে তুই আল্লাহ...’ গান গেয়ে নেচেগেয়ে মেতে উঠত কিষান-কিষানি-গ্রামের বঁধুরানি।
কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি হলে সবাই শশব্যস্ত হয়ে মাঠে নেমে পড়ত। পারস্পরিক সহযোগিতার নিদর্শন ছিল দিয়ারিশা নামক হালচাষ।
ঋতুপরিক্রমায় বর্ষা আসত। ধুম পড়ে যেত চারদিকে মাছ ধরার। ধর্মজাল, খড়াজাল, বেল, পেলুন,
আনতা, বরা-পাতা কিংবা কাছি টেনে মাছ ধরার সেই দৃশ্য এখন প্রায় বিলুপ্ত।
অগ্রহায়ণ ছিল উৎসবের মাস। ধান কাটা, মাড়াই, রোদে শুকানো এবং সবশেষে নাড়া পোড়া দেওয়ার পর শুরু হতো রবিশস্য ফলানোর কাজ।
অগ্রহায়ণের শেষেই শীত। ঘরে ঘরে তখন চলত নবান্ন উৎসব। নানা ধরনের পিঠা, চিড়া, মুড়ি, মোয়ার আয়োজনের মাঝে রাতে বসত পুঁথিপাঠ, যাত্রাপালা।
গ্রামের লোকজ ঐতিহ্যগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল লাঠিখেলা! সেসব লাঠিয়ালেরা আমাদের ছোটদের চোখে ছিল যেন একেকজন নায়ক!
বছর চারেক আগে বিদ্যুতায়নের আওতায় আসা এবং দুই বছর আগে তিতাসের ওপর নির্মিত সুদীর্ঘ ব্রিজটির কল্যাণে পুরো গ্রাম আজ যেন শহুরে রূপ ধারণ করেছে! বেকারত্ব ঘোচাতে শিক্ষিত যুবকেরা উদ্যোক্তা হওয়ার চেষ্টা করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচ্যকলা বিভাগ থেকে পাস করা যুবক শামির উচ্চপদে চাকরির পাশাপাশি সতেজ অ্যাগ্রো নামে একটি খামারবাড়ি গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয়েছেন। আরও অনেকে অনুপ্রাণিত হবে ভেবে শামিরের সতেজ অ্যাগ্রোর পুকুরের ছবিটি দিয়ে আজকের লেখা শেষ করছি।