হোম > ছাপা সংস্করণ

মন্ত্রিসভায় পরিবর্তন এখন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে

ড. মইনুল ইসলাম

পুঁজি পাচারকে বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের প্রধান অগ্রাধিকারে নিয়ে আসতেই হবে। সরকারকে মেনে নিতেই হবে যে পুঁজি পাচার বর্তমান পর্যায়ে দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যায় পরিণত হয়েছে। অর্থমন্ত্রী কি আদৌ তা করছেন?

সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় খবর বেরিয়েছে যে শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভার চারজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে প্রবল সমালোচনার ঝড় উঠেছে। এই চারজন হলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন এবং জ্বালানি ও বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। আরও কয়েকজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর পারফরম্যান্সও প্রশ্নবোধক।

তাঁদের নাম উল্লেখ না করেও বলা যায়, অবিলম্বে মন্ত্রিসভায় পরিবর্তন আনা এখন প্রধানমন্ত্রীর জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। বর্তমানে দেশের অর্থনীতি বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে।

নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতির তাণ্ডব সাধারণ জনগণের জীবনকে বিপর্যস্ত করছে। বৈশ্বিক সংকটের সঙ্গে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের কারও কারও গাফিলতি ও অদক্ষতার কারণে অর্থনীতির বেহাল অবস্থা হয়েছে। ২০২১ সালের আগস্ট থেকে আমদানি এলসি খোলা জোরেশোরে শুরু হলেও অর্থমন্ত্রী তা ধর্তব্যের মধ্যেই আনেননি। আমদানি নিয়ন্ত্রণের কোনো রকম পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

গত ১১ সেপ্টেম্বর সরকারের ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের (সিআইডি) বরাত দিয়ে দেশের পত্রপত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, শুধু হুন্ডি-প্রক্রিয়ায় দেশ থেকে বর্তমানে বছরে ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। এর সঙ্গে আমদানির ওভার ইনভয়েসিং, রপ্তানির আন্ডার ইনভয়েসিং এবং রপ্তানি আয় দেশে ফেরত না আনার মতো মূল সমস্যাগুলো যোগ করলে দেখা যাবে প্রতিবছর কমপক্ষে দেড় লাখ কোটি টাকার সমপরিমাণের বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হচ্ছে। এর মানে বাংলাদেশ থেকে বছরে কমপক্ষে ১৫-১৬ বিলিয়ন ডলার পুঁজি এখন বিদেশে পাচার হয়ে যায়, যার অর্ধেকের মতো পাচার হচ্ছে হুন্ডি-প্রক্রিয়ার বেলাগাম বিস্তারের মাধ্যমে। ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ২০২০-২১ অর্থবছরের ২৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার থেকে ১৫ শতাংশ কমে ২১ দশমিক শূন্য ৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে, যার প্রধান কারণ ওই বছর হুন্ডি-প্রক্রিয়া আবার চাঙা হওয়া। ফলে ২০২১ সালের আগস্ট মাস থেকে শুরু হয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতনের ধারা। রিজার্ভের পতনের ধারাকে আমি ২০২২ সালের এপ্রিলে বিপজ্জনক আখ্যায়িত করায় প্রধানমন্ত্রী আমাকে ইঙ্গিত করে ‘অর্বাচীন’ বলে গালমন্দ করেছিলেন। এখন প্রমাণিত হয়ে গেছে আসলে কারা ‘অর্বাচীন’। ২০২২ সালের অক্টোবরে রিজার্ভ কমে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘোষণা মোতাবেক ৩৫ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছিল। কিন্তু আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ এই ঘোষণা গ্রহণযোগ্য মনে করে না। কারণ, রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল বা এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ড (ইডিএফ) নাম দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে সরকারের আদেশে বাংলাদেশ ব্যাংক যে সাড়ে ৭ বিলিয়ন ডলারের ‘রিফাইন্যান্সিং স্কিমের’ অধীনে বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে দেশের প্রভাবশালী রপ্তানিকারকদের বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ দিয়েছে, সেটাকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে অন্তর্ভুক্ত না করতে বলেছে আইএমএফ। সাম্প্রতিক সফরকালে আরও কয়েকটি ব্যাপারে আইএমএফের পক্ষ থেকে আপত্তি জানিয়েছে বিশেষজ্ঞ টিম। তার মানে, বাংলাদেশের প্রকৃত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অক্টোবরের শেষে ২৭ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের পাওনা পরিশোধের পর রিজার্ভ ২৬ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসবে। এ রকম পতনের ধারা বিপজ্জনক।

আমি দৃঢ়ভাবে বলছি, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন যে টালমাটাল অবস্থার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে, এর জন্য প্রধানত দায়ী পুঁজি পাচার-প্রক্রিয়া। তাই পুঁজি পাচারকে বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের প্রধান অগ্রাধিকারে নিয়ে আসতেই হবে। সরকারকে মেনে নিতেই হবে যে পুঁজি পাচার বর্তমান পর্যায়ে দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যায় পরিণত হয়েছে। অর্থমন্ত্রী কি আদৌ তা করছেন?

এবারের বাজেটে পাচার করা অর্থ দেশে ফেরত আনতে চাইলে মাত্র সাড়ে ৭ শতাংশ কর দিয়ে বিনা প্রশ্নে তা গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। কিন্তু খবর নিয়ে জানা যাচ্ছে, গত চার মাসে কেউ এই সুবিধা নেয়নি। (বর্তমান বাজেটে অর্থমন্ত্রী পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার জন্য যে ‘টোটকা দাওয়াই’-এর প্রস্তাব করেছেন, সেগুলোকে আমি দেশের জনগণের সঙ্গে ‘মশকরা’ আখ্যায়িত করেছি। আমি বলেছি, তিনি পুরো ব্যাপারটাকে লঘু করার জন্য এই প্রহসনমূলক পদক্ষেপ নিয়েছেন। বছরের শেষে দেখা যাবে ফলাফল শূন্য)।

সরকার স্বীকার না করলেও ওয়াকিবহাল মহল ঠিকই বুঝতে পেরেছে যে গত এক বছরে বাংলাদেশের মুদ্রা টাকার বৈদেশিক মান প্রায় ২৫ শতাংশ অবচয়নের শিকার হয়েছে। এশিয়ার বর্ধনশীল অর্থনীতিগুলোর তুলনায় এই অবচয়ন সর্বোচ্চ। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতনের ধারাকে থামাতে না পারলে ডলারের কার্ব মার্কেটের দামের উল্লম্ফন এবং টাকার বৈদেশিক মানের এই দ্রুত অবচয়নকে থামানো যাবে না। আর এ জন্য প্রয়োজন পুঁজি পাচারের বিরুদ্ধে সরকারের বিশ্বাসযোগ্য কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলা। সময় থাকতে কঠোরভাবে পুঁজি পাচার দমন করতে হবে। এমনকি প্রয়োজন মনে করলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীসহ নেতৃত্ব পরিবর্তনেও দ্বিধা করা চলবে না।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বর্তমান অর্থমন্ত্রীকে ‘অ্যাবসেন্ট ফিন্যান্স মিনিস্টার’ আখ্যায়িত করেছেন। এবারই প্রথম বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক সভায় যোগ দেননি। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের নেতৃত্বে কয়েকজন আমলা দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। দেশের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পরিষদ একনেকে অর্থমন্ত্রী প্রায়ই উপস্থিত থাকেন না। অর্থনীতির বর্তমান সংকট সম্পর্কেও অর্থমন্ত্রী তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য বা কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছেন না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী দ্বিধায় ভুগছেন তাঁর অর্থমন্ত্রীকে নিয়ে! দেশের জনগণের মধ্যে একটা সাধারণ ধারণা গড়ে উঠেছে যে বর্তমান অর্থমন্ত্রী চলমান অর্থনৈতিক বিপর্যয় মোকাবিলা করার জন্য যথেষ্ট দক্ষ নন। অতএব, অবিলম্বে অর্থ মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বের পরিবর্তনে কালক্ষেপণ সংকটকে শুধুই দীর্ঘায়িত করবে।

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিকেও বাজারের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা গড়ে তোলার ব্যাপারে অদক্ষ আখ্যায়িত করা হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। একসময়ের বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বাজার ব্যবস্থাপনায় অনেক বেশি সফলতা দেখাতে সক্ষম হয়েছিলেন, তাঁর তুলনায় টিপু মুনশির পারফরম্যান্স একেবারেই অনুজ্জ্বল বলা চলে; বিশেষ করে সরকারের প্রতিযোগিতা কমিশনকে সঠিকভাবে ব্যবহারে টিপু মুনশির ব্যর্থতাকে অক্ষম্য বললে ভুল হবে না। একেক সময় ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট একেক আইটেমকে টার্গেট করে পরিকল্পিত যোগসাজশের মাধ্যমে যেভাবে মুনাফাবাজিতে মেতে উঠছে, মন্ত্রী এহেন যোগসাজশকে কঠোরভাবে দমন করতে বারবার ব্যর্থ হচ্ছেন। তবে এটাও স্বীকার করতে হবে যে সার্বিকভাবে অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি গেড়ে বসেছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে, ডলারের বৈদেশিক মানের বেলাগাম বৃদ্ধি এবং টাকার বৈদেশিক মানের দ্রুত অবচয়নের অভিঘাতে। এ ক্ষেত্রে সরকারের নীতিনির্ধারকদের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত ছিল অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট যেন এই বৈশ্বিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন আমদানি করা পণ্যের বাজারকে ম্যানিপুলেট করতে না পারে, সে ব্যাপারে কঠোরভাবে সজাগ থাকা এবং সার্বক্ষণিক মনিটরিং জোরদার রাখা। বাণিজ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে চলেছে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন মাঝে মাঝে বেফাঁস মন্তব্য করে বিপদে পড়েন, ক্ষমতাসীন মহলকেও বিব্রত করেন। সম্প্রতি ভারতের প্রতি শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখার অনুরোধ জানিয়ে তিনি কূটনীতির নিয়মকানুন লঙ্ঘন করেছেন। শেখ হাসিনা যে এই মন্তব্যের জন্য তাঁর ওপর রুষ্ট হয়েছেন, সেটা বোঝা গেছে তাঁর ভারত সফরের টিম থেকে ড. মোমেনকে বাদ দেওয়ার ঘটনায়। ড. মোমেন ভবিষ্যতে আরও সাবধান থাকবেন, আশা করি। জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদও তাঁর কার্যকলাপ ও উচ্চারণে প্রায়ই প্রতিমন্ত্রীসুলভ আচরণের সীমা লঙ্ঘন করে থাকেন।

যেহেতু জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রীর পদমর্যাদায় ড. তৌফিক-ই-এলাহী প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা হিসেবে কর্মরত রয়েছেন, তাই মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারণী বক্তব্যগুলো তাঁর কাছ থেকেই আসার কথা।

(সম্প্রতি তিনিও দিনে বিদ্যুৎ বন্ধ রাখার কথা বলে সবার কাছে হাস্যাস্পদ হয়েছেন)! ওই মন্ত্রণালয়টির দায়িত্বভার যেহেতু প্রধানমন্ত্রী নিজের হাতে রেখেছেন, তাই প্রকৃত নীতিনির্ধারণের ক্ষমতাও তাঁর ওপর ন্যস্ত রয়েছে বোঝা যায়। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে দেশে যে তীব্র বিদ্যুৎ ও প্রাথমিক জ্বালানির সংকট শুরু হয়েছে, তার জন্য আমদানি করা এলএনজিনির্ভর সরকারের ভুল নীতিকেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। সব মিলিয়ে বলা যায়, নসরুল হামিদ জ্বালানি, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের মতো টেকনিক্যাল বিষয়াদি নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী একটি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা রাখেন না। চলমান সংকট সফলভাবে মোকাবিলার জন্য এই দায়িত্বে টেকনিক্যাল ব্যাকগ্রাউন্ডের কাউকে মন্ত্রী কিংবা প্রতিমন্ত্রী নিয়োগ করাই সমীচীন মনে করি।

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ