আজকের পত্রিকা: দীর্ঘ একটা জীবন কাটাচ্ছেন। এই জীবনের সার্থকতা কী বলে আপনি মনে করেন?
বদরুদ্দীন উমর: জীবনের সার্থকতা বলতে কী বোঝায়, তা আমি জানি না। তবে জীবনে যেটা দেখেছি তার মধ্যে হয়তো-বা সার্থকতা থাকতে পারে। আমি তো পাঁচ খণ্ডে আত্মজীবনী লেখেছি। যেটাতে ১৯৪০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত আমার জীবনের অনেক কথা লেখা আছে। জীবনে বহু বিষয় দেখেছি। ব্রিটিশ আমলের জীবন, চল্লিশের দশকের জীবন, রাজনীতি, যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা দেখেছি এবং তখনকার সমাজ যে রকম ছিল, সেই সমাজে বসবাস করেছি। যে সমাজ এখনকার থেকে অনেক উন্নত ছিল। মানুষের মধ্যে সম্পর্ক অনেক ভালো ছিল—এসব দেখেছি। পরে ঢাকা ও অক্সফোর্ড, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে জীবনের বেশ কিছু সময় কাটিয়েছি এবং সেখানকার জীবনকে দেখেছি। তারপর রাজনীতি করতে এসে অনেক কিছু দেখেছি। মানুষের অনেক রকম অবস্থা দেখেছি। আন্দোলন দেখেছি। এসব দেখা কি সার্থকতা বলা যায় না।
আজকের পত্রিকা: এ জীবন নিয়ে কোনো খেদ কি আছে?
বদরুদ্দীন উমর: খেদ তো নেই। এখন পর্যন্ত ভালোই কেটেছে।
আজকের পত্রিকা: রাজনীতিবিদ এবং লেখক ও গবেষক—কোন পরিচয়টাকে বড় করে দেখতে ভালো লাগে এবং কেন?
বদরুদ্দীন উমর: আসলে একটার সঙ্গে আরেকটাকে আলাদা করে দেখা যায় না। দুটোর সঙ্গে দুটোই জড়িত। প্রথম হচ্ছে, আমি হঠাৎ করে কোনো কিছু করিনি। আমি লেখালেখির কাজ শুরু করেছি অনেক আগে। তবে যেসব লেখা আমি স্বীকার করি, সেসব লেখা শুরু করেছি ১৯৬৩ সাল থেকে। অনেক দেরিতে লেখা শুরু করি, তখন আমার ৩২ বছর বয়স। কিন্তু হঠাৎ করে আমি লেখালেখি আরম্ভ করিনি। অনেক লেখালেখি করে পরে একটা জায়গায় এসেছি।
চিন্তাভাবনার দিক থেকেও আমি ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়েছি। একটা সময় পর আমি রাজনীতিতে এসেছি। যদিও আমার পরিবারে তিন-চার পুরুষ আগে থেকে রাজনীতির চর্চা ছিল। সেটা ছিল উনিশ শতকের সময় থেকে। কিন্তু আমি নিজে কোনো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না ছাত্রজীবন থেকে। আমি কোনো ছাত্রসংগঠনের সদস্য থাকিনি কখনো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়েও কোনো ছাত্ররাজনীতি আমি করিনি, কোনো দল বা ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না। কিন্তু রাজনীতিসচেতন বরাবরই ছিলাম সেই ছোটবেলা থেকে।
পরবর্তী সকল পর্যায়ে এবং শেষ পর্যন্ত রাজশাহীতে থাকতেই এবং তার আগেই আমি ঠিক করেছিলাম আমি রাজনীতি করব। দেশের যে অবস্থা, সমাজের যে অবস্থা, তাতে মনে করেছি এটা পরিবর্তন করা দরকার, এ জন্য রাজনীতি করা দরকার। রাজনীতি করতে এসেছি অন্য কোনো কারণে নয়—সমাজ, দেশ ও মানুষের অবস্থার যেন পরিবর্তন করা যায়, সেই চেষ্টা করার জন্য।
১৯৬৩ সালে ‘সাম্প্রদায়িকতা’ বইটি লিখেছিলাম। তারপর এখন পর্যন্ত যত লেখালেখি করেছি, সেই লেখালেখির তাগিদ কিন্তু আমার মূলত রাজনৈতিক চিন্তা থেকে, আমার একটা আদর্শগত চিন্তা থেকে। কাজেই রাজনীতি এবং লেখালেখি দুটোই একেবারে অবিচ্ছিন্ন। আমি মনে করি, আমি কোনো সাহিত্যিক নই, আমি একজন রাজনীতিবিদ। যা আমি লিখি, ইতিহাস, রাজনীতি, দর্শন, সংস্কৃতি—সবকিছুই হচ্ছে রাজনীতির প্রয়োজনে। সবকিছুই আমার রাজনীতি ও আদর্শের প্রয়োজনে।
আজকের পত্রিকা: আপনি বাংলা একাডেমি ও ইতিহাস গবেষণা পরিষদের পুরস্কার ত্যাগ করেছিলেন এবং একুশে পদকও আপনাকে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু নেননি। কেন?
বদরুদ্দীন উমর: আমি পুরস্কার নিই না এ কারণে যে প্রথমত, আমি যে লেখালেখি করি, এটা আমি নিজের আন্তরিক তাগিদ থেকে করি, নিজের প্রয়োজন থেকে করি। এর জন্য আমাকে কেউ পুরস্কার দেবে, এটা আমার অসুবিধা লাগে। আমার ভালো লাগে না। আমি যে আন্তরিকভাবে কাজটা করছি, তার জন্য কেউ আমাকে পুরস্কার দেবে কেন? আর এই পুরস্কার বলতে আমি যেটা মনে করি, আসলে একজন লেখকের লেখা মানুষ যদি পড়ে, লেখা নিয়ে আলোচনা করে এবং মানুষ যদি তার দ্বারা উপকৃত হয়—তাহলে এটাই হলো একজন লেখকের আসল পুরস্কার।
দ্বিতীয়ত, পুরস্কার জিনিসটা এমনিতেই ভালো নয়। কারণ সাধারণত দেখা যায় যে পুরস্কার যাঁরা দেন, তাঁরা নিজেদের স্বার্থে যারা লেখে, তাদের চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেন। কারণ নোবেল প্রাইজ থেকে আরম্ভ করে আদমজী, দাউদ, আনন্দবাজার পত্রিকার পুরস্কার—এসব পুরস্কার তারা কেন দেয়? এরা কি দেয় এ জন্য যে উন্নত আদর্শ, প্রগতিশীলতা, লেখার উৎকর্ষ বৃদ্ধির জন্য একজন লেখককে পুরস্কার দেয়? তারা দেয় এ জন্য যে এসব লেখক পুরস্কার পেয়ে একটা সীমাবদ্ধতার মধ্যে আটকে থাকেন। কারণ যারা পুরস্কার দেয়, যাদের কথা বললাম, তারা প্রধানত দেশের ধনিক শ্রেণির লোক। এই ধনিক শ্রেণির লোকেরা অনেক সময় অনেক লুটপাট করে ধনসম্পদ সঞ্চয় করেন। এই ধরনের লোকেরা কিংবা কোন সরকার পুরস্কার দেয় এ জন্য যে, যাতে এসব লেখক একটা গণ্ডির বাইরে না যেতে পারেন। যাতে লেখকেরা একটা সীমানার মধ্যে থাকেন। একটা পুরস্কার দিলে মানুষের যেটা আসলে হয়, একবার পুরস্কার পেলে পরে আবার অন্য পুরস্কার পাওয়ার ঝোঁক তৈরি হয়।
উদাহরণস্বরূপ আমি বলতে পারি, পশ্চিমবঙ্গের লেখক মহাশ্বেতা দেবী যেমন ছিলেন। আমার সঙ্গে একসময় তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তিনি যেসব বিষয়ে লিখতেন বা কথাবার্তা বলতেন, তাতে আমার মনে হতো তিনি বুঝি পুরস্কার পছন্দ করেন না। তবে তিনি একবার একটা সরকারি পুরস্কার পেলেন। আমি তখন তাঁকে বললাম, আপনি কেন এ পুরস্কার নিলেন? তিনি তখন বললেন, এ পুরস্কার নেওয়া আমার ঠিক হয়নি। তারপর দেখলাম তিনি এরপর আরও পুরস্কার নিলেন এবং সব থেকে খারাপ ছিল, ম্যাগসাইসাইয়ের মতো সাম্রাজ্যবাদী পুরস্কার নিলেন। যে পুরস্কারের নগদ মূল্য ছিল প্রায় ৩০-৪০ লাখ টাকা। দেখা গেল, এসব পুরস্কার পাওয়ার পর তাঁর লেখালেখির মান নষ্ট হয়ে গেল। একই সঙ্গে তাঁর যে চরিত্রের ঋজুতা ছিল, মেরুদণ্ড যে খাড়া ছিল, সেটা নষ্ট হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একজন শাগরেদ হয়ে মারা গেলেন। কাজেই পুরস্কারের একটা খারাপ প্রভাব লেখকের মধ্যে পড়ে, সেটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।
আজকের পত্রিকা: মার্ক্সবাদের প্রতি আপনি কীভাবে আকৃষ্ট হলেন?
বদরুদ্দীন উমর: এর জবাবটা খুব সোজা। আমি মার্ক্সীয় রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হলাম আন্তরিকভাবে সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন চেয়েছি বলে। আমার বুদ্ধিসুদ্ধি আছে, লেখাপড়া করেছি। কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ—তা যাচাই করার একটা ক্ষমতা আছে। এই ক্ষমতার জোরে আমার মনে হয়েছে যে মার্ক্সবাদের চেয়ে উন্নততর কোনো চিন্তা নেই, কোনো রাজনীতি নেই। এ কারণে আমি মার্ক্সবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছি। আকৃষ্ট হয়ে আমি কমিউনিস্ট পার্টি করতে এসেছি। এর অন্য কোনো জবাব নেই।
আর আমি তো বিদেশে মার্ক্সসিস্ট হওয়ার জন্য যাইনি। অক্সফোর্ডে গিয়ে আমি অসংখ্য মানুষের সঙ্গে মিশেছি। অক্সফোর্ড এমন একটা জায়গা, সেখানে সারা দুনিয়া থেকে লোক যায়। সেখানে যত ইউরোপীয়, এশিয়া, আফ্রিকান জাতির মানুষ আছেন, তাঁদের সঙ্গে মেলামেশা করেছি। সেখানে বিভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষের সঙ্গে অনেক বিষয়ে মতবিনিময় করেছি। সেখানে এসবের সুযোগ অনেক বেশি।ওখানে গিয়ে হঠাৎ করে যে আমি মার্ক্সসিস্ট হলাম, ব্যাপারটা সে রকম নয়। কারণ, আমার চিন্তার মধ্যে ইতিমধ্যে অনেক পরিবর্তন হচ্ছিল। সেই পরিবর্তনের ধারাবাহিকতা হিসেবেই আমি অক্সফোর্ডে যাঁদের সঙ্গে দেখা হচ্ছিল, তাঁদের মধ্যে আলাপের মধ্য দিয়ে গিয়েছি।এভাবে আমার মধ্যে একটা পরিবর্তন হয়েছে। বলা যেতে পারে, রাজনৈতিক চিন্তা করতে গিয়ে আমি মার্ক্সীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছি।
আজকের পত্রিকা: আজকের পত্রিকার পক্ষ থেকে আপনাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা।
বদরুদ্দীন উমর: আজকের পত্রিকার সবার প্রতি আমার শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ রইল।