ওভারব্রিজটা ভেঙে ফেলার পর ফার্মগেটের এই জায়গাটা বেশ ফাঁকা লাগে। অভ্যাস বশে ওপরের দিকে তাকালে দেখা যায় মেট্রোরেলের বিরাট কাঠামো। ফার্মভিউ সুপার মার্কেটের উল্টোদিকে হলি রোজারি চার্চ ওরফে পবিত্র জপমালা রানির গির্জা অথবা আমাদের ব্যাপক পরিচিত তেজগাঁও গির্জা। এই গির্জা ছাড়িয়ে কয়েক কদম এগিয়ে একটি বাড়িতে থাকেন শাহজাদি সুলতানা।
দুই সন্তানের মা শাহজাদি মূলত গৃহিণী। বনসাই বানানোর পাশাপাশি শখের বশে আঁকেন ছবি। সেটিও সেই ছোটবেলার ইচ্ছাকে বাস্তব করতেই। বনসাই বানানোতে প্রশিক্ষণ নিলেও ছবি আঁকার বিষয়ে তাঁর কোনো প্রশিক্ষণ নেই। ছোটবেলার ভালো লাগা আর বড়বেলার অনুশীলন—এই দুই-ই তাঁকে শিল্পী বানিয়ে দিয়েছে।
শাহজাদি বলেন, ‘বনসাই নিয়ে জানার শেষ নেই। বনসাই এমন একটি সুন্দর শিল্প, যেখানে প্রাণ আছে। নিজের ইচ্ছেমতো প্রকৃতিকে ফুটিয়ে তুলতে পারা যায়। এটা আনন্দের বিষয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের শিশুরা পড়াশোনা আর প্রযুক্তিতে আটকে গেছে। এখন শিশুরা প্রকৃতির কাছাকাছি যেতে পারে না। তাদের আকৃষ্ট করতে বনসাই হতে পারে ভালো উপায়। অনেক গাছ হারিয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাওয়া গাছগুলোর বনসাই করলে সেগুলো টিকে থাকবে। চেনাও হবে।’
শাহজাদি সুলতানা শিশুদের জন্য বনসাই তৈরি করতে চান বলে জানান। তিনি বলেন, ‘বিশেষ করে বাচ্চারা বনসাই দেখলে কাছে পেতে চায়। ওদের জন্য বনসাই তৈরি করতে চাই। তারা দেখবে, কাছে রাখবে।’
প্রতিনিয়ত বনসাই তৈরি করে চলেছেন শাহজাদি। সে ক্ষেত্রে রাখার জায়গার সংকট তৈরি হচ্ছে। নিজের কাছে সব রেখে দেওয়ার উপায় নেই। নতুন গাছ করার জন্য পুরোনো গাছগুলো বিক্রি করে দিতে হয়। হিসাব রাখেননি কী পরিমাণ গাছ তিনি বিক্রি করেছেন। প্রতিবছর তিনি ১৫ থেকে ১৬টি বনসাই বিক্রি করেন। তিনি জানান, প্রতিটি গাছের একেকটি নিজস্বতা আছে। ডেপথ, অ্যাপেক্স, গাছের ডালগুলোকে সাজানো, অর্থাৎ সুন্দর একটি ফর্মুলা আছে বনসাইয়ের।
বনসাই তৈরি সময়সাপেক্ষ কাজ। শাহজাদি জানান, একদম ছোট একটি বনসাই করতে কমপক্ষে তিন বছর সময় লাগে। অনেক সময় কোনো কোনো গাছ বনসাই করতে সাত থেকে আট বছর সময় লেগে যায়। প্রতিটি গাছই প্রকৃতির কাছাকাছি থাকতে চায় বলে বনসাই ঘরে রাখলেও বেশির ভাগ সময় রোদের কাছাকাছি রাখতে হবে বলে জানান শাহজাদি।
বনসাইয়ের শুধু শিল্পগুণই আছে, তা নয়। এটি মানুষের মুডও ভালো রাখতে পারে। শাহজাদি মনে করেন, বিষণ্নতা কাটাতে বনসাইয়ের একটি ভূমিকা আছে। সে জন্য তিনি সবাইকে আহ্বান জানিয়েছেন, প্রকৃতির সঙ্গে মিশতে। তাতে অনেক মানসিক রোগের মতো ডিপ্রেশনও দূরে থাকবে।
অনেকক্ষণ আলাপ হয় শাহজাদি সুলতানার সঙ্গে। ছবি তোলা হয় ফাঁকে ফাঁকে। ফিরে আসতে আসতে ভাবি, এই মেগাসিটিতে একজন নারী বুনে চলেছেন একরাশ বনসাই স্বপ্ন। সে স্বপ্ন ক্ষুদ্র নয়। অথচ ‘বনসাই’ শব্দটিকে আমরা ‘ক্ষুদ্র’ অর্থে ব্যবহার করি। ব্যবহারিকভাবে শব্দের অর্থ কতভাবে বদলায়!