তাঁদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য মোটেও দেশীয় সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, ইতিহাস ও ঐতিহ্য, পোশাক, ইত্যাদির প্রতি গভীর মমত্ববোধ থেকে নয়। বরং সহজেই অনুমেয় যাঁরা এই উদ্যোগটি নিয়েছিলেন, তাঁরা কয়েকটি উদ্দেশ্যে এই মানববন্ধনটি সংঘটিত করেছিলেন।
দেশের কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দু-একটি বিক্ষিপ্ত-বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া আপাতত শান্ত বলেই মনে হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের একজন নেতার হাতে সাধারণ একজন শিক্ষার্থীর নির্যাতন নিয়ে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েক দিন ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে প্রতিবাদ ও মানববন্ধনের কর্মসূচি দেখা গেছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগে পদ-পদবি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় এক দিন বন্ধ রাখার ঘটনাও ঘটেছে। এ ধরনের অভ্যন্তরীণ, স্বার্থসংশ্লিষ্ট দ্বন্দ্ব-সংঘাতের কিছু বাড়াবাড়ি ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বাহ্যত শান্ত, লেখাপড়া-পরীক্ষাও হচ্ছে। ছাত্রলীগ প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে সক্রিয়। আশি-নব্বইয়ের দশকের মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন আর রণক্ষেত্রে পরিণত হয় না, বড় বড় ‘ভ্যাকেশনে’ বন্ধ হয়ে যায় না।
এ তো গেল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। বেসরকারি বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন ব্যাপকসংখ্যক শিক্ষার্থী পড়াশোনা করেন। সেগুলোতে ছাত্রসংগঠনের অস্তিত্ব নেই। তবে ছাত্রসংগঠনের অস্তিত্বহীন শিক্ষার পরিবেশে কোনো কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা ধরনের ক্লাব, সংগঠন, আলোচনা চক্র ইত্যাদি পরিচয়ে কিংবা কোনো কাঠামোগত পরিচয় না দিয়ে ধর্মের নামে জঙ্গিবাদী এবং সাম্প্রদায়িক ভাবাদর্শে শিক্ষার্থীদের একটি অংশকে গোপনে জড়িত করার উদ্যোগ কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। বিশেষত বেশ কয়েকটি নামীদামি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের দৃশ্যমান কিংবা অদৃশ্যমান উদ্যোগ আগে থেকেই চলে আসছিল, সেটির প্রমাণ পাওয়া যায় হোলি আর্টিজানের ভয়ংকর জঙ্গি হত্যাকাণ্ডের পর। এর সঙ্গে কিছু শিক্ষক-শিক্ষার্থীর গোপনে জড়িত থাকার কথাও তখন বের হয়ে আসে। এটি কি থেমে গেছে? তবে গোপনে কিছু কিছু গোষ্ঠী এখনো সংঘবদ্ধ রয়েছে। নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, কোটাবিরোধী আন্দোলন অথবা শিক্ষার্থীদের ছাত্র-বেতন বৃদ্ধির আন্দোলন যখন রাস্তায় সংঘটিত হয়, তখনই তাতে এদের ঢুকে পড়তে দেখা গেছে। এমনকি বাসভাড়া বৃদ্ধি নিয়েও কোথাও কিছু ঘটলে সেখানেও তাদের ঢুকে পড়ার নজির দেখা যায়। এরা যে সবাই এক আদর্শের ধারক-বাহক, তা-ও নয়। বিভিন্ন গোষ্ঠী বিভিন্ন উদ্দেশ্যে গোপনে ক্রিয়াশীল, এটি অনেকটা নিশ্চিত।
কয়েক মাস আগে নরসিংদী রেলস্টেশনে একজন নারী শিক্ষার্থীর পোশাক নিয়ে কয়েকজন নারী-পুরুষ তাঁর ওপর হামলে পড়েন। এ নিয়ে বেশ তোলপাড় হয়। বিভিন্ন সংগঠনের নেতা-কর্মীরা সেই হেনস্তাকারীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী শেষ পর্যন্ত কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে, মামলা হয়। মামলা উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়ায়। উচ্চ আদালতের বিচারপতির কিছু বক্তব্যকে সমর্থন জানিয়ে ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, নর্থ সাউথ এবং ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী ২৫ আগস্ট একই সময়ে একটি মানববন্ধন করেন। এটি যে একটি সংঘবদ্ধ উদ্যোগ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে প্রতিবাদকারীরা ‘দেশীয় মূল্যবোধবিরোধী পোশাকের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে উচ্চ আদালতকে অভিবাদন’ শিরোনামে ব্যানারটি বহন করেছিল। নরসিংদী রেলস্টেশনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী হেনস্তার ঘটনাটি ঘটেছিল গত ১৮ মে। তখন এঁরা দেশীয় সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের পক্ষে দাঁড়িয়ে তাঁদের শিক্ষার্থী বন্ধুর পক্ষে বা বিপক্ষে কোনো প্রতিবাদ করেননি। সেই সময় ছাত্রী হেনস্তার প্রতিবাদে সবাই মুখর ছিলেন।
এত দিন পর ‘সুযোগ বুঝে কোপ মারার’ কৌশল নিয়েছেন প্রতিবাদকারীরা! তাঁরা নির্যাতিত ছাত্রীর পক্ষে নন, তাঁর পোশাককে পশ্চিমা, বিদেশি সংস্কৃতি বলে অভিহিত করে সমালোচনা করেছেন, অভিনন্দন জানিয়েছেন দেশের আদালতকে। নিজেদের রক্ষা করার জন্যই উচ্চ আদালতকে ‘এই অভিনন্দন’ জানানো। নির্যাতিত ছাত্রীর পোশাক সম্পর্কে উচ্চ আদালতের কোনো রায় নয়, পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত কিছু মন্তব্যকেই তাঁরা অভিনন্দন জানিয়ে পশ্চিমা পোশাক ও সংস্কৃতির আমদানিকারকদের বিরুদ্ধে ওই মানববন্ধনের কয়েকজন শিক্ষার্থী দাঁড়ান। কিন্তু যাঁরা দাঁড়ান তাঁদের অনেকেরই পরনে বাঙালি পোশাকের পরিবর্তে ভিনদেশি পোশাক ছিল বলে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাঁরা মানববন্ধন করেছিলেন তাঁরা দাঁড়িয়েছিলেন রাজু ভাস্কর্যের পাশে। রাজু ভাস্কর্যের আদর্শ, ইতিহাস ও ঐতিহ্যকেই কী তাঁরা ধারণ করেন? আসলে তাঁরা ঢাল হিসেবে উচ্চ আদালত এবং রাজু ভাস্কর্যকে ব্যবহার করেছেন। কিন্তু তাঁদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য মোটেও দেশীয় সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, ইতিহাস ও ঐতিহ্য, পোশাক, ইত্যাদির প্রতি গভীর মমত্ববোধ থেকে নয়। বরং সহজেই অনুমেয় যাঁরা এই উদ্যোগটি নিয়েছিলেন, তাঁরা কয়েকটি উদ্দেশ্যে এই মানববন্ধনটি করেছিলেন।
প্রথমত, তাঁরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিলেন। দ্বিতীয়ত, তাঁরা যে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আছেন, তা-ই নয়, জাহাঙ্গীরনগর, কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় এবং বেসরকারি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়েও একই ব্যানারে একই সময়ে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিয়েছেন। তৃতীয়ত, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে বরাবরই অসাম্প্রদায়িক চিন্তাধারার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একটি নিয়ন্ত্রণাধীন বিশ্ববিদ্যালয় বলে অভিহিত করা হতো। এ ঘটনা যাঁরা ঘটিয়েছিলেন তাঁরা ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের চোখে ধুলা দিতে পেরেছেন, সেটিই কি ধরে নিতে হবে? চতুর্থত, কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে একসময় ছাত্রশিবিরের রাজত্ব ছিল। সেই রাজত্ব কয়েক বছর আগে ভেঙে গেছে বলে দাবি করা হয়। সেখানে ছাত্রলীগ এবং অন্যান্য মতাদর্শের শিক্ষার্থীদের অবস্থান আগের চেয়ে সংহত বলে বলা হচ্ছে। এই শিক্ষার্থীরা কি তাঁদেরও ফাঁকি দিতে পেরেছেন? পঞ্চমত, নর্থ সাউথ একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়।
সেখানে তো কারও কোনো বিশেষ ছাত্রসংগঠনের অস্তিত্বের কথা কেউ স্বীকার করে না। অভিজাত এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা বেশির ভাগ শিক্ষার্থী ধনী পরিবারের সন্তান। তাঁদের অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেটটি হাতে নিয়ে পশ্চিমা দেশেই পাড়ি জমান।
এরা এখানেই থেমে থাকবে এমনটি নয়, এরা একাও নয়। এদের পেছনে নিশ্চিতভাবে বলা চলে সাম্প্রদায়িক শক্তির একটি পরিকল্পনা কার্যকর রয়েছে। আরও থাকতে পারে, রাজনীতির ময়দানে সরকারের বিরুদ্ধে এখন যারা সংগঠিত হচ্ছে, তাদেরও কারও কারও ইন্ধন। সেখানে তো অনেক সাবেক বাম, গণতন্ত্রী ব্যক্তিজনের উদ্যোগে মঞ্চ গঠিত হয়েছে। অবশ্য এই মঞ্চের নেপথ্য কুশীলব কারা? তারাও খুব বেশি অজানা কেউ নন।
আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নানাজনের নানা কৌশল হয়তো আমাদের দেখতে হতে পারে। চার বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা কাদের কৌশল দেখেছি, সেটি রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা হয়তো জানতে পারে। আপাতত আমাদের কাছে সাম্প্রদায়িক শক্তি মনে হলেও এখন সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে অতীতের অনেক অসাম্প্রদায়িকেরাও যুক্ত হয়েছে। কোনো রাজনীতির মেরুকরণই এখন আর বিশুদ্ধ নয়। সেটি ডান, বাম অথবা উদারবাদীই হোক। মিশ্রণ ঘটে গেছে রাজনীতিতেও। সে কারণে গল্পের গর্তে পড়া নুরুল ইসলাম কার নুরুল ইসলাম, সেটি যেমন হারিকেন দিয়ে জানতে হয়েছে, এখনকার সংঘবদ্ধ সাধারণ ছাত্ররাও কোনো সাধারণ না অসাধারণ, সেটিও আলোতে তুলে দেখতে হবে। তবে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় এখন আপাত শান্তির ভেতরে অনেক অশান্তির বীজ লুকিয়ে আছে। সেই লুকিয়ে থাকা বীজদের চেনার উপায় কী?
মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী, অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট