বোরহানউদ্দিনে মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীর তীব্র ভাঙনে মূল বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। এখন রিং বেড়িবাঁধের বেশ কয়েকটি স্থানেও ধসে পড়েছে। এতে হুমকির মুখে পড়েছে উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের হাজারো বসতবাড়ি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। প্রতিটি মুহূর্তে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন নদীপাড়ের মানুষ। বসতি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রক্ষায় এলাকাবাসী দ্রুত ব্লকবাঁধ নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, বোরহানউদ্দিন উপজেলার মির্জাকালু গ্রামটির প্রায় অর্ধেক অংশ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। পক্ষিয়া বাটামারা এলাকার অনেকের বসতভিটা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। যেখানে বসতভিটা ছিল নদীর সেই দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ফেলেন ভিটার মালিকেরা। বাটামারা এলাকার মফিজ বলেন, ‘আজ আমাদের ভিটেমাটি বাপ-দাদার সম্পত্তি নদীর মধ্যে পড়ে আছে। আমাদের আত্মীয়-স্বজন ও পরিবারের অনেকের কবর রাক্ষুসে মেঘনায় বিলীন হয়ে গেছে। সবকিছু হারিয়ে যেতে দেখেছি, কিন্তু কিছুই করার ছিল না।’
পক্ষিয়ায় বসবাসরত কাসেম মাঝি বলেন, ‘আমাদের বাসা ছিল মির্জাকালু গ্রামে, কিন্তু মেঘনা নদীর ভয়াল থাবায় আমরা হারিয়েছি আমাদের পরিবার, হারিয়েছি বসতভিটাসহ বাপ-দাদার সম্পত্তি, এখন নতুন করে কিছু জায়গা কিনে পক্ষিয়ায় ঘর তুলেছি।’
মনজু নামে একজন বলেন, ‘আমাদের বাসা ছিল আলিমুদ্দিন বাংলাবাজার। কিন্তু কয়েক বছর আগে আমাদের সব নিয়ে গেছে, এখন একটু জায়গা কিনে ঠাঁই নিয়েছি।’
এদিকে, বোরহানউদ্দিনের এক সময় মূল বেড়িবাঁধ হিসেবে ব্যবহার হওয়া গঙ্গাপুর ইউনিয়নের জয়া-মৌলভির হাট-খাঁয়ের হাট পাকা সড়কটি কুতুবা ইউনিয়নের দুই ও তিন নম্বর ওয়ার্ড এলাকা থেকে দক্ষিণ জয়নগর ইউনিয়নের চার নম্বর ওয়ার্ড হয়ে গঙ্গাপুর ইউনিয়নের এক ও দুই নম্বর ওয়ার্ড পর্যন্ত প্রায় দেড় কিলোমিটার পাকা সড়ক কাম বাঁধ নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বিলীন হওয়ার প্রায় আড়াই বছর আগে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) নির্মিত রিং বেড়িবাঁধটিও ৬-৭টি স্থান দিয়ে ধসে গেছে।
কুতুবা ইউনিয়নের তিন নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মিজানুর রহমান বলেন, ‘দ্রুত ব্লক বাঁধ নির্মাণের ব্যবস্থা না নিলে আমরা ভিটেমাটি হারাব।’ একই ইউনিয়নের দুই নম্বর ওয়ার্ডের মাওলানা নেছারউদ্দিন বলেন, ‘নদীর স্রোতে রিং বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। আমরা অসহায়ের মতো ভাঙন দেখছি, আর আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছি।’
দুই নম্বর ওয়ার্ডে অবস্থিত ৭৫ বছর বয়সী ছোটমানিকা ফাজিল মাদ্রাসা। এই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মো. সাইফুল্যাহ জানান, মাদ্রাসায় ৬৫০ জন ছাত্র-ছাত্রী। নদী থেকে মাদ্রাসার দূরত্ব মাত্র ২০-২৫ ফুট। অবিলম্বে ব্লকবাঁধ নির্মাণ না করলে মাদ্রাসা নদীগর্ভে চলে যাবে। এলাকার শিক্ষার্থীরা সংকটে পড়বে।
কুতুবা ইউপি চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান জোবায়েদ বলেন, ‘গত দুই বছরে এক ও দুই নম্বর ওয়ার্ডের প্রায় ৫০০ পরিবার বসতভিটা হারিয়েছে। চলতি শুকনো মৌসুমে ব্লকবাঁধ নির্মাণ না করলে এই সংখ্যা বাড়তেই থাকবে। নদী সংলগ্ন গঙ্গাপুর ও কুতুবা ইউনিয়নের মধ্যবর্তী দৌলতখান উপজেলা দক্ষিণ জয়নগর ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ড। ওই ওয়ার্ডের বাসিন্দা জেবল হক ব্যাপারী বলেন, ‘ধসে যাওয়া বাঁধ থেকে ঘরবাড়ির দূরত্ব মাত্র ১০-১৫ গজ। ২ বছর আগেও তা আধা কিলোমিটার দূরে ছিল। দ্রুত ব্লকবাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ না নিলে তাঁদের ভিটেমাটি হারাতে হবে।’
গঙ্গাপুর ইউপি চেয়ারম্যান রেজাউল করিম রিয়াজ জানান, গত দুই বছরে তাঁর ইউনিয়নের এক নম্বর ওয়ার্ডের প্রায় ১৫০ পরিবার, দুই নম্বর ওয়ার্ডের প্রায় ৩০০ পরিবার, ৩ নম্বর ওয়ার্ডের প্রায় ৩০০ পরিবার ভাঙনের শিকার হয়ে অন্য জায়গায় চলে গেছেন। এ ছাড়া নয় নম্বর ওয়ার্ডের দুই-তৃতীয়াংশ এলাকা নদীগর্ভে চলে গেছে। ফলে ওই এলাকার বাসিন্দাদের বসতবাড়ি হারাতে হয়েছে। তিনি খাঁয়ের হাট লঞ্চ ঘাট থেকে নয়নের খাল পর্যন্ত ব্লকবাঁধ স্থাপনের মাধ্যমে তিন ইউনিয়নের জনপদ সহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রক্ষার দাবি জানান।
পক্ষিয়া ইউপি চেয়ারম্যান নাগর হাওলাদার জানান, নদী ভাঙনে দিশেহারা হয়ে অনেকেই বাপ-দাদার বসভিটা ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছে অন্য জায়গায় কেউবা নদীর পাড়ে নিজের বসত বাড়ির দিকে বারবার চেয়ে চোখের পানি ফেলেছে। তিনি জানান, ওই ইউনিয়নের প্রায় দুই থেকে তিন হাজার বাড়িঘর ইতিমধ্যে নদীর কবলে পড়ে বিলীন হয়ে গেছে।
বোরহানউদ্দিন ইউএনও সাইফুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বিগত বছরগুলোতে যাঁদের ঘরবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে, তাঁদের সহযোগিতা করার চেষ্টা করেছি। এখনো যাঁরা বাকি আছেন, তাঁদের জন্য খাস জমি পেলে সেখানে তাঁদের আবাসনের ব্যবস্থা করা হবে।’ তিনি জানান, শীতের সময় নদীপাড়ের মানুষের যাতে কষ্ট না হয়, সে জন্য শীতবস্ত্র বিতরণ করা হবে।
ভোলা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. হাসানুজ্জামান বলেন, ‘ইতিমধ্যে গঙ্গাপুর লঞ্চঘাটের পর থেকে দক্ষিণে সাড়ে ৪ কিলোমিটার তীর সংরক্ষণে ব্লকবাঁধের জরিপ সম্পন্ন হয়েছে। জরিপ শেষে ডিজাইন সম্ভাব্যতা সমীক্ষার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে।’