২০১৮ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য চীন সরকারের স্কলারশিপ নিয়ে আমি এ দেশে আসি। দেখতে দেখতে চারটি বছর কেটে গেল চীন দেশে। মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করার পর আবার চীন সরকারের স্কলারশিপ পেয়ে বর্তমানে পিএইচডি প্রোগ্রামে অধ্যয়ন করছি। চার বছর ধরে আমি বসবাস করছি চীনের চিয়াংশি প্রদেশের রাজধানী নানছাং শহরে। নিজের ব্যক্তিগত প্রয়োজনে হোক বা অন্যের প্রয়োজনে শহরের বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয়। যাতায়াতের ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময় ব্যবহার করি গণপরিবহন, অর্থাৎ সিটি বাস, মেট্রোরেল বা সাবওয়ে।
চীনে সর্বোচ্চ ব্যবহৃত যানবাহনের মধ্যে একটি হলো মেট্রো। যেকোনো শহরের সিংহভাগ জনগণ এই সেবা নিয়ে থাকে। কোনো রকম ভোগান্তি ছাড়া মেট্রোরেল ননস্টপ সেবা প্রদান করে থাকে।
নানছাং শহরের গণপরিবহন ব্যবস্থায় মেট্রোরেল, যাকে আমরা পাতালরেলও বলি তা রয়েছে, এটি প্রাদেশিক সরকারের অধীনে পরিচালিত হয়। চীনে গণপরিবহন সম্পূর্ণভাবে সরকার কর্তৃক পরিচালিত হয়, ব্যক্তিমালিকানাধীন কোনো গণপরিবহন নেই। চীনের ব্যস্ততম তিনটি মেট্রোরেল হলো বেইজিং, গুয়াজু ও সাংহাই শহরে।
বিশ্বের প্রায় ষাটের অধিক দেশে ইতিমধ্যে মানুষকে মেট্রোরেলের সেবা দেওয়া হচ্ছে। ২০২১ সাল পর্যন্ত বিশ্বের ৬১টি দেশের দুই শতাধিক শহরে গণপরিবহন হিসেবে মেট্রোরেল চালু হয়েছে। কেবল চীনেই ৪৬টি মেট্রো সিস্টেম রয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতে রয়েছে ১৫টি করে। অবশেষে বাংলাদেশও সেই ক্লাবে যোগ দিয়েছে। সাড়ে ছয় বছর আগে রাজধানীর চিরচেনা যানজট এড়াতে উত্তরায় দেশের প্রথম মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ শুরু হয়। ২০২২ সালের শেষে এসে উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে তা পরিণতি পেল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুধবার বর্ণিল আয়োজনে দেশের প্রথম এই বৈদ্যুতিক গণপরিবহনের উদ্বোধন করেন, যার মধ্য দিয়ে নতুন যুগে প্রবেশ করল বাংলাদেশ।
নানছাং শহরে পাতালরেল নির্মাণ পরিকল্পনা রাজ্য কাউন্সিল কর্তৃক ২০০৯ সালের জুলাই মাসে অনুমোদিত হয়েছে। পরিকল্পনায় পাঁচটি লাইন রয়েছে, যার মোট দৈর্ঘ্য ১৯৮ কিলোমিটার,
যেখানে মোট ১৪৬টি স্টেশন রয়েছে। তাদের মধ্যে লাইন-১-এর প্রথম পর্বের কাজটি সম্পন্ন হয় ২০১৫ সালের ২৬ ডিসেম্বর এবং জনসাধারণের চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়।
পাতালরেলের লাইন-১-এর মোট দৈর্ঘ্য ২৮.৮ কিলোমিটার, যেখানে ২৪টি স্টেশন রয়েছে এবং মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ২১০ বিলিয়ন ইউয়ান।
পাতালরেলের লাইন-২ -এর মোট দৈর্ঘ্য ২৩.৮ কিলোমিটার, যেখানে ২২টি স্টেশন রয়েছে এবং মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ১৬০ বিলিয়ন ইউয়ান। লাইন-২-এর প্রথম পর্বের কাজটি সম্পন্ন হয় ২০১৭ সালের ১৮ আগস্ট। লাইন-৩-এর মোট দৈর্ঘ্য ২৮.৫ কিলোমিটার, যেখানে ২২টি স্টেশন রয়েছে।
২০২০ সালের ২৬ ডিসেম্বর এর প্রথম পর্বের কাজ শেষ হয় এবং যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। লাইন-৪-এর কাজ ২০২১ সালের শেষের দিকে সম্পন্ন হয় এবং জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। তা ছাড়া, লাইন-৫-এর কাজ নির্মাণাধীন রয়েছে। পাতালরেলের একেকটি লাইনের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের সর্বোচ্চ ভাড়া ৬ ইউয়ান, তবে দূরত্বভেদে ভাড়া কম-বেশি হয়ে থাকে।
নানছাং শহরের মেট্রোরেলে ভাড়া পরিশোধের জন্য রয়েছে স্বয়ংক্রিয় পেমেন্ট সিস্টেম, যা কার্ডের মাধ্যমে করা যায়। তা ছাড়া চায়নিজ পেমেন্ট গেটওয়ে আলি পে অথবা ক্যাশ টাকা দিয়ে টোকেনের মাধ্যমে পরিশোধ করা যায়। চীনের অন্যান্য শহরেও একই ধরনের পেমেন্ট সিস্টেম রয়েছে। কার্ডে একবার রিচার্জ করলে দীর্ঘদিন রিচার্জ করার প্রয়োজন পড়ে না। এই
একই কার্ডে নানছাং শহরে অন্যান্য গণপরিবহন যেমন সিটি বাসের ভাড়াও পরিশোধ করা যায়।
কার্ডের মাধ্যমে ভাড়া পরিশোধের কিছু অতিরিক্ত সুবিধা আছে। যেমন মেট্রোরেলে একই রুটে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের ভাড়া ৬ ইউয়ান, সে ক্ষেত্রে কার্ডের মাধ্যমে পরিশোধ করলে তা হবে ৫.৪০ ইউয়ান, অর্থাৎ ০.৬০ ইউয়ান পরিশোধ করতে হচ্ছে না। কার্ডের মধ্যে আগে থেকে টাকা রিচার্জ করে রাখতে হয় এবং যেকোনো সময়ে তা খরচ করা যায়। সবচেয়ে ভালো লাগার বিষয় হচ্ছে, একবার কার্ড পাঞ্চ করে একটি নির্দিষ্ট ভাড়ায় স্থানভেদে শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাওয়া যায়।
নানছাং শহরে পাতালরেলের এক স্টেশন থেকে আরেক স্টেশনের দূরত্ব তিন থেকে পাঁচ মিনিটের এবং যাত্রার মাঝে স্টেশনে যাত্রী ওঠানামার জন্য এক মিনিটের মতো যাত্রাবিরতি থাকে। তবে যাত্রীর সংখ্যা বেশি হলে কিছুটা দেরি করে ছাড়ে পাতালরেল। যাত্রীদের কখনো তাড়াহুড়ো বা ধাক্কাধাক্কি করে পাতালরেলে উঠতে দেখিনি। প্রতিটি স্টেশন অনেক সাজানো-গোছানো, শীতাতপনিয়ন্ত্রিত এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা চোখে পড়ার মতো। ভোর ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত পাতালরেল যাত্রীদের নিরবচ্ছিন্ন সেবা দিয়ে থাকে।
সবচেয়ে ভালো লাগার ব্যাপার হলো, গত চার বছরে আমি চীনের গণপরিবহনে এক পয়সাও ভাড়া বাড়তে দেখেনি। পরিবহন শ্রমিকদের কাছে এখানের জনগণ জিম্মি নয়।
প্রতিটি স্টেশনে যাত্রীদের বসার জন্য ব্যবস্থা রয়েছে, আছে ডিজিটাল বুথ, যেখানে যাত্রীদের প্রয়োজনীয় খাবার কেনাসহ অন্যান্য সুবিধা রয়েছে। ময়লা ফেলার জন্য রয়েছে আলাদা ডাস্টবিন এবং রয়েছে টয়লেটের ব্যবস্থা। এর পাশাপাশি ভ্রমণসংক্রান্ত সমস্যার সমাধান ও নিরাপত্তার জন্য প্রতি স্টেশনে নির্দিষ্ট রেলকর্মী এবং আলাদা নিরাপত্তাকর্মী রয়েছে। স্টেশনগুলোতে সিঁড়ি এবং এস্কেলেটরের পাশাপাশি বয়স্ক ও প্রতিবন্ধীদের ওঠানামার জন্য লিফটের ব্যবস্থা রয়েছে। ট্রেনের প্রতি বগিতে ডিজিটাল স্ক্রিনে স্টেশনের নাম দেখানো হয়ে থাকে এবং স্পিকারে স্টেশনের নাম জানিয়ে যাত্রীদের নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাতে সহায়তা করা হয়।
ব্রিটেনে মেট্রোরেল চালু হয়েছে ১৮৬৩ সালে আর ভারতে মেট্রোরেল চালু হয় ১৯৮৪ সালে। অন্যদিকে, বাংলাদেশে দেরি করে হলেও অবশেষে অপেক্ষার প্রহর শেষ হয়েছে। ২০২২ সালে এসে মেট্রোরেল চালুর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের গণপরিবহনে নতুন যুগের সূচনা হয়েছে। ২৮ ডিসেম্বর মেট্রোরেলের যুগে প্রবেশ করল বাংলাদেশ। রাষ্ট্র আমাদের উন্নত দেশের সুবিধা যেমন—মেট্রোরেল, পদ্মা সেতু, স্যাটেলাইট, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, সাবমেরিন, এক্সপ্রেসওয়ে, ফ্লাইওভার দিল, কিন্তু আমরা কতটা স্মার্ট হতে পারলাম?
পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর সেতুর নাটবল্টু ও টিকটক-কাণ্ড কারও অজানা নয়। যদিও চীনে টিকটক বিলিয়ন ডলার ব্যবসায়িক প্ল্যাটফর্ম। খবরে দেখলাম, মেট্রোরেলে প্রবেশের মূল গেট বন্ধ করে দেওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে বাইরে অপেক্ষায় থাকা যাত্রীরা এ সময় মূল গেটে ধাক্কাধাক্কি করেন, কেউ কেউ আবার গেট টপকে স্টেশনের ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করেন। দেশের জাতীয় সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব শুধু সরকারের নয়, দেশের নাগরিকদেরও। সবার মধ্যে এই উপলব্ধিও থাকা উচিত।
পরিশেষে এই প্রত্যাশা করি, দেরিতে হলেও বাংলাদেশে মেট্রোরেল চালু হয়েছে, যার ফলে রাজধানীবাসীর সময় বাঁচবে ও জনদুর্ভোগ কমবে। মুক্ত হবে প্রাণের রাজধানীতে সব ধরনের যানজট, পরিবহনব্যবস্থা হবে নিয়ন্ত্রিত, উন্নত থেকে উন্নততর, হবে উন্নত রাষ্ট্রের গণপরিবহন ব্যবস্থার মতো নির্ভার। নির্মল হোক রাজধানীর আলো-বাতাস।
লেখক: ডক্টরাল ফেলো, চিয়াংশি ইউনিভার্সিটি এবং চীনে বসবাসরত বাংলাদেশি সাংবাদিক