মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথি। দেবী সরস্বতীর পূজার দিন। সরস্বতী শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থে ‘সরস্+বতু’ স্ত্রী লিঙ্গে ‘ঈ’ প্রত্যয় যুক্ত যোগে ‘সরস্বতী’। ‘সতত রসে সমৃদ্ধা’। তিনি শুক্লবর্ণা, শুভ্র হংসবাহনা, ‘বীণা-রঞ্জিত পুস্তক হস্তে’ অর্থাৎ এক হাতে বীণা ও অন্য হাতে পুস্তক। শিক্ষার্থীরা দেবী সরস্বতীর পূজা বেশি করে। কেন? কারণ তিনি জ্ঞানদায়িনী বিদ্যার দেবী। বিদ্যা দান করেন তিনি। মানুষ জ্ঞানপিপাসু। সর্বদা জ্ঞানের সন্ধান করে। ‘নহি জ্ঞানেন সদৃশং পবিত্রমিহ বিদ্যতে’ (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা-৪/৩৯), অর্থাৎ ‘জ্ঞানের মতো পবিত্র আর কিছু নেই’।
ছোটবেলায় দেখতাম সরস্বতী পূজার সঙ্গে কৈশোরের একটা গভীর সংযোগ আছে। আর সব পূজা বড়দের, কেবল বাড়িতে সরস্বতী পূজার সকালে ছোটদের বইপূজা, অঞ্জলি দেওয়া, প্রসাদে বীরখণ্ডি (কেউবা বলে তিলে পাটালি) আর বছরের প্রথম কুল (বরই) খাওয়া। গুরুজনদের সতর্কবাণী থাকত: সরস্বতী পূজার আগে কুল খেলে বিদ্যে হবে না। ঔপনিবেশিক এই দেশে মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্ত পরিবার-কাঠামোয় ‘বিদ্যা’ সম্পর্কে বড্ডই স্পর্শকাতরতা ছিল। সব পড়ুয়া-কিশোরের কাছে, গাধার সামনে মুলার মতো ওই একটা আপ্তবাক্য অদৃশ্য অক্ষরে লেখা থাকত: লেখাপড়া করে যে গাড়িঘোড়া চড়ে সে।
কথাটা এখন ক্ষয়ে গেছে, কিন্তু সে কালে ওইটাই কিন্তু ছিল উজ্জীবনের মূলমন্ত্র। সরস্বতীর বরপুত্র বলে একটা কথা শোনা যেত। কিন্তু অভিজ্ঞতা ঘেঁটে দেখছি, মা সরস্বতী সম্পর্কে গভীর আস্থা ছিল ততটা গুডবয়দের নয়, যতটা ‘বিদ্যাস্থানে ভয়ে বচঃ’দের। তারাই নিষ্ঠার সঙ্গে এই ‘বিদ্যাং দেহি’ দেবীকে ডাকত ভক্তি ভরে, খুব চেষ্টা করত কুল না খেতে, কিন্তু খেয়ে ফেলতই বনে-বাদাড়ে বা বেপাড়ায় গাছ ঝাঁকিয়ে, অবশ্য স্বীকার করত না। সারা বছর যাদের হারিকেনের আলোয় পড়তে বসে চোখ জুড়ে যেত শ্রান্তিতে, সারা বিকেল ধরে বল পেটানোর চোটে, তারাই এই অনধ্যায়ের একটি মাত্র দিনে ছিল মা সরস্বতীর একনিষ্ঠ ভক্ত। ওই দিন পড়া নিষিদ্ধ। পড়তে বসতে বললে যাদের জ্বর আসত, বইয়ের পাতার অক্ষরের জঙ্গলে যারা পথ হারাত, তারাই সরস্বতীর মূর্তির পায়ের কাছে ভক্তি ভরে রেখে দিত ক্লাসের পাঠ্যবই ডাঁই করে—যদি দেবী দয়া করে ওই দুর্বোধ্য বিষয়গুলো কোনোভাবে বিদ্যার্থীর স্থবির মগজে অন্তঃপ্রবিষ্ট করিয়ে দেন, সেই ভরসায়।
পূজার পর মূর্তির পদতল থেকে গাঁদা ফুলের ছেঁড়া টুকরো বইয়ের পৃষ্ঠার মধ্যে গুঁজে রেখে সে কী আত্মপ্রসাদ! ভাবটা, এবার কে আর ঠেকায় আমাকে! বাবার হাতের চড়, দাদাদের কানমলা, ক্লাস-টিচারের বেত বা নিল-ডাউন করানো, এত সব আয়োজন দিয়েও যাদের বিদ্যা ব্যাপারটা গেলানো যেত না কিছুতেই, তাদের কিন্তু দেবীর ওপর আস্থা টলতে দেখিনি কোনো দিন। তারাই রাত জেগে লাল নীল হলদে রঙের কাগজ কেটে শিকলি বানাত, দিদিদের বা পিসিদের দিয়ে আলপনা দেওয়াত মেঝেয়, জোগাড় করে আনত গাছে চড়ে পলাশ ফুল, কাঁধে করে কুমোরপাড়া থেকে ঠাকুর আনতে বা বিসর্জন দিতে তাদের উৎসাহের কিছু কমতি দেখিনি। অবশ্য পূজার চেয়ে প্রসাদ ভক্ষণের টানটা ছিল বেশি। কখনো লুচি-লাবড়া-পায়েস, পিতলের ডেগে রাঁধা মুগের ডালের খিচুড়ি, বাঁধাকপির তরকারি আর কুলের অম্বল—আহ, এখনো যেন জিবে জল আসে!
ভাবতে ভাবতে মনে এল, এসব দিন কি একেবারেই পালটে গেছে? সরস্বতী পূজার দিনটা নিয়ে বড্ড যে আনন্দ আর মাতামাতি ছিল আমাদের। সেই ভোরে ওঠা, রোদে দাঁড় করিয়ে খালি গায়ে তেল-হলুদবাটা মাখিয়ে মায়ের স্নান করিয়ে দেওয়া হি-হি করা শীতে—তার রোমাঞ্চ কি আজকে আর নেই? কিংবা দিদি বা ছোট বোন যে আবদার করে শাড়িতে হলুদ রং ছুপিয়ে নিত, তারপর সেই হলুদ শাড়ি আধগোছানো করে পরে সে কী ছুট স্কুলের দিকে! ‘কৈশোর-যৌবন যবে দোহে দেখা দিল’, সেই সময়ে পথে বেরিয়ে বন্ধুদের নিয়ে মেয়ে-স্কুলে ঠাকুর দেখতে যাওয়ার সেই অদম্য টানটা আজও কি ছেলেদের আছে? মাঘের উতলা হাওয়ায় কলেজের সহপাঠিনীদের শ্যাম্পু-করা চুলের ছড়ানো সুবাসে বুকের মধ্যে দামামা বাজার প্রহর কি আজও নেই? কী জানি!
শ্বেতপদ্মাসনা দেবীর দিকে চাইলে এখনো কত মধুর মধুর ধ্বনি বাজে। নিভৃতবাসিনী বীণাপাণির অমৃতমুরতিমতি বাণীর চেয়ে অনেক সজীব আমাদের সেই অভিমানী বিদ্যার্থী জীবনের শুভ্র স্মৃতি। শুভ্রই তো, তাতে এক ফোটা স্বার্থকলঙ্কের দাগ লাগেনি আজও।
আমাদের ছোটবেলায় সরস্বতীর মূর্তিপূজা কলেজে বা স্কুলে হলেও বাড়িতে হতো বইপূজা। একটা কাঠের জলচৌকিতে আসন পেতে তাতে রাখা হতো বই, দোয়াতে দুধ ভরে তাতে থাকত খাগের কলম আর যবের শিষগাছ। পুরুতমশাই এসে সংস্কৃত মন্ত্র পড়ে তাতেই আবেশ তৈরি করতেন। তার সঙ্গে বাড়ির পড়ুয়া ছেলেমেয়েরা সমস্বরে হেঁকে বলত:
সরস্বত্যৈঃ নমো নিত্যম্
ভদ্রকাল্যৈ নমো নমঃ।
বেদবেদাঙ্গ বেদান্ত
বিদ্যাস্থানেভ্য এব চ।।
তিনবার পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার জন্য ঝুরো ফুলের আয়োজন থাকতই। দূর থেকে যারা ফুল ছুড়ত বইকে লক্ষ্য করে, তাদের কারও কারও লক্ষ থাকত ঠাকুরমশাইয়ের মাথার দিকে। ফলে, গাঁদা ফুলের পাপড়িশোভিত সেই মানুষটিকে দেখে ভারী কৌতুক লাগত। আমাদের নজর থাকত অবশ্য বড় পরাতের প্রসাদের থালার দিকে। পরে তার থেকেই হবে প্রসাদ বিতরণ, যাতে থাকবে খই-চিড়ে-আখের টুকরো-খেজুর-কুল-সাদা বীরখণ্ডী-সাদা কদমা-সন্দেশ-মুড়কি। এই মুড়কি আবার দুই রকম। কনকচূড় ধান থেকে খই বানিয়ে তাতে চিনির রস আর এলাচের গন্ধ দিয়ে চিনির মুড়কি। আর এক রকম মুড়কি হতো নতুন খেজুরের গুড় দিয়ে। এখন আর এসব ভক্ষ্যের কীই-বা মহিমা আছে? ক্যাডবেরি-কোক-চিপস-চিকেন ফ্রাই-পিৎজা-বার্গারের স্বাদে এ কালের বাচ্চাদের রুচি পালটে গেছে। নতুন গুড়ের পায়েসের সাধ্য কী যে নবীন কিশোর-কিশোরীকে আকর্ষণ করে! তবে কি সরস্বতী পূজা আজ কেবল আমাদের দুর্মর স্মৃতিকাতরতা?
সত্যিই বছরে এই একটা দিনের সকাল দেখার মতো। দ্রুত ভ্রাম্যমাণ বা সাইকেলবিহারী পুরোহিত মুক্তকচ্ছ হয়ে ছুটছেন বাড়ি-বাড়ি আর তাকে আঁকশির মতো আটকে ধরে কাতর কণ্ঠে মিনতি: প্লিজ, ঠাকুরমশাই, একটুখানি ফুল ফেলে যান, প্লিজ, বাচ্চাগুলো অঞ্জলি দেবে বলে উপোস করে আছে। এক দিকে অনিচ্ছুক পূজারী, আরেক দিকে অসহায় গৃহস্থ। দেখার মতো সেই টানাপোড়েন। অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণের লেখা ‘সরস্বতী’ বইটিতে আছে, ‘সরস্বতী নিজে স্ত্রী দেবতা; কিন্তু স্ত্রীলোকেরা অঞ্জলি দিতে পাইত না। বাঙালির বোধ হয় ভয় ছিল, পাছে মেয়েরা দেবীর অনুগ্রহে লেখাপড়া শিখিয়া ফেলে।’
নারীবাদীরা এই ভেবে স্বস্তি পেতে পারেন যে এখন বিদ্যাদেবী কম্পিউটার-ট্যাব-ল্যাপটপ-মোবাইলের রূপ ধরে আমাদের সামনে হাজির হয়েছেন। এখনকার বিদ্যা ইন্টারনেটের বিশ্ববিদ্যা। তার কৃপায় কিন্তু লক্ষ্মী আর সরস্বতীকে একই সঙ্গে লাভ করা যায়। কাজেই, এ কালের মা সরস্বতীর পদতলে আর বই রেখে লাভ নেই, কারণ ভেতরে-ভেতরে এই হংসবাহনা মা যা হয়েছেন, তার বিগ্রহ হলো কম্পিউটার-ট্যাব-ল্যাপটপ-মোবাইলবাহনা বিশ্ববিদ্যাদায়িনী। সরস্বতীপূজার দিনে কম্পিউটার-ট্যাব-ল্যাপটপ-মোবাইল-ইন্টারনেটসহযোগে একটা নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে!
বাংলাদেশে এখন প্রায় পাঁচ কোটি মানুষের হাতের মুঠোয় দুনিয়া। এই মানুষগুলো স্মার্টফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। একটি ফোন সম্পূর্ণ জীবনকে কীভাবে বদলে দিতে পারে, কয়েক বছর আগে তা কল্পনারও অতীত ছিল। বস্তুত স্মার্টফোন কেড়ে নিলে এখন অনেকেরই জীবন থমকে যাবে। এখন অনেকেই নিজ নিজ স্মার্টফোনের স্ক্রিনে আঙুল চালিয়ে অনলাইন কেনাকাটা করছেন, নানা তথ্য আদান-প্রদান করছেন, দেশে-বিদেশে কথা বলছেন, এর সবই তো মা সরস্বতীর কৃপা!
এ কালের ছেলেমেয়েরা মা সরস্বতীর কাছে আর বিদ্যা প্রার্থনা করে না। তারা প্রার্থনা করে: মা, দ্রুতগতিসম্পন্ন ইন্টারনেট পরিষেবা দাও, বিনা পয়সায় ইন্টারনেট ওয়াই-ফাই দাও, মোবাইল ডেটা সস্তা করে দাও, আমাকে আমেরিকা-কানাডা-অস্ট্রেলিয়ায় লেখাপড়ার সুযোগ করে দাও। এখন ইন্টারনেট হয়ে উঠেছে বিদ্যা, কম্পিউটার-ট্যাব-ল্যাপটপ-মোবাইল হয়ে উঠেছে বিদ্যার বাহন!
প্রশ্ন হলো, আগামী দিনে শিশুরা কার পূজা করবে, দেবী সরস্বতীর, না ইন্টারনেট-কম্পিউটার-ট্যাব-ল্যাপটপ-মোবাইলের? নাকি অন্যকিছু এসে দখল করে নেবে নতুন প্রজন্মের মন ও মগজ?