দেশজুড়েই সাংস্কৃতিক চর্চার কেন্দ্র গড়ে তোলা দরকার পড়বে। কেন্দ্র গড়ার ব্যাপারে পাঠাগারগুলো কাজে লাগানো যেতে পারে। দেশে অনেক পাঠাগার রয়েছে, সেগুলো পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব, সেই সঙ্গে নতুন নতুন পাঠাগার গড়ে তোলা মোটেই অসম্ভব নয়। পাঠাগার যে কেবল বই পড়ার এবং বইয়ের আদান-প্রদানের কেন্দ্র হবে তা নয়, হবে নানা বিষয়ে আলোচনার প্রাণবন্ত একটি পরিসর। সেখানে বক্তৃতা হবে, চলবে বিতর্ক। আয়োজন থাকবে নাট্যাভিনয়ের। পুরোনো নাটকের পাশাপাশি নতুন নাটকও লেখা হবে। গানের আয়োজন থাকবে; বিশেষ করে সমবেত কণ্ঠে গানের। প্রদর্শনী, প্রতিযোগিতা, খেলাধুলা—কোনো কিছুই বাদ যাবে না। পাশাপাশি গড়ে তোলা হবে দেশব্যাপী একটি কিশোর আন্দোলন। পাঠাগারের আশপাশেই ছেলেমেয়েরা সব ধরনের সাংস্কৃতিক অনুশীলনে অংশ নেবে। এ কাজের মধ্য দিয়ে তরুণেরা সৃষ্টিশীল, সামাজিক ও দেশপ্রেমিক হয়ে উঠবে। তারা শরীরচর্চাও করবে। তাদের অবকাশ ও অবসর হয়ে উঠবে আনন্দমুখর। কেটে যাবে বিষণ্নতা। বিপন্ন মানুষকে সাহায্য করতে তারা অগ্রণী হবে। সামাজিক নিরাপত্তা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে পারবে। এলাকার পথঘাট, জলাশয়, বিদ্যালয়—এসবের উন্নয়নে তারা হাত লাগাবে।
একাত্তরে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি সাংস্কৃতিক প্রস্তুতিহীন অবস্থায় এবং যুদ্ধের পরে বিজয়কে যে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারিনি, সেটাও মূলত ওই প্রস্তুতির অভাব ছিল বলেই। সংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্রে সৃষ্টিশীলতাকে উৎসাহিত করার পাশাপাশি দুটি বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া আবশ্যক—ইতিহাস ও সাহিত্যের চর্চা। ইতিহাসের জ্ঞান না থাকাটা তো স্মৃতিভ্রংশ হওয়ারই সমান। আমাদের ইতিহাসে একদিকে রয়েছে অন্যায় ও জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের গৌরবজনক ঘটনা, অন্যদিকে আছে অন্যায় ও জুলুমের মর্মন্তুদ কাহিনিও। এরা একে অপরের পরিপূরক। উভয়ের জ্ঞানই অত্যাবশ্যক। আমরা যে কেবল নিজেদের ইতিহাসই পড়ব তা নয়, পড়তে হবে বিশ্বের ইতিহাসও। সভ্যতার উত্থান-পতনের কারণ জানা চাই, জানতে হবে জ্ঞানবিজ্ঞানের ইতিহাস। আর সাহিত্যের চর্চা একই সঙ্গে বৃদ্ধি করবে কল্পনার শক্তি ও চিন্তার দক্ষতা; সমৃদ্ধ করবে চিন্তার ক্ষমতাকেও। সাহিত্যচর্চা অবশ্যই বাড়াবে নিজেকে ব্যক্ত করার সক্ষমতা এবং ঘটাবে রুচির উৎকর্ষ।
বলা বাহুল্য, কোনো পাঠই একরৈখিক হবে না; হবে দ্বান্দ্বিক। থাকবে প্রশ্ন, জেগে উঠবে জিজ্ঞাসা এবং সংস্কৃতির এই অনুশীলন মোটেই আদর্শ-নিরপেক্ষ হবে না। আদর্শ একটাই—প্রগতিশীল সমাজবিপ্লবকে সম্ভব করা। নতুন সমাজ গড়ে তোলা এবং তারই প্রয়োজনে ধর্মনিরপেক্ষতার বোধকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। মনে রাখা চাই, ধর্মনিরপেক্ষতার উপাদান দুটি—একটি দার্শনিক, সেটিকে বলা যায় ইহজাগতিকতা। অপরটি রাজনৈতিক, যার মূল কথাটা হলো রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের বিযুক্তি। আওয়াজটা আমাদের সুপরিচিত: ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার’। ধর্ম থাকবে ধর্মের জায়গায়, রাষ্ট্র রাষ্ট্রের।
নড়াইলে সাম্প্রদায়িক হিংস্রতার ঘটনার কথা আবার মনে পড়ছে। সাংস্কৃতিকভাবে নড়াইল এলাকাটি সুখ্যাত। নড়াইলে তেভাগা আন্দোলন হয়েছে। ১৯৬৮ সালে সেখানে মওলানা ভাসানীর ডাকা হাট-হরতাল পালিত হয়েছে। আর নড়াইলের যে লোহাগড়া এলাকায় হিন্দুসম্প্রদায়ের ঘরে অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠন ঘটল, মুক্তিযুদ্ধে সে জায়গাটিতে মানুষের অংশগ্রহণ ছিল স্মরণীয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন নূর মোহাম্মদ মিঞা; একাত্তরের মধ্য মার্চে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির এক আলোচনা সভায় দাঁড়িয়ে তিনি উচ্চকণ্ঠে বলেছিলেন, ‘এসব কথাবার্তায় কোনো কাজ হবে না, যুদ্ধ করতে হবে, আমি যুদ্ধে চললাম।’ বলে বেরিয়ে সত্যি সত্যি চলে গিয়েছিলেন তাঁর গ্রামে, ওই লোহাগড়ায়। মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করার কাজে তাঁর ভূমিকা ছিল নেতৃস্থানীয় এবং স্থানীয় মানুষের অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত ও সুদৃঢ়। যুদ্ধ শেষে তিনি তাঁর ওই গ্রামে মনোযোগ দিয়েছিলেন একটি কলেজ প্রতিষ্ঠায়। কলেজের তরুণ অধ্যক্ষকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিলেন অতিরিক্ত শিক্ষা লাভের জন্য। ওই কলেজের পাঠাগারের জন্য সহকর্মীদের কাছ থেকে বই সংগ্রহ করে নিয়ে যেতেন, প্রতিবার গ্রামে যাওয়ার সময়ে। আজ তিনি নেই; থাকলে সাম্প্রদায়িক হিংস্রতার খবর শুনলে অত্যন্ত বিষাদগ্রস্ত হতেন নিশ্চয়ই এবং আলোচনা করে আমরা হয়তো এই সিদ্ধান্তেই পৌঁছাতাম যে জাতীয়তাবাদী সংগ্রামটা শেষ কথা নয়, তাকে নিয়ে যাওয়া দরকার সমাজতন্ত্রের অভিমুখে। সেটা না করতে পারলে পুঁজিবাদের দানব আমাদের সব অর্জনকে তছনছ করে দেবে; এখন যেমন দিচ্ছে।
স্বর্গের মতো অগ্নিও নানা প্রকারের হয়ে থাকে। সব আগুনই ভয়ংকর, যদি সে পোড়ায়। ইউরোপ ও আমেরিকাজুড়ে দাবদাহ চলছে। আতঙ্কিত হচ্ছে মানুষ, গৃহহারা হয়েছে অনেকে, মৃত্যুও ঘটেছে। ঘটনাটা প্রাকৃতিক, কিন্তু কারণটা মানসিক। মানুষই দায়ী। উন্নয়নের নাম করে মানুষ প্রকৃতিকে উত্ত্যক্ত করেছে। প্রকৃতিরও প্রাণ আছে, সীমা আছে তার সহ্য ক্ষমতার; প্রকৃতি প্রতিশোধ না নিক, প্রতিক্রিয়া তো জানাবে। সেটাই ঘটছে। শীতের দেশের মানুষেরা এতকাল গরমের দেশের ওপর যে আধিপত্য করে এসেছিল, এখন তাতে ফাটল ধরেছে; শীত-গ্রীষ্ম এখন সমান হয়ে যাচ্ছে, বিপদে পড়লে যা হয়ে থাকে। কিন্তু শ্বেত আধিপত্যবাদীরা কি থামাবে তাদের কাজ? তাকাবে কি প্রকৃতির দিকে? শুনবে কি তারা অশনিসংকেত? এমনিতে শুনলেও শুনবে না, তাদের শোনাতে হবে। দায়িত্বটা বিবেকবান ও বুদ্ধিমান মানুষদের।
শীতের দেশ গ্রেট ব্রিটেনের কথা আলোচনায় এসেছে। শেষ করা যাক তার কথা দিয়েই। গ্রেট ব্রিটেনের সমাজে এখন বড় রকমের একটা পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। সেটাকে বলা যায় সাংস্কৃতিক। কনজারভেটিভ পার্টি হচ্ছে ঘোষিতরূপেই রক্ষণশীলদের দল, তাদের ভেতর বর্ণবাদ থাকবে—এটা খুবই প্রত্যাশিত। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে ওই দলের সংস্কৃতিতে একটা পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে।
সম্প্রতি ব্রিটেনে প্রধানমন্ত্রী পদে দলের ভেতর থেকেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন যে দুজন, তাঁদের একজন শুধু অ-শ্বেতাঙ্গই নন, একেবারে ভারতীয় বংশোদ্ভূত। তিনি অবশ্য প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি। কট্টর রক্ষণশীল অন্য প্রার্থী, যিনি একজন নারী, তিনি শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন। যে ইংরেজরা ভারত জয় করেছিল এবং শাসন ছাড়ার পরেও যারা মনের জগৎ থেকে আধিপত্য গুটিয়ে নেয়নি, সেই ইংরেজদের দেশে গিয়ে একজন ভারতীয় কর্তৃত্ব করবেন, এ কেমন কথা? নির্বাচিত নারী প্রধানমন্ত্রী রক্ষণশীলতার খাঁটি প্রতিমূর্তি হিসেবে অভিহিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের মতো হবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু ওই যে জন্মসূত্রে ভারতীয় ভদ্রলোক—ঋষি সুনাক নাম, তিনি যে এতটা এগোতে পারলেন তার কারণ কী? অন্য কারণ আছে, তবে যে কারণটা না থাকলে ঘটনাটি ঘটা একেবারেই অসম্ভব ছিল, সেটি হলো তাঁর রক্ষণশীলতা। গায়ের রং যা-ই হোক মন ও মানসিকতায় তিনিও কনজারভেটিভই; লিবারেল নন, লেবার তো ননই। ফেসবুকে তিনি নাকি স্বীকার করেছেন যে শ্রমিকশ্রেণির কোনো মানুষের সঙ্গে তাঁর কোনো বন্ধুত্ব নেই। বোঝা গেল ইনি খাঁটি বস্তু এবং বর্ণ সত্য বটে, কিন্তু শ্রেণি সত্য আরও অধিক।
পুঁজিবাদ নিজেকে রক্ষা করার জন্য ছাড় দিচ্ছে। ঋষি সুনাককে প্রধানমন্ত্রী হতে না দিক, ওই পদের কাছাকাছি তো গুটিগুটি পৌঁছাতে দিয়েছে, সেটাই-বা কম কিসে? কম নয়, তবে বেশি বলে যেন উৎফুল্ল না হই। কারণ রক্ষণশীল কনজারভেটিভ দলের বাইরের চেহারাটা যা-ই হোক, ভেতরের রংটা অবিকল আগের মতোই। আর লিবারেল দল? তারা তো পুঁজিবাদকেই রক্ষা করতে চায়, নানা ধরনের উদারতা প্রদর্শন করে। এমনকি লেবার পার্টিও এখন আর শ্রমিকশ্রেণির স্বার্থরক্ষাকারী রাজনৈতিক দল নয়। তাদের নেতৃত্বও উদারতাবাদী হয়ে পড়েছে।
সব মিলিয়ে বার্তা যা, তা হলো পুঁজিবাদ এখন বিপদে আছে, তাই ছাড় দিচ্ছে। তবে মতাদর্শিকভাবে সে তার অবস্থান থেকে সরে দাঁড়ায়নি; বরং নিজের আদর্শের বিষ বিরোধীদের ভেতর সংক্রমিত করছে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে শ্রমিকদের পুঁজিবাদী করে তুলছে এবং তাদের দলগত যে সংগঠন, তার নেতাদেরও নিজের আদর্শে দীক্ষিত করার তালে আছে। মরণকামড়!
সংস্কৃতি দুষ্ট হয়ে পড়েছে; সাংস্কৃতিক লড়াইটা তাই বিশ্বব্যাপী এখন অত্যন্ত জরুরি, সমাজবিপ্লবের লক্ষ্যে এবং সমাজবিপ্লবের যে সংগ্রাম, সেটি একই সঙ্গে দেশি ও আন্তর্জাতিক। এই সংগ্রামে পরাজয়ের কোনো স্থান নেই। পরাজয় মানেই মৃত্যু।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়