হোম > ছাপা সংস্করণ

শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত পুঁজিবাদ

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

আমাদের কাঙ্ক্ষিত সাহিত্য-সমালোচনার ধারাটি কেন বিস্তৃত হলো না এবং সাহিত্য-সমালোচনাই বা কেন বিকশিত হলো না—দুটি বিষয় কিন্তু পরস্পরসংলগ্ন। সাহিত্যবিচারে ইতিহাসের স্থান বিবেচনা ও ইতিহাসবিচারে দ্বান্দ্বিকতার প্রয়োগ—এরা যতটা গুরুত্ব পাওয়ার কথা ছিল, ততটা গুরুত্ব পায়নি। নান্দনিক বিচারটাই মুখ্য হয়ে রয়েছে। এর পেছনের ঘটনাটা হলো জ্ঞানচর্চার দুর্বলতা। জ্ঞানের চর্চা উৎসাহ পায়নি। বিশেষভাবে দর্শনচর্চা অবহেলিতই থেকেছে।

সাহিত্য-সমালোচনা বলে নয়, সাহিত্যের নিজেরই মূল্য কমে গেছে। সমাজে বস্তুগত উন্নতি ঘটেছে, কিন্তু সেই উন্নতি পুঁজিবাদী ধরনের। এই উন্নতি মুনাফা চেনে, সংবেদনশীলতা বোঝে না। সাহিত্য তো বস্তুগত মুনাফা দেবে না, দেবে অন্তর্গত আনন্দ, বিকশিত করবে সংবেদনশীলতাকে। ভোগবাদিতা এসেছে, এসেছে স্থূল বিনোদন। সাহিত্য তো স্থূল বিনোদনের সামগ্রী নয়। দুরন্ত তৎপরতা চলছে মিডিয়ার। মিডিয়া জগৎটাকে বড় করতে গিয়ে ছোটই করে ফেলেছে। ছোট পর্দায় আমাদের আটকে রাখছে। যেমন ধরা যাক চলচ্চিত্র। সেটা তো সামাজিকভাবে উপভোগ করার জিনিস, এখন প্রায় সবাই 
তো সিনেমা দেখছে ব্যক্তিগতভাবে, যেন লুকিয়ে লুকিয়ে।

ঢাকায় তো আমরা ছিলাম একটা মফস্বলীয় পরিবেশে। বাইরে গিয়ে বিভিন্ন চিন্তাধারার সঙ্গে পরিচয়টা বেড়েছে। মার্ক্সীয় চিন্তার বিষয়ে আগ্রহটা আগেও ছিল, কিন্তু পরিচয়ের সুযোগ ছিল সীমিত। লিডসে গিয়ে সুযোগটা বাড়ল। সাহিত্য ও ইতিহাসের ভেতর থেকেই রচিত, এটা তো জানতামই; কিন্তু ইতিহাসে যে অর্থনীতি থাকে, থাকে শ্রেণিবিভাজন ও শ্রেণিদ্বন্দ্ব—এই জ্ঞানটা মার্ক্সবাদ আমাকে বিশেষভাবে দিয়েছে। লেখক যতই নিরপেক্ষ হোন না কেন, সমাজের দ্বন্দ্বগুলো তাঁর ওপরে প্রভাব ফেলবেই। তিনি না চাইলেও তাঁর একটি মতাদর্শিক অবস্থান সৃষ্টি না হয়ে উপায় নেই। মতাদর্শটা সাহিত্যে সব সময়ই থাকে। আসলে কোনো সাহিত্যই আদর্শনিরপেক্ষ নয়। মার্ক্সবাদ ইতিহাসের ব্যাপারে ঔৎসুক্য এবং মতাদর্শের প্রশ্নে কৌতূহল জাগিয়ে তোলে। ব্যক্তিগতভাবে আমার মধ্যেও সেটা ঘটেছে।

তবে সমাজ, রাষ্ট্র, সংস্কৃতি ও বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা যে ধারায় বিকশিত হওয়াটা প্রত্যাশিত ছিল, সেই ধারায় ঘটেনি। কথা ছিল আমরা মুক্তি পাব। মুক্তি পাব আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার কবল থেকে। সেটা পাইনি। রাষ্ট্র বরং আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন অধিক আমলাতান্ত্রিক এবং বৈষয়িক সব উন্নতির একই রাস্তা, পুঁজিবাদী। এ ব্যবস্থায় ব্যক্তি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে এবং আত্মস্বার্থপর হয়ে ওঠে। রাষ্ট্র সমালোচনা সহ্য করে না। সমাজ ইহজাগতিকতা থেকে পশ্চাতে সরছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ক্রমাগত সংকুচিত হয়ে পড়েছে। মিডিয়া স্বাধীন মত প্রকাশকে উৎসাহ দেয় না, নীরবে তার কণ্ঠরোধ করে। সার্বিক এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিবাদ এখন অত্যন্ত ক্ষীণ।

সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীরাও এ ব্যবস্থার অধীনে চলে গেছেন। কিন্তু তাঁদের কাজ তো বিদ্যমানের কাছে আত্মসমর্পণ নয়। ব্যবস্থার সঙ্গে দ্বন্দ্বে না থাকলে ব্যবস্থা তো বদলাবেই না, তাঁদের কাজও মূল্য হারাবে। সমস্যাটা অবশ্য কেবল আমাদের দেশের নয়, সারা বিশ্বেরই। প্রতিবাদ বিশ্বজুড়েই হচ্ছে, আমাদের দেশেও তা হওয়া চাই। হবে বলে আশা রাখি; নইলে সত্য তো হবে হতাশা ও আত্মসমর্পণ। আত্মসমর্পণ কিন্তু আত্মহত্যারই পথ। পুঁজিবাদী উন্নতির চাপে এখন কেবল সাহিত্য নয়, মানবিক বিদ্যারই কোণঠাসা দশা হয়েছে। ১০০ বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যখন প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন কমার্স বলে কোনো স্বতন্ত্র অনুষদ তো নয়ই, বিভাগও ছিল না। কমার্স ছিল অর্থনীতি বিভাগের একটি অংশ। তারপর কমার্স অনুষদ হলো, অনুষদে বিভাগের সংখ্যা বাড়ল। কমার্স অনুষদে এখন নয়টি বিভাগ। অনুষদের নামও গেছে বদলে। সেখানে বাণিজ্য নেই, উঠে এসেছে ব্যবসায়, অনুষদের নাম হয়েছে ফ্যাকাল্টি অব বিজনেস স্টাডিজ। একসময় ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউট ছিল না। পরে হয়েছে এবং এখন তা অত্যন্ত আকর্ষণীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে। বাণিজ্য অধ্যয়নের গুরুত্ব অনেক; মানবিক বিদ্যার অবস্থা গরিব আত্মীয়র মতো।

উন্নয়ন একপেশে হচ্ছে। ভারসাম্য থাকছে না। এই উন্নয়নে সাহিত্য গুরুত্বপূর্ণ নয়; তাই সাহিত্য-সমালোচনাও মর্যাদা পাচ্ছে না। সাহিত্য তো আসবে প্রথমে, তারপর না সমালোচনা। পাকিস্তান যখন প্রতিষ্ঠিত হলো, তখন শোনা যাচ্ছিল আমাদের সাহিত্য হবে স্বতন্ত্র। ভাষা, বিষয়বস্তু, উপস্থাপনা সবই হবে পশ্চিমবঙ্গের থেকে আলাদা। বাংলা সাহিত্যের ঐতিহ্যের একাংশও বাদ দেওয়া চাই। তেমন কাণ্ড কিন্তু ঘটেনি। তবে হ্যাঁ, রাষ্ট্র যেহেতু আলাদা এবং সমাজবিকাশের ধারাও যেহেতু স্বতন্ত্র, তাই সে বাস্তবতার প্রকাশ সাহিত্যে তো ঘটবেই। আর এটাও তো মানতে হবে যে বাংলাদেশ যেহেতু একটি স্বাধীন ও সার্বভৌমিক রাষ্ট্র এবং পশ্চিমবঙ্গ বৃহৎ ভারতীয় রাষ্ট্রের একটি অঙ্গরাজ্য মাত্র, তাই বাংলা সাহিত্যের চর্চা এখানেই বেশি হবে এবং হচ্ছেও। আর এই চর্চার ক্ষেত্রে মননশীলতার দিক দিয়ে বাংলাদেশের সাহিত্য অধিক সমৃদ্ধ। তা ছাড়া তুলনামূলকভাবে আমাদের সাহিত্যে বৈচিত্র্যও অধিক।

সাহিত্যের লড়াইটা কিন্তু করোনা মহামারির ওই বিচ্ছিন্নতার বিরুদ্ধেই। সাহিত্য হচ্ছে সামাজিক। বই আমরা একলা একলাই পড়তে পারি, পড়িও; কিন্তু বই আমাদের যুক্ত করে বড় জগতের সঙ্গে, নিয়ে যায় অজানা, অদেখা মানুষদের কাছে; আমরা তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ি। মূল সত্যটা দাঁড়ায় এই যে শিল্প-সাহিত্যের প্রতিটি রূপকল্পেরই নিজস্ব একটা ইতিহাস আছে; কিন্তু তাদের ইতিহাস আবার সমাজের ইতিহাস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। শিল্প-সাহিত্য মহৎ হয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করে। সমাজের বিন্যাসের সঙ্গে তাকে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হতে হয়। দ্বন্দ্ব না থাকলে অস্তিত্ব হয়তো থাকতে পারে, কিন্তু প্রাণ থাকে না। বিক্ষিপ্তভাবে এসব কথা অন্যত্র যে পাওয়া যায় না, এমন নয়। কিন্তু বৈজ্ঞানিকভাবে পাওয়া যায় মার্ক্সবাদে। সেখানেই সে অত্যন্ত বিশিষ্ট।

মার্ক্সবাদ এই সত্যটাকে ধরিয়ে দেয় যে সাহিত্যিকেরা শ্রেণির ভেতরে থেকেই কাজ করেন। কিন্তু শ্রেণির বন্ধন ডিঙিয়ে তাঁরা হতে চান সর্বজনের, আকাঙ্ক্ষা থাকে হবেন সর্বকালীন। সর্বজনীনতা ও সর্বকালীনতা শ্রেণি-উত্তরণের দরুনই ঘটে। এই উত্তরণকে শ্রেণিচ্যুতি বললেও অন্যায় হবে না। শিল্প-সাহিত্য ব্যক্তিরই সৃষ্টি, কিন্তু ওই সৃষ্টি ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকে না, সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গেই চলে যায় সামাজিক মালিকানায়। তৎকালীন এবং অনেককালীন মালিকানায়। আর সর্বকালীন হলে তো কথাই নেই। সেখানে তো অমর সৃষ্টি। চরম সার্থকতা।

পৃথিবীজুড়ে এখন পুঁজিবাদের দৌরাত্ম্য চলছে। পুঁজিবাদ ব্যক্তিমালিকানা ও মুনাফায় বিশ্বাস করে এবং সবকিছুকে পণ্যতে পরিণত করে ফেলবে ভাবে। পুঁজিবাদ মানুষের সঙ্গে মানুষের এবং মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির বিচ্ছিন্নতা ক্রমাগত বাড়াতে থাকে। বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদ এখন মানুষের সভ্যতার অগ্রগতির পথে অন্তরায় শুধু নয়, শত্রুপক্ষেই পরিণত হয়েছে। শিল্প-সাহিত্যের কাজ ঐক্যের বন্ধনকে, সহমর্মিতার অনুভবকে শক্তিশালী করা। শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে তাই পুঁজিবাদের দ্বন্দ্ব চলছে।

এ ব্যবস্থাটিকে ভাঙা চাই। শিল্প-সাহিত্য একাই যে একে ভাঙতে পারবে, তা মোটেই নয়। তবে শিল্প-সাহিত্য অনুপ্রেরণা ও শক্তি জোগাতে অবশ্যই পারবে সেই আন্দোলনকে। বদলাবে মানুষই, কিন্তু বদলানোর জন্য শক্তি চাই। সে শক্তি রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিকারীদের নয়, তার বিপরীতে দাঁড়ানো মেহনতি মানুষের। মার্ক্সবাদ এই সত্যটাকেই বিশেষভাবে জানিয়ে দেয়। জানিয়ে দেয় এ কথাটাও যে শিল্প-সাহিত্যের চর্চা যেমন ইতিহাসের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, তেমনি ইতিহাস নিজেও এগোয় শিল্প-সাহিত্যের অগ্রসরমাণতার কারণে। সেই সঙ্গে বলে যে মানুষের সভ্যতার ইতিহাস সামনের দিকেই যাবে, পেছনমুখো হবে না। 
করোনা মহামারি বিশ্বের সব মানুষকে অসামাজিক প্রাণীতে পরিণত করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। রোগটা পুঁজিবাদ থেকেই উদ্ভূত এবং পুঁজিবাদেরই প্রতিভূ। পুঁজিবাদী উন্নয়ন মানুষকে স্বাস্থ্যসেবার নিরাপত্তা দেয়নি এবং প্রকৃতির ওপর নির্মম নিষ্পেষণ চালিয়েছে। প্রকৃতি নানাভাবে প্রতিশোধ নিচ্ছে; করোনাভাইরাসের আক্রমণ তারই একটি জাজ্বল্য প্রমাণ।

এই মহামারি মানুষের সামাজিকতাকে খর্ব করে দিয়েছে। সবাইকে কম-বেশি প্রভাবিত করেছে বৈকি। এসব ঘটনা ভাবনার কেন্দ্রে পুরোনো ভাবনা জোরদার হয়েছে। সেটা হলো এই যে এই ব্যবস্থার বদল চাই এবং তার জন্য যা প্রয়োজন হবে তা হলো, সম্পদের ব্যক্তিমালিকানার জায়গাতেই সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত করা।

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ