শিক্ষার বিষয়টি এখন সম্পূর্ণভাবে একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত; যা শুধু মন্ত্রণালয়ের বিষয় নয়, ব্যাপকভাবে সামাজিক। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ আসার আগে শিক্ষাটি ছিল একটি সামাজিক বিষয়।
সমাজ তার নিজের প্রয়োজনে শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করেছিল।
সম্প্রতি এক রাতে অবসরে যাওয়া শিক্ষা বিভাগের উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা হলো। ছাত্রজীবনে প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, শিক্ষক হিসেবে অত্যন্ত ভালো এবং শেষে শিক্ষা বিভাগের সর্বোচ্চ পদে আসীন হয়ে অবসরে গেছেন। এখনো শরীরে-চোখে-মুখে তারুণ্য আছে এবং সেই সঙ্গে কৌতূহলও আছে। দেখতে দেখতে অবাক হচ্ছিলাম যে অবসরেও তিনি ক্লান্ত হননি। কিন্তু চাকরির ব্যস্ততার ফলে জগতের অনেক কিছুই তাঁর কাছে অচেনা এবং অজানা হয়ে আছে। তাঁর সঙ্গে কথায় কথায় আজকের সামাজিক অস্থিরতার কারণ হিসেবে শিক্ষার ব্যবস্থাকেই আমি দায়ী করছিলাম।
তিনি একমত হলেন। কারণ, তিনি সরকারি ও বেসরকারি কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষকদের খুব কাছ থেকে দেখেছেন। তাঁদের চরিত্রের স্খলন, অশিক্ষা এবং সর্বোপরি শিক্ষকদের অনুপযুক্ততা খুব কাছ থেকে দেখেছেন। প্রচুর রাজনৈতিক চাপ সহ্য করেছেন তিনি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে চাপ অগ্রাহ্য করলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা মেনে নিতে হয়েছে। তাঁর পদটি শিক্ষাক্ষেত্রে ব্রিটিশ প্রবর্তিত ডিপিআইয়ের (ডিরেক্টর অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন) সমান। এ পদটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং যেসব মানুষ এই পদে থাকতেন তাঁরা পরবর্তীকালে হয় মন্ত্রী হতেন, উপদেষ্টা হতেন কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর হতেন। পদটিকে ঘিরে সরকার এমন একটা বর্ম তৈরি করত যে তার কাছে যাওয়াই যেত না। ফলে তাঁর সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হতো।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার অনেক দিন পর্যন্ত এ পদটি গুরুত্ব বহন করে এসেছে। কিন্তু একটা সময় রাজনৈতিক বিবেচনা এত গুরুত্ব পেতে শুরু করল যে পদটি থাকল বটে, কিন্তু তার ক্ষমতা প্রয়োগের বিষয়টি সংকুচিত হতে লাগল। আজ যেমন সব স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান মন্ত্রণালয়ের মুখাপেক্ষী, এ পদটির ক্ষেত্রেও তা-ই হলো। একদিকে কলেজগুলো অতিরিক্ত ছাত্রের চাপে বিধ্বস্ত, অন্যদিকে ছাত্ররাজনীতির প্রবল চাপে অধ্যক্ষরা দিশেহারা। একাডেমিক শৃঙ্খলার বাইরেও কলেজের অধ্যক্ষকে অনেক ধরনের রাজনৈতিক কৌশল নিতে হয়। কিন্তু খোদ পাকিস্তান আমলেও অধ্যক্ষদের অনমনীয়তা, শিক্ষাক্ষেত্রে অবিচল মনোভাবে ছাত্ররা বিক্ষুব্ধ হলেও শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধা একটুও কমেনি। জনান্তিকে ছাত্রনেতাদের বলতে শোনা গেছে, স্যার খুবই কঠিন ন্যায়বাদী।
তিনি আপস করবেন না এবং তাঁকে কিছুতেই অবনত করা যাবে না।
ওই শিক্ষকেরা ব্যক্তিগত জীবনেও ছিলেন অত্যন্ত অনমনীয় স্বভাবের। পরিবারের প্রতিও তাঁদের ছিল একই ধরনের মনোভাব। কোনো ধরনের স্বজনপ্রীতি তাঁদের স্পর্শ করত না। কিন্তু আজকাল অধ্যক্ষ তো দূরের কথা, উপাচার্যরা নিজের ছেলে, মেয়ে, জামাতাকে অন্যায়ভাবে অধ্যাপকের চাকরি দিয়ে থাকেন। হাল আমলের এক ছাত্রনেতা আমার কাছে এসে শিক্ষকদের সম্পর্কে অত্যন্ত কটু মন্তব্য করতে শুরু করলেন। আমি একটা পর্যায়ে তার সঙ্গে আলোচনা শেষ করে দিলাম। সম্প্রতি কাগজে দেখলাম, ভর্তি পরীক্ষায় সিংহভাগের ফি শিক্ষকেরা ভাগাভাগি করে নেন। শুধু তা-ই নয়, একটা বড় কলেজের অধ্যক্ষ বিভিন্ন পরীক্ষার কারণে বছরে লাখ লাখ টাকা আয় করে থাকেন। শিক্ষকেরাও তার একটা ভাগ পেয়ে থাকেন। বিষয়গুলো এখন আর গোপন নেই। ছাত্র, শিক্ষক, ম্যানেজিং কমিটি—সবটা মিলে যতটা না একাডেমিক চর্চা, তার চেয়ে অনেক বেশি অর্থনৈতিক চর্চায় মগ্ন হয়ে গেছে।
সাবেক কর্মকর্তার সঙ্গে আমি আমার ছাত্রজীবনের অনাহারী শিক্ষকদের কথা বলছিলাম, যদিও সেটা কোনো আদর্শব্যবস্থা নয়। শিক্ষা যে তাঁরা একটা ব্রত হিসেবে নিয়েছেন, তার বিপরীতে কিছু দুষ্টলোক এ কথাও বলতেন যে তাঁদের কোনো চাকরি নেই, কাজ নেই, তাই শিক্ষকতা ছাড়া আর কী করবেন! কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিস্টিংশন পাওয়া ছাত্র কী কারণে গ্রামের স্কুলে শিক্ষকতা করেন, এটা বুঝতে তখন খটকা লাগত। ছয় মাইল দূর থেকে সাইকেল চালিয়ে যথাসময়ে স্কুলে উপস্থিত হতেন কেন? ছাত্রদের মারধর করতেন না, অথচ ছাত্ররা ভয়ে কাঁপত। ইংরেজি, বাংলা, ইতিহাস বিষয়গুলো যেসব শিক্ষক পড়াতেন, আজও তাঁদের জ্ঞানের ভান্ডারের কথা মনে হলে অবাক লাগে।
সেই স্কুলগুলোতে পরবর্তীকালে আমাদের বন্ধু, সহপাঠীরা শিক্ষক হয়েছেন, তারপর তাঁদের ছাত্ররা শিক্ষক হয়েছেন এবং ক্রমাগতভাবে শিক্ষার মান কমে যেতে শুরু করেছে। শিক্ষার এই ক্রমাবনতি সবচেয়ে বেশি গ্রাস করেছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। একটা সময়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ চরম বিশৃঙ্খল আকার ধারণ করে। কোনোমতে এসএসসি পাস করে যার কোনো কিছু হয়নি, একটা দোকান দিতে গিয়েও ব্যর্থ হয়েছে, বাবার সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষমতাও নেই, তাকেই এই প্রাইমারি শিক্ষকের চাকরি দেওয়া হতো। শিক্ষায় যেহেতু তারা দুর্বল ছিল, তাই লক্ষ্য ছিল মারধর, বেত তাদের নিত্যসঙ্গী এবং ডাস্টার ছুড়ে মারাও ছিল তাদের একটা অভ্যাস। তাদের নিয়ন্ত্রক সরকারি থানা শিক্ষা অফিসার বা পরিদর্শক তেমনি অসহায় এক ব্যক্তি, যিনি নানা ধরনের স্থানীয় চাপে দিশেহারা। এহেন পরিস্থিতি চলেছে বহু দিন।
একসময় বিএ, এমএ পাস করা ছাত্রছাত্রীরা প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষকের কাজে যোগ দিলেন। কারণ তত দিনে বেতন অনেক বেড়েছে। সেখানেও অভিযোগ—কোথাও চাকরি না পেয়ে তাঁরা শিক্ষকতা পেশায় প্রবেশ করেছেন। কিন্তু এমন অনেক পরিবার দেখেছি, পিতামহ থেকে শুরু করে পিতা-পুত্র এবং পরবর্তী বংশধরেরাও শিক্ষকতাই করে যাচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে যে কেউ প্রশাসনে বা ব্যবসার ক্ষেত্রে উন্নতি করতে পারতেন না, তা নয়। গত পঞ্চাশ বছরে শিক্ষার ক্ষেত্রে জাতীয় লগ্নি, ব্যবস্থাপনা, ছাত্র-শিক্ষকদের অপরাজনীতি ও অপসংস্কৃতির ইতিহাস দেখার প্রয়োজন নেই। আজকের সামাজিক ক্ষেত্রে যে বিশৃঙ্খলা, দুর্নীতি এসবের দিকে তাকালেই তার প্রতিফলন পাওয়া যায়।
সম্প্রতি নড়াইল ও সাভারের ঘটনাপ্রবাহ তার একটা বড় প্রমাণ। দেশের রাজনৈতিক নেতারা নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত। পরস্পরের দিকে কাদা-ছোড়াছুড়ি নিয়েই আছেন। তাঁদের এসব চোখেই পড়ে না।
দেশের মানুষের ভবিষ্যৎ যেখানে তৈরি হয়, সেটা নিয়ে ভাবার কোনো অবকাশ নেই। শিক্ষা যে মানুষকে সহনশীল, যুক্তিবাদী এবং অন্যায়ের প্রতি মুখ ফেরাতে বলে এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হয়, তা কে বোঝাবে? পঞ্চাশ বছরের শাসকগোষ্ঠী খোদ রাজধানী শহরের ধানমন্ডি, বনানী, গুলশান, উত্তরা, মিরপুরে মানুষের বিনোদন ও শিক্ষার জন্য কোনো সুযোগ রাখেনি। এই সব জায়গায় কোনো পাঠাগার নেই, ভালো বইয়ের দোকান নেই, সিনেমা হল নেই, নাট্যমঞ্চ নেই। কিন্তু আছে অসংখ্য শপিং কমপ্লেক্স ও বাহারি খাবারের দোকান। এই শপিং কমপ্লেক্সগুলোর সংখ্যা এত বেশি যে লুটেরাদের অর্থ ব্যয়ের একটা ব্যবস্থা সেখানে তৈরি হয়েছে। ঢাকা শহরে ভোগ্যপণ্যের জন্য অবারিত এত দোকান পৃথিবীর আর কোনো দেশে আছে কি না, জানা নেই।
শুধু ঢাকায় নয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়েও এর প্রভাব পড়েছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাড়িতে সিনেমা হলের পর্দার সমান টেলিভিশনের পর্দা। সেখানে খেলাধুলা ও বিদেশি বিনোদন ছাড়া আর কিছু দেখা হয় না। উন্নয়ন মানে দালানকোঠা, রাস্তাঘাট, ফ্লাইওভার, সেতু নির্মাণ। কিন্তু তার আড়ালে মানবিক উন্নয়ন ধসে গিয়ে সেই দালানকোঠা বা সেতুকে ধসিয়ে দিচ্ছে।
শিক্ষার পাশাপাশি থাকে সংস্কৃতি। স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক ব্যবস্থাগুলোর মধ্যেও সংস্কৃতি নেই। তাই সেখানে সহপাঠীরা পরিকল্পনা করে তাঁদের ছোট ভাইদের হত্যা করছে এবং বড় ভাইদের প্রতি অশোভন আচরণ করাটা একটা নিয়মে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। র্যাঙ্কিং যেখানে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। ঝিনাইদহের এক গ্রাম থেকে মেধাবী ছাত্র হলে আসন পেয়ে তার প্রতিদিনের কান্নাধ্বনি, প্রতিধ্বনি হচ্ছে তার আবাসিক কক্ষে। এ নিয়ে দেশের নীতিনির্ধারক থেকে শুরু করে শিক্ষক থেকে উপাচার্য—কেউ উদ্বিগ্ন নন।
শিক্ষার বিষয়টি এখন সম্পূর্ণভাবে একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত; যা শুধু মন্ত্রণালয়ের বিষয় নয়, ব্যাপকভাবে সামাজিক। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ আসার আগে শিক্ষাটি ছিল একটি সামাজিক বিষয়।
সমাজ তার নিজের প্রয়োজনে শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করেছিল। ব্রিটিশরা এসে তাদের উপনিবেশের প্রয়োজনে একটি শিক্ষাব্যবস্থা চালু করে, যা তাদের দৈনন্দিন কাজ চালানোর জন্য এবং প্রশাসনিক প্রয়োজনে। পাকিস্তান আমলে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে দমন করার জন্য নানা ধরনের কমিশন করে শিক্ষাকে সংকুচিত করার চেষ্টা চালায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়। পরবর্তীকালে বাহাত্তরের সংবিধানের মতো তাকে ক্ষতবিক্ষত করে আরও শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়। কিন্তু যুগোপযোগী শিক্ষা কমিশন আর গঠিত হয়নি। দেশের মেধাকে শিক্ষার কাজে লাগানোর কোনো পরিকল্পনাও হয়নি। যেখানে শিক্ষা, সংস্কৃতির পাশাপাশি একটা বুদ্ধিভিত্তিক যুক্তিবাদী সমাজ নির্মাণ করার ভাবনা থাকে। তার এই অনুপস্থিতিতে দেশে এসেছে ধর্মভিত্তিক শিক্ষা, যা বাস্তবের সঙ্গে একেবারেই সাংঘর্ষিক।
বর্তমানে শিক্ষার ব্যবস্থাটির দিকে যদি নজর দেওয়া না হয়, তাহলে সমাজ গভীর থেকে গভীরতর সংকটে নিমজ্জিত হবে—তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
লেখক: মামুনুর রশীদ, নাট্যব্যক্তিত্ব