হোম > ছাপা সংস্করণ

বিশ্বকাপ ফুটবল ও রাজনীতি

জাহীদ রেজা নূর

ফুটবল নিয়ে এখন সারা বিশ্ব উত্তাল। এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। প্রতি চার বছরে পৃথিবীর মানুষ এ রকম এক উত্তেজনায় ভুগতে থাকে। চিরাচরিতভাবে ফুটবলপ্রেমীদের মধ্যে নিজ দলের প্রতি শতভাগ অন্ধ যারা, তারা একে অন্যের ওপর চড়াও হয়। কেউ ফেসবুকে, কেউ রাস্তাঘাটে নিজের সমর্থন করা দলের জন্য জীবন বাজি রাখে। কখনো কখনো একে অন্যের প্রতি চড়াও হয়ে খুনোখুনির ঘটনাও ঘটিয়ে দেয়।

আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল ছাড়িয়ে ফুটবল এখন অন্য অনেক দিকে এগিয়ে গেছে। ক্লাব ফুটবলের কল্যাণে ইউরোপীয় ফুটবল হয়ে উঠেছে গুরুত্বপূর্ণ। ফ্রান্স, জার্মানি, ইংল্যান্ড, স্পেন, ইতালি (যদিও এবার বিশ্বকাপ আসরে ইতালি আসতে পারেনি) চোখে পড়ার মতো ফুটবল খেলছে বহুদিন ধরে। যে এশিয়াকে বলা হতো, ইউরোপীয় নিকৃষ্ট দলের চেয়েও এরা খারাপ খেলে, সেই এশিয়ার ফুটবল দলগুলো ভেলকি দেখাচ্ছে। এবার সৌদি আরব, ইরান আর জাপান সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। এর আগেও দক্ষিণ কোরিয়া ফুটবলপ্রেমীদের মন কেড়ে নিয়েছিল। একইভাবে আফ্রিকান ফুটবলও সমীহ আদায় করে নিয়েছে; বিশেষ করে ঘানা আর ক্যামেরুনের কথা বেশ কয়েক আসরজুড়েই আলোচনায় আছে। ফলে আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিলের মোহে অন্ধ হয়ে থাকার কোনো কারণ নেই। এই দুই দেশের একচেটিয়া রাজত্বের অবসান হয়েছে।

কিন্তু তাতে এখন পর্যন্ত তাদের সমর্থকগোষ্ঠীর মধ্যে খুব একটা ভাঙন ধরেনি। আমাদের দেশে হঠাৎ করে জার্মানি, স্পেন কিংবা ফ্রান্সের কিছুসংখ্যক সমর্থক চোখে পড়ে যদিও, কিন্তু আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের প্রবল চাপে তারা খুব একটা সুবিধা করে উঠতে পারে না। একসময় আমাদের দেশে লিগ ফুটবলে আবাহনী-মোহামেডানের সমর্থকদের মধ্যে যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ত, বিশ্বকাপ ফুটবলে এখনো সে জায়গাটি ধরে রাখতে পেরেছে আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিল। এই দুই দলের একটি যদি ফাইনালে না ওঠে, তাহলে বিশ্বকাপ ফুটবলের উত্তেজনা শেষ হয়ে যায় অনেক আগেই। বিশ্বকাপজুড়ে যে বাণিজ্য, তাতেও ভাটা পড়ে।

দুই. আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিল নিয়ে অবশ্য এই লেখা নয়। কাতার বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার আগে থেকেই ইউরোপীয় দেশগুলো থেকে বিশ্বকাপ বয়কটের যে প্রচারণা শুরু হয়েছিল, তা নিয়েই কথা হবে। কোনো খেলাই যে রাজনীতির বাইরে নয়, সে বিষয়েই কিছু বলা।অনেকেরই মনে পড়ে যাবে, কাতারে বিশ্বকাপের অবকাঠামো গড়তে গিয়ে নানা ধরনের নৃশংসতা ঘটানো হয়েছে বলে হঠাৎ করেই পশ্চিমা মিডিয়ায় খবর প্রকাশিত হতে থাকল। যুক্তরাজ্যের নির্ভরযোগ্য পত্রিকা গার্ডিয়ানে এ-সংক্রান্ত একটি সংবাদ প্রচার হওয়ার পর আমাদের দেশের ফেসবুক ব্যবহারকারীদের অনেকেই দিতে থাকলেন কাতার-বিশ্বকাপকে ধিক্কার জানানো পোস্ট। হাজার হাজার শ্রমিক কাতারে বিশ্বকাপের অবকাঠামো গড়তে গিয়ে নিহত কিংবা পঙ্গু হয়েছেন, এ রকম সংবাদের কোনো ভিত্তি আছে কি না, সে আলোচনায় না গিয়ে অনেকেই বলতে লাগলেন, এবার ফুটবল বিশ্বকাপ দেখবেন না। বিশ্বকাপ দেখলে কাতারে কাজ করতে আসা ভিনদেশি গরিবের রক্তের সঙ্গে তা হবে বেইমানি। এই আলোচনার সারবস্তু আছে কি নেই, তা একটু তলিয়ে দেখা উচিত।

তিন. এখন কেউ যদি বলে, কাতার বিশ্বকাপবিরোধী যে প্রচারণা চলছে, তার সঙ্গে কাতারের গ্যাস আর রাশিয়ার সঙ্গে তাদের ভালো বোঝাপড়ার একটা সম্পর্ক আছে, তাহলে অনেকেই সেই বক্তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। বলবে, রাশিয়ার চালানো প্রচারণায় শামিল হয়েছেন তিনি। কিন্তু যদি ঘটনা খতিয়ে দেখা যায়, তাহলে সে রকম কোনো সন্দেহকে অমূলক না-ও মনে হতে পারে। এই আলোচনার আগে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে আসা খবরগুলোর দিকে চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক। কাতারের বিরুদ্ধে একটি বড় অভিযোগ হলো, যা আগেও উল্লেখ করেছি—ভিনদেশি শ্রমিকদের অনেকেই কাতার বিশ্বকাপের অবকাঠামো গড়তে গিয়ে প্রাণ দিয়েছেন। (এই অভিযোগের কোনো ভিত্তি আছে কি না, সে ব্যাপারে কেউ কিছু বলছে না।) নারীর অধিকার রক্ষায় কাতার ব্যর্থ, এলজিবিটি সম্প্রদায় নিয়ে কাতারের বাজে অবস্থান, গণতন্ত্রহীনতা, স্টেডিয়ামে বড় বড় এয়ারকন্ডিশনার লাগিয়ে পরিবেশদূষণ করা—এগুলোও রয়েছে অভিযোগের মধ্যে।

এসব অভিযোগের অনেকগুলোই ভয়াবহ এবং সেই অভিযোগের ভিত্তিও আছে; বিশেষ করে আরব বিশ্ব নারীদের কোন চোখে দেখে, গণতন্ত্রের সঙ্গে তাদের বোঝাপড়া কী রকম, সে ব্যাপারে নতুন করে কিছু বলার নেই। ইরানে মাহসা আমিনির হত্যাকাণ্ড চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, মধ্যপ্রাচ্য নারীদের সম-অধিকারে বিশ্বাসী নয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে পরিবর্তন করা কিংবা সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আরব দেশগুলোর মধ্যে অনীহা রয়েছে। ফলে এলজিবিটি-বিষয়ক প্রশ্নটির হাল কী হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়।

কিন্তু সে কারণে একেবারে বিশ্বকাপ বয়কট! যদি সত্যিই এ প্রশ্নগুলো পশ্চিমা বিশ্বের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ হতো, তাহলে তা নিয়ে তো তারা চাপ দিতে পারত বহু আগেই। হঠাৎ করে ‘ও ছুড়ি তোর বিহা লাইগাছে’ বলে তো কাতারে বিশ্বকাপ শুরু হয়নি। এর জন্য প্রস্তুতি ছিল।ফিফা ঠিক করেছে কোন বছর কোন দেশে বিশ্বকাপ হবে। রাশিয়া বিশ্বকাপের পরবর্তী বিশ্বকাপ যুক্তরাষ্ট্রে হওয়ার একটা সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল, সেটা কীভাবে কাতারের দিকে এল, সে কথা আলোচনা করতে গেলে আসে একসময়ের দারুণ খেলোয়াড় মিশেল প্লাতিনির নাম। আসে ফ্রান্সের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সারকোজির নাম, কাতারে ফ্রান্সের যুদ্ধবিমান বিক্রির কথা। সে আলোচনা এখানে নয়।

চার. আরও একটি অভিযোগ আছে কাতারের বিরুদ্ধে। কাতার নাকি ফিফার ডেলিগেটদের ভোট কিনেছিল পয়সার বিনিময়ে। বিশ্বকাপ শুরুর আগে জার্মানি, স্পেন ও ফ্রান্সে কাতার বিশ্বকাপ বয়কটের প্রচারণা চলেছে বেশ গুরুত্ব দিয়েই। এ দেশগুলোর অনেক শহরের মানুষই প্রতিজ্ঞা করেছে, এবার বিশ্বকাপ দেখবে না তারা। পাবে, বিয়ার শপে জায়গা হবে না বড় স্ক্রিনের।

কাতার বলছে পশ্চিমা দেশগুলোর ডাবল স্ট্যান্ডার্ডের কথা। বিশ্বকাপ বয়কটের ডাক দেওয়ার পাশাপাশি কাতারের গ্যাস কেনার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে পশ্চিমা দেশগুলো। যে দেশকে নানা অভিযোগে বয়কট করা হচ্ছে, তাদের কাছ থেকেই গ্যাস কেনার আবদারকে আর কী বলা যেতে পারে? বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়াকে একঘরে করে দিয়ে ইউরোপ এখন তেল ও গ্যাসের সংকটে পড়েছে। তাই তারা কাতারের গ্যাসের মুখাপেক্ষী হয়েছে। কিন্তু কাতারের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক ভালো থাকায় পশ্চিমা দেশগুলো চটেছে কাতারের ওপর। এ কথা অনেকেই জানেন, গ্যাস রপ্তানিতে কাতার অন্যতম একটি নাম। ইউরোপের প্রায় এক-চতুর্থাংশ গ্যাস এ দেশ থেকেই রপ্তানি করা হয়।

ফ্রাঙ্কফুর্টার আলজেমেইন জেইটুং পত্রিকায় একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ মুহাম্মদ আবদুলরহমান আল তানি।তিনি কী বলছেন, সেটা জেনে নেওয়া যেতে পারে। ‘১২ বছর আগে যখন ফিফা সিদ্ধান্ত নেয় যে ২০২২ সালের বিশ্বকাপ হবে কাতারে, তখন থেকেই কাতারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশ প্রচারণা চালানো শুরু করেছিল। পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো থেকেই এই প্রচারণা চালানো হয়েছিল, যদিও দেশগুলো নিজেদের উদারপন্থী গণতন্ত্রী বলে দাবি করে থাকে। এর মধ্যে বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়।’

পাঁচ. পশ্চিমা সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে কাতারের গণমাধ্যম। তারা বলছে, পশ্চিমা সাংবাদিকেরা যা বলছেন, তার সবই রটনা।বাস্তবের সঙ্গে তার কোনো মিল নেই। ফরাসি পত্রিকা লা মঁদকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ মুহাম্মদ বিন আবদুলরহমান আল তানি বলেছেন, ‘পৃথিবীর মানুষ অধীর আগ্রহে বিশ্বকাপের জন্য অপেক্ষা করছে, যারা আমাদের “আঘাত” করছে, তারা সংখ্যায় একেবারে অল্প। সংস্কারকাজের জন্য সময় দরকার হয়, সেটা শুধু কাতার কেন, যেকোনো দেশের জন্যই হয়। আমাদেরও রয়েছে দুর্বলতা, আমরা চেষ্টা করছি সেগুলো ঠিকঠাক করতে।’

কাতারের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন ফিফার প্রেসিডেন্ট জিয়ান্নি ইনফানতিনো। তিনি কাতার বিশ্বকাপের সমালোচকদের বলেছেন, ‘তাঁরা মানবাধিকার লঙ্ঘন করছেন, তাঁরা মিথ্যা বলছেন এবং তাঁরা বর্ণবাদী আচরণ করছেন। পশ্চিমা দেশগুলো যদি কাতারকে নৈতিক শিক্ষা দিতে চায়, তাহলে তাদের নিজেদের বর্তমান ও অতীতের ইতিহাসের দিকে তাকানো দরকার। আমরা ইউরোপীয়রা ৩০০০ বছরে যা যা করেছি, তার জন্য সামনের ৩০০০ বছর আমাদের ক্ষমা চেয়ে যেতে হবে এবং এরপর অন্যকে নৈতিক শিক্ষা দেওয়ার কথা ভাবা যাবে।’

দীর্ঘ সময় ধরেই কাতার ছিল পশ্চিমাদের বন্ধু। আরব দেশগুলো আধুনিকায়ন করার জন্য কাতারের তারিফ করা হতো। কাতারের দোহায় অবস্থিত টেলিচ্যানেল আল জাজিরা ‘আরব বসন্ত’ প্রচারে পশ্চিমাদের পথটাই বেছে নিয়েছিল। লিবিয়ায় গাদ্দাফির পতনে কাতার রেখেছে বড় ভূমিকা। সে সময় কাতার ছিল পশ্চিমাদের বন্ধু। তারা শত্রুতে কেন পরিণত হলো, সেটা বুঝতে হলে বুঝতে হবে গ্যাসের রাজনীতি।

এখন কাতারে মানবাধিকার খুব দরকারি হয়ে উঠেছে। বন্ধুত্বের সেই সময়টায় কিন্তু তা খুব দরকারি ছিল না। সৌদি আরব আর কাতারের দীর্ঘদিনের বিরোধের প্রসঙ্গটি এখানে আর আনা হলো না। গ্যাসের মূল্য নির্ধারণ এবং রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ততার কারণে পশ্চিমা বিশ্ব খেপে আছে কাতারের ওপর। তাই সহজেই বলা যায়, কাতারে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে কি হচ্ছে না, সেটা ইউরোপের জন্য মূল প্রশ্ন নয়। সেটা যদি মূল প্রশ্ন হতো, তাহলে বন্ধুত্বের সময়টাকেও মানবাধিকার, নারীর অধিকারসহ গণতন্ত্রহীনতা প্রশ্নে তারা চাপ দিতে পারত।

ছয়. মানবাধিকার যেখানেই লঙ্ঘন হোক, তার বিরুদ্ধেই সোচ্চার হতে হবে। কাতারকে যদি অভিযুক্ত করা হয়, তাহলে সেটাও আনতে হবে বিবেচনায়। কিন্তু তার সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্ব মানবাধিকার রক্ষা করে চলছে কি না, সেটা নিয়েও তো ভাবতে হবে। বেশি কথা নয়, ‘গুয়ানতানামো বে’তে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে, তার কি বিচার হয়েছে? পশ্চিমাদের মিত্র থাকা অবস্থায় সাত খুন মাফ, আর শত্রু হলেই তার শাস্তি দাবি—এ বড় নির্মমতা।

খেলাধুলাকেও যখন রাজনীতি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে চাওয়া হয়, তখন বোঝা যায়, পৃথিবীর ‘গভীর অসুখ’ হয়েছে। সুচিকিৎসার সুযোগ আছে কি না, তা আপাতত জানা নেই।

লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ