কোপার্নিকাস তার শেষ জীবনে ‘দ্য রিভলিউশনিব্যস’ নামে বইয়ে লিখে গিয়েছিলেন, ‘সূর্য নয়, বরং পৃথিবীই সূর্যের চারদিকে ঘোরে।’ কোপার্নিকাসের মতবাদে বিশ্বাস করতেন ব্রুনো এবং প্রচার করতেন। তখনকার বাঘা বাঘা পণ্ডিত আর ধর্মযাজকেরা মনে করতেন পৃথিবী মহাবিশ্বের কেন্দ্রে, পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে সব গ্রহ-নক্ষত্র। বাইবেলে নাকি এমন কথাই লেখা ছিল। ব্রুনো যা বলেছেন সবই ধর্মবিরোধী। ধর্ম ও বাইবেলের বিরুদ্ধে কথা বলার অপরাধে তৎকালীন ইতালির পোপের নির্দেশে ব্রুনোকে বন্দী করে দীর্ঘ আট বছর চলে নির্যাতন এবং ১৬০০ সালে তাঁকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়।
গ্যালিলিওকেও তৎকালীন ক্যাথলিক চার্চ শাস্তি প্রদান করেছিলেন। তিনিও কোপার্নিকাসের মতবাদ প্রচার করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘ব্রুনোকে অন্যায়ভাবে হত্যা করেছে মূর্খ যাজকেরা।’
ব্রুনোকে পুড়িয়ে হত্যা করার ১৬ বছর পর গ্যালিলিও ঈশ্বরের অস্তিত্বকে চ্যালেঞ্জ করেছেন অভিযোগ তুলে রায় ঘোষণা করা হয়, জীবনে আর কখনো বিজ্ঞানচর্চা করতে পারবেন না গ্যালিলিও, দেওয়া হয় কারাদণ্ড। অন্ধকার বন্দিশালায় দীর্ঘ সময় অসুখ-যন্ত্রণায় জর্জরিত হয়ে মারা যান তিনি।
বিজ্ঞান ও ধর্মের হাজার বছরের দ্বন্দ্বের বিবরণ আছে জন উইলিয়াম ড্রেপারের ‘হিস্ট্রি অব দ্য কনফ্লিক্ট বিটুইন রিলিজিয়ন অ্যান্ড সায়েন্স’; আন্দ্রেই ডিকসন হোওয়াইটের ‘এ হিস্ট্রি অব দ্য ওয়ারফেয়ার অব সায়েন্স উইথ থেওলজি ইন ক্রিস্টেনডম; পল কুর্তজের ‘সায়েন্স অ্যান্ড রিলিজিয়ন: আর দে কমপেটিবল?’ ইত্যাদি গ্রন্থে। যুগ যুগ ধর চলমান বিজ্ঞান ও ধর্মের এই ভুল-বোঝাবুঝির সর্বশেষ ঘটনা মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার বিনোদপুর রামকুমার উচ্চবিদ্যালয়ের গণিত ও বিজ্ঞানের শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডল। ২০ মার্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণিতে তিনি ইসলাম ধর্ম ও ধর্মীয় বিভিন্ন বিষয়ে আপত্তিকর কথা বলেছেন—এই মর্মে অভিযোগ এনে শিক্ষার্থীরা প্রধান শিক্ষক বরাবর বিচারের দাবিতে লিখিত অভিযোগ করে। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগ দেন এলাকার কিছু লোক। পরদিন ইসলাম ধর্মকে অবমাননার অভিযোগ এনে বিদ্যালয়ের অফিস সহকারী মো. আসাদ বাদী হয়ে হৃদয় মণ্ডলের বিরুদ্ধে মামলা করেন এবং ওই দিনই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। হৃদয় মণ্ডলের জামিন চাওয়া হলেও আদালত জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেন।
কী ঘটেছিল সেদিন ক্লাসে? শিক্ষার্থীদের ধারণ করা ১৭ মিনিটের শিক্ষার্থী-শিক্ষকের আলাপচারিতা বিশ্লেষণ করে বিশ্লেষকেরা বলছেন, হৃদয় চন্দ্র মণ্ডল নতুন কিছু বলেননি। বিজ্ঞান ও ধর্ম সম্পর্কে খুব সাধারণ ও মৌলিক কথা এগুলো। আমরা জানি এবং প্রায়ই বলি। এসব জেনেও মানুষের ধর্ম পালন করতে কোনো অসুবিধা হয় না। হৃদয় মণ্ডল ধর্মকে ‘বিশ্বাস’ ও বিজ্ঞানকে ‘প্রমাণভিত্তিক জ্ঞান’ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। কেউ কেউ আবার ঘটনাটি ধর্ম ও বিজ্ঞানের বাইরে গিয়ে সম্পূর্ণ আলাদা প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক রাজনীতির অংশ হিসেবেও দেখছেন।
চাকরির সীমিত সুযোগ, বিজ্ঞান শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট বই ও উপকরণের অপর্যাপ্ততা, উচ্চশিক্ষা স্তরে বিজ্ঞানের ফ্যাকাল্টিগুলোতে সীমিত আসনসংখ্যাসহ বিভিন্ন কারণে আমাদের দেশে বিজ্ঞান শিক্ষার প্রতি শিক্ষার্থীদের মারাত্মক অনীহা দেখা দিয়েছে। শিক্ষাবিষয়ক তথ্য ও গবেষণাবিষয়ক সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যুরো অব এডুকেশন ইনফরমেশন অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিকসের (ব্যানবেইস) করা জরিপের চিত্র এ দেশের বিজ্ঞান শিক্ষার ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা জাগায়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক হিসাবে, গত আট বছরে বিজ্ঞান শিক্ষার্থী কমার হার ৩১ দশমিক ৬৩ শতাংশ। বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী কমে যাওয়ার পেছনে বিশেষজ্ঞরা অন্যান্য কারণের সঙ্গে ভালো শিক্ষকের অভাবকে অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন; যারা শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করতে পারে, সমাজকে আশান্বিত করতে পারে এবং বিজ্ঞানের পড়ায় আগ্রহী করে তুলতে পারে। কিন্তু এ-ও সত্য, একজন ভালো শিক্ষকের গড়ে ওঠার পেছনে সামাজিক মূল্যায়নও চাই। মূল্যায়নের জায়গা থেকে দৃষ্টিপাত করলে, তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে হৃদয় মণ্ডলকে কারাগারে প্রেরণের ঘটনা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে বিজ্ঞানমুখী করে তোলার প্রচেষ্টা-সিঁড়ি থেকে কয়েক ধাপ পিছিয়ে গেল।