হোম > ছাপা সংস্করণ

স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা জরুরি

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী

এমনিতেই দুই বছর করোনার অতিমারিতে বিশ্ব অর্থনীতি বেশ নাজুক। এর ওপর গত ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে নানান নিষেধাজ্ঞা ও অবরোধ বিশ্ববাণিজ্য এবং অর্থনীতিতে নতুন করে ধাক্কা দিতে শুরু করেছে। ফলে গোটা বিশ্বের অর্থনীতি বেসামাল হয়ে পড়ার লক্ষণ তৈরি হয়েছে। অনেক দেশই আমদানি-রপ্তানি স্বাভাবিকভাবে করতে পারছে না। ফলে পণ্যসামগ্রী উৎপাদন, সরবরাহ, আমদানি-রপ্তানি ঝুঁকির মধ্যে পড়তে যাচ্ছে। গ্যাস, বিদ্যুৎ, ভোজ্যতেল, আটা, ময়দা, কাঁচামাল, খনিজ পদার্থ আমদানি-রপ্তানিতে বড় ধরনের বাধার সৃষ্টি হয়েছে। এতে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, গ্যাস, ভোজ্যতেল, আটা-ময়দার অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে। এর নেতিবাচক প্রভাব সব দেশেই কমবেশি পড়েছে। আমাদের দেশে কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই ভোজ্যতেল, চাল, ডাল, চিনি, খাদ্যদ্রব্য, কৃষিজ পণ্যর অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে। স্বল্প আয়ের মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না। এরই মধ্যে বাজারে ভোজ্যতেলের সরবরাহ-সংকট ঘটায় নিম্ন আয়ের মানুষ আরও বিপাকে। বাজারে তেল নিয়ে একধরনের তেলেসমাতি চলতে দেখা যাচ্ছে। সরকারের বিভিন্ন সংস্থা কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে মিলারদের তেল সরবরাহে অনিয়ম, মজুত এবং নানা ধরনের অজুহাতের কারণ খুঁজে পেয়েছে। এ ছাড়া ডিলারসহ সরবরাহ চেইনে নানা মধ্যস্বত্বভোগী তেল সরবরাহে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখছে বলেও অনুসন্ধান থেকে জানা গেছে।

শুধু তেলের মূল্যবৃদ্ধিই নয়— চাল, ডাল, চিনি, আটা, ময়দা, পেঁয়াজ ইত্যাদি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীরও দামও লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা গেছে। কদিন পর পবিত্র রমজান মাস। সে উপলক্ষে ছোলা, খেজুরসহ নানা ধরনের ইফতারের পণ্যসামগ্রীও এ সময় কেনাকাটা করতে হচ্ছে। কিন্তু বাজারে একদিকে কৃত্রিম সংকট, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের দোহাই দিয়ে দেশীয় বাজারে সব জিনিসের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফলে প্রান্তিক এবং সীমিত আয়ের মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী কেনাকাটায় বড় ধরনের অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। বিস্ময়কর হচ্ছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। দোকানভেদে মূল্যের পার্থক্য দেখা যাচ্ছে। গ্রাম এবং শহরের কোথাও কোনো পণ্যের মূল্য এক নয়। এমনকি কাছাকাছিও নয়। এর ফলে স্বল্প আয়ের মানুষকে অতীব প্রয়োজনীয় চাল, ডাল, তেল, আটা, শাকসবজি কেনাকাটার জন্য এক দোকান থেকে অন্য দোকানে, এক বাজার থেকে অন্য বাজারে ছোটাছুটি করতে হচ্ছে। এর ফলে কেনাকাটা এবং রোজগারের মধ্যে বড় ধরনের ব্যত্যয় ঘটছে। বাজার পরিস্থিতি যেভাবে অস্বাভাবিক হয়ে উঠেছে, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে বেশির ভাগ পণ্য নিম্ন আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে চলে যেতে পারে। সুতরাং সরকারকে নিম্ন আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য এবং গৃহস্থালির প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ক্রয় করার বিশেষ ব্যবস্থা সৃষ্টির উদ্যোগ নেওয়া একান্ত প্রয়োজন।

ভোজ্যতেলের বিষয়টি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে স্পষ্ট করা হয়েছে যে আগামী দুই-তিন মাস সরবরাহে কোনো ধরনের ঘাটতি থাকার কারণ নেই। কেননা, বিদেশ থেকে আমদানি করা তেল এবং কাঁচামাল বেশ আগেই দেশে এসে পৌঁছেছে। তারপরও ওই সব ব্যবসার সঙ্গে জড়িত অনেকেই সরবরাহের ঘাটতি, পরিবহনে চাঁদাবাজি ও ব্যয় বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণ দেখিয়ে প্রথমে তেলের মূল্যবৃদ্ধি দাবি করেন। বাণিজ্যমন্ত্রী তাতে সম্মতি প্রদান না করলে বাজারে ভোজ্যতেলের সরবরাহ অনেকটাই কমিয়ে দেওয়া হয়, তেলের কৃত্রিম সংকট দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। এরপর সরকার বিভিন্ন জায়গায় তদারকি করতে গিয়ে কয়েকটি আড়তে তেলের মজুত দেখতে পায়। বোঝাই যাচ্ছিল, তেল নিয়ে তেল ব্যবসায়ীরা নানা ধরনের তেলেসমাতিতে যুক্ত। এরপর মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠকে এফবিসিসিআইয়ের কর্মকর্তাসহ ব্যবসায়ীরা ভ্যাট প্রত্যাহার ও সরকারের বাজার নিয়ন্ত্রণ অভিযান বন্ধ রাখার দাবি জানান। বোঝাই যাচ্ছে, তেল ব্যবসায়ীরা ভ্যাট সম্পূর্ণরূপে মওকুফ এবং বাজার তদারকি বন্ধ চাচ্ছিলেন। প্রশ্ন হচ্ছে, ভ্যাট সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহার করলে তেলের বাজার সুবিধামূল্য কি সমহারে ভোক্তারা পাবেন? কেউ নিশ্চিত করে এটা বলতে পারছেন না। তাহলে সুবিধাটি কারা পাবেন? নিশ্চয় ব্যবসায়ীরা। তাহলে তেলা মাথায় আরও বেশি তেল পড়তে যাচ্ছে। এতে রাষ্ট্র হারাবে রাজস্ব আয়, ভোক্তা হারাবে ন্যায্যমূল্যে তেল ক্রয় করার সুবিধা।

এ প্রসঙ্গে যে কথাটি বলা যেতে পারে, তা হলো তেলের আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য বেশি বৃদ্ধি পেলে সরকার ভ্যাটের পরিমাণ সামান্য নির্ধারণ করতে পারে। তাতে অন্তত সরকারের ঘরে কিছুটা হলেও রাজস্ব জমা হতে পারে। সম্পূর্ণরূপে মওকুফ করে দিলে আমদানিকারকেরা এককভাবে লাভবান হবেন এটি নিশ্চিত, কিন্তু ভোক্তারা সুফল পাবেন—এমন কোনো নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারছে না। তবে এখন পর্যন্ত দেশের অভ্যন্তরে যেসব ভোজ্যতেল এবং তৈলবীজ মিলারদের কাছে রয়েছে, সেগুলোর দাম অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধির কোনো যুক্তিসংগত কারণ থাকার কথা নয়। দেশের অভ্যন্তরে এখনই যা আছে তার ওপরও ভ্যাট প্রত্যাহারের সুযোগ ব্যবসায়ীরা চাইছেন। এটি খুবই দৃষ্টিকটু মনে হয়েছে। এখন থেকে যেসব তেল এবং তৈলবীজ আমদানি হবে, সেসব পণ্যই কেবল ভ্যাটের পুনর্নির্ধারিত মূল্যে দেশে প্রবেশ করতে পারে। এরপরও আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি কত দিন অব্যাহত থাকবে, সেটির ওপরও সরকারের নজরদারি থাকা দরকার। তাতে যদি ভ্যাট নতুন করে মওকুফ করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়, তাহলে সরকারকে পরিস্থিতি বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, তৈলবীজ আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বর্তমানে পাঁচটি থাকায় দেশে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টিতে এদের কারও না কারও ভূমিকা থাকতে পারে। সরকারের উচিত প্রকৃত ম্যানিপুলেটকারীকে চিহ্নিত করার মাধ্যমে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া, একই সঙ্গে তেল ও তৈলবীজ আমদানিকারকদের সংখ্যা ব্যাপক পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়ে একচেটিয়া কারবারি সিন্ডিকেট ব্যবস্থাকে ভেঙে দেওয়া। অন্যান্য পণ্যসামগ্রীর আমদানিকারকদের ব্যাপারেও একই নীতি অনুসরণ করা প্রয়োজন। তাহলেই বাংলাদেশের বাজারব্যবস্থায় কতিপয় গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ভেঙে যেতে বাধ্য হবে। দেশে ধানের উৎপাদন যথেষ্ট হওয়া সত্ত্বেও চালের উচ্চমূল্যের বাজার ধরে রাখার পেছনে নতুন নতুন করপোরেট ব্যবসায়ীর যুক্ত হওয়ার বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেছে। করপোরেট ব্যবসায়ীরা ধান মজুত করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছেন। চাল আমদানির ক্ষেত্রেও তাদের নিয়ন্ত্রণ একচ্ছত্র হওয়ায় বাজারে সরবরাহ সৃষ্টিতে ধীরগতি দেখা যাচ্ছে। এসব প্রবণতা থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য সরবরাহে সরকারকে বিকল্প ব্যবস্থা সৃষ্টি করতেই হবে। নতুবা বাজারে ভারসাম্য তৈরি করা সরকারের পক্ষে মোটেও সম্ভব হবে না। আমাদের বৃহৎ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর মধ্যে অনেকেই দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারকে অস্থিতিশীল করতে মোটেও দ্বিধা করেন না। তাঁদের সঙ্গে ডিলার, সরবরাহকারী, মধ্যস্বত্বভোগী নানা গোষ্ঠীও কম যায় না।

সুতরাং সরকারকে এ ধরনের ভারসাম্যহীন ব্যবস্থা ভেঙে দেওয়ার ব্যাপারে সব সময়ই নজরদারি রাখতে হবে। বর্তমান সময়ে এখন যে বিষয়টি আরও জরুরি হয়ে পড়েছে, তা হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজারে যেসব পণ্যের দাম এই মুহূর্তে বেশি ওঠানামা করছে সেগুলোর ওপর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সপ্তাহে দু-তিন দিন জনগণকে অবহিত করার জন্য প্রেস ব্রিফিং দিতে পারে এবং একই সঙ্গে কবে নাগাদ সেসব আমদানি করা পণ্যের বাজার ওঠানামা করতে পারে, সেই ধারণাও প্রদান করা বাঞ্ছনীয় হবে। বর্তমানে কোনো পণ্যের আন্তর্জাতিক মূল্য যেদিন বৃদ্ধি পায়, সেদিনই ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশে মূল্য বাড়িয়ে দিতে দেরি করে না। কিন্তু কোনো পণ্যের দাম কমে গেলে সেটির অভ্যন্তরীণ বাজারমূল্য শিগগির কমতে দেখা যায় না।

বর্তমানে টিসিবির উদ্যোগে যেসব পণ্য বিক্ষিপ্ত বিচ্ছিন্নভাবে বিক্রি হচ্ছে, সেগুলোকে যথার্থ অর্থে কার্যকর করতে নিম্ন আয়ের মানুষের তালিকা প্রণয়ন এবং তাদের ক্রয়ের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। যত দিন আন্তর্জাতিক বাজার সহনীয় পর্যায়ে নেমে না আসবে, তত দিন সারা দেশের নিম্ন আয়ের মানুষকে বৈধ পরিচয়পত্র ব্যবহার করে চাল, ডাল, তেল, চিনি, পেঁয়াজ তথা ভোগ্যপণ্য ন্যায্যমূল্যে ক্রয় করার অবস্থা অব্যাহত রাখা জরুরি। অন্যদিকে বাজারব্যবস্থায় সিন্ডিকেট, গুদামজাত এবং অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা রোধ করার ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে মধ্যবিত্তসহ ক্রয়ক্ষমতাসম্পন্ন যেকোনো মানুষ স্বাভাবিক নিয়মে বাজার থেকে পণ্যসামগ্রী ক্রয় করতে পারে। মনে রাখতে হবে, এখন করোনার অভিঘাত এবং যুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক মোড়ল গোষ্ঠীর নানা বাণিজ্য ষড়যন্ত্রের খপ্পরে গোটা পৃথিবী পড়েছে। এর থেকে উত্তরণ ঘটতে কিছুটা সময় লাগবে। কিন্তু দেশের মানুষকে এই সময়ে স্বস্তিতে রাখার কোনো বিকল্প নেই।

লেখক: অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ