নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছে আজকের পত্রিকায়। জুলাই-আগস্টের অস্থির সময় পার করার পরও মানুষের প্রায় সব আলোচনা যখন রাজনীতিকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে, ঠিক সে সময় ভিন্ন একটি বিষয়ে দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে মামুনুর রশীদ যা বললেন, তা নিয়ে ভাবতে হয়।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর মঞ্চনাটক খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। সে সময় একদল তরুণ নাটকে নিজেদের নিবেদন করেছিল। প্রবীণ ও নবীনের সেই মেলবন্ধন বহু আশাজাগানিয়া নাটকের জন্ম দিয়েছিল। নিঃসন্দেহে বলা যায়, রুচি ও যৌক্তিক মন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এই নাটকগুলো অবদান রেখেছিল। একই সঙ্গে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত নাটকগুলোতেও ছিল শিক্ষা, মেধার ছাপ। দর্শক প্রবল আগ্রহ নিয়ে সপ্তাহের নাটকটি দেখার জন্য অপেক্ষা করত।
সাংস্কৃতিকভাবে ঋদ্ধ হওয়ার একটি জানালা খুলে দিয়েছিল নাটক। পরবর্তীকালে নাটক তার সুনামের এই জায়গাটা ধরে রাখতে পারেনি। সমাজে, রাজনীতিতে, অর্থনীতিতে নানা ধরনের পরিবর্তন সূচিত হয়েছে, নাটক তার স্পর্শ থেকে নিজেকে আলাদা করে রাখতে পারেনি।
ফলে একসময় নাটকও পা বাড়িয়েছে গড্ডলিকা প্রবাহের দিকে। এর মধ্যে কেউ কেউ যে নাটককে তাঁর রুচিশীল ও সৃজনশীল জায়গায় ধরে রাখতে পারেননি, তা নয়, কিন্তু তটবিনাশী প্রচণ্ড সাইক্লোনের সামনে তা খড়কুটোর মতো ভেসে গেছে। পৃষ্ঠপোষকদের মধ্যে এসে হাজির হয়েছেন বড় পুঁজির মালিকেরা। টেলিভিশন গ্রাস করে নিয়েছেন তাঁরা।
নাটকের গল্প, অভিনয়শিল্পী থেকে শুরু করে পুরো শিল্পটাকেই তাঁরা কুক্ষিগত করে রেখেছেন। জীবনের তাড়নায় মঞ্চনাটকপ্রেমীদের সংখ্যাও কমেছে। আগের মতো মহড়াপ্রধান নাটকের জায়গায় কম পরিশ্রমে পথ পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা বেড়েছে। এরপর এসেছে ইউটিউব নাটক। এই নাটকগুলো নিয়ে আলাদাভাবেই আলোচনা করা দরকার। তবে সে আলোচনা এখানে নয়।
শিল্প-সংস্কৃতির বিকাশে নাটকের অবদান মোটেই ফেলনা নয়। পশ্চাৎপদ মানুষ যেকোনো সৃজনশীলতাকে ভয় পায়। তারা আটকে রাখতে চায় সংস্কৃতির বিকাশকে। ফেসবুক জমানায় রুচির কতটা বিকার ঘটেছে, তা জানার জন্য বেশি কষ্ট করতে হবে না। একজন নারীর ছবি দিয়ে রসাল কিছু লিখে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করা হলে সে পোস্টের মন্তব্যগুলোর দিকে নজর দিলেই বোঝা যাবে, রুচির দুর্ভিক্ষটা কোন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। আর রাজনৈতিক পোস্টে প্রতিহিংসার ছড়াছড়িও নিশ্চয় চোখ এড়াবে না।
এখনো যাঁরা নাটককে মর্যাদাসহ টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে অবদান রাখছেন, তাঁদের চলার পথ মসৃণ করতে হবে। এ জন্য সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষণার দরকার আছে। কিন্তু পৃষ্ঠপোষণার অর্থ যেন নাটকের ওপর ছড়ি ঘোরানো না হয়, বরং নাটককে তার সুস্থ, স্বাভাবিক, সৃজনশীল পথে চলতে দেওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি করে দেওয়া হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
নাট্যাঙ্গনের সংকটগুলো অনেকটাই উঠে এসেছে মামুনুর রশীদের সাক্ষাৎকারে। সেগুলো কাটিয়ে ওঠার ব্যবস্থা নেওয়া হোক। ডিজিটাল যুগে যন্ত্রের কাছে জীবনের অনেকটাই ছেড়ে দেওয়ায় সামাজিক জীবনের গভীরতা নষ্ট হচ্ছে। সেই গভীরতা ফেরানোর একটি পথ হতে পারে সৃষ্টিশীল নাটক।