হোম > ছাপা সংস্করণ

শখের সর্বনাশ

মামুনুর রশীদ

বাঙালি বড়ই শৌখিন জাতি। শখ করে ছোটবেলায় খেলাধুলা করে, শখ করে পড়ালেখা করে। তারপর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা জীবিকার অন্বেষণ করে, সেটাও অনেকটা শখের বশবর্তী হয়েই। একটা বড় ডিগ্রি দরকার, ডিগ্রিটা জুটেও যায়। কিন্তু জীবিকার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। নাট্যকলা, চারুকলা অথবা পদার্থবিজ্ঞানে মাস্টার্স করে একটা ব্যাংকের চাকরি জোটে। বিজ্ঞান বা নাট্যকলার কোনো জ্ঞান কোথাও কাজে লাগে না। তারপর শখের সংসার, শখের বিয়ে। কিন্তু সংসারের জন্য তো অর্থ চাই, একটা চাকরি জোটাতে পারলে সেটা মিটে যায়। সরকারি চাকরি পেলে তো কথাই নেই, শখটা পুরোমাত্রাই মিটে যায়।

খেলতে খেলতে চাকরি, বৃষ্টি হলে, শীত পড়লে অথবা কোথাও কোনো গোলমাল হলে অফিসে যাওয়ার বালাই নেই। আর চাকরিতে যদি দুই পয়সা উপরি কামাইয়ের ব্যবস্থা থাকে তাহলে তো কথাই নেই। বাড়ি, গাড়ির পর শখের ভ্রমণ, আর চাই কী? বিদেশে একটা বাড়িও হয়ে গেল! যাদের শখের মধ্যে একটু ধান্দা ঢুকে গেছে, তাদের জন্য অনেক পথ খোলা থাকে। তারা রাজনীতিকে ব্যবসা বানিয়ে, চাকরিকে ব্যবসা বানিয়ে এবং রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার একের পর এক উদাহরণ সৃষ্টি করে।

বাঙালির রাজনৈতিক ইতিহাসটাও খুব মজার। বিদেশি শাসক আলীবর্দী খাঁ শখ করে তাঁর যুবক নাতিকে সিংহাসনে বসিয়ে দিলেন। ইংরেজদের সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি লাগিয়ে ধান্দাবাজদের পাল্লায় পড়ে গেলেন। যুদ্ধ হলো, পলাশীর প্রান্তরের যুদ্ধে কী ছেলেমানুষই না করলেন! ঠিকমতো সেনাপতিদের যুদ্ধ করতে দিলেন না। অদূরদর্শী, অনভিজ্ঞ শখের নবাব পালাতে গিয়ে ধরাও পড়ে গেলেন। ওদিকে মীর জাফরের দল শখ করে বাংলার সিংহাসনটা দখল করে নিল! অর্থাৎ একেবারে হাতে ধরে একটা বিদেশি কোম্পানির কাছে দেশটা দিয়ে দিল। আর বাঙালিরা তাদের সেবাদাস হয়ে জমিদারি, দেওয়ানি, কেরানিগিরি—এসব পেয়ে গেল। এর মধ্যে কিছু কিছু বাঙালির দেড় শ বছর পরে ঘুম ভাঙল। শখ করে ওকালতি করতে করতে রাজনীতিতে ঢুকে গেলেন। তারপর খেলতে খেলতে এত বড় ভারতবর্ষকে ভাগ করে ফেললেন। জিন্নাহ-নেহরুর শখের সিংহাসনটা জুটল বটে, কিন্তু খেলাধুলা চলতেই থাকল, এখনো চলছে।

জনীতিবিদেরা খেলা পছন্দ করেন। তাই বলেই ফেললেন, খেলা হবে। আর সেই খেলা দুই বাংলাতেই চলছে। এই তো সেদিনের সংবাদে দেখলাম বাঙালির প্রতিবেশী গুজরাটে একটা সেতু দুর্ঘটনায় শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে আরও অনেকে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। এ রকম ঘটনা হরহামেশাই হচ্ছে। প্রযুক্তিবিদেরাও খেলতে খেলতে দালান তৈরি করেন, সেতু বানান আর কিছুদিন পরেই তা ভেঙে পড়ে। আবার খেলারও একটা মজা আছে, খেলায় টাকা আসে। একবার একটু পাকা খেলোয়াড় হতে পারলে টাকার ছড়াছড়ি। বিনোদন মাধ্যমেও তা-ই। টাকার ওপর ভাসতে থাকেন তাঁরা, কিন্তু সেখানেও ব্যবহার অনেকটা শৌখিন।

বাঙালি ছোটবেলায় শখ করে কবিতা লেখে। কিন্তু বয়স বাড়ার পরে তার একটা উপলব্ধি হয়, কবিতায় টাকা আসবে না। তাই শখের কবিতা লেখা ছেড়ে সে শখের চাকরির পেছনে দৌড়ায়। অনেক আগে প্রমথনাথ বিশী বলেছেন, ‘বাঙালির চাকরি না থাকলে আর থাকিল কি?’ কথাটা এত দিনে মিথ্যে প্রমাণিত হয়েছে। বাঙালির থাকার অনেক কিছু আছে। বাঙালি শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে ব্যবসায় রূপান্তরিত করার ক্ষমতা রাখে এবং শখের বশে সেটা নিয়ে খেলতে খেলতে টাকাপয়সাও মিলে যায়। আর সেই সঙ্গে মিলে যায় অসংখ্য অসহায় মানুষের জীবন। বাঙালির মধ্যে যাঁরা সত্যিই কিছু করতে চেয়েছেন, তাঁদের জীবনে এমন হতাশা এসেছে যে জীবনের শেষে তাঁদের একমাত্র আশ্রয় হচ্ছে নিঃসঙ্গতা। আবার অস্ত্র দিয়ে খেলতে খেলতে কিছু শৌখিন সৈনিক একজন বড় নেতাকে হত্যাই করল। শুরুটা কিন্তু ভালোই, শখ করে শিশু সংগঠনে যোগ দেওয়া, সেখান থেকে শিল্প-সাহিত্যের সংগঠন, তারপরেই মেহনতি মানুষের জন্য কিছু করার প্রয়োজনে রাজনীতি। কিন্তু শেষমেশ পুরো রাজনীতিটা শৌখিনতায় পর্যবসিত হয়। সেখানেও কত জীবন বলি হয়ে গেল। শখের তাত্ত্বিকের ঝোলায় কিছু বই থাকল আর পরনে থাকল সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা।

আর অন্যদিকে ভালো ধান্দা যারা করতে পারে, তারা রাষ্ট্রের খাজাঞ্চিটাকে শূন্য করে দিল। উন্নত দেশগুলো বহু আগেই শৌখিনতা ত্যাগ করেছে। শিশুকাল থেকেই তাদের মাথায় ঢুকেছে একেবারে না বুঝেই পেশাদারি। জীবনে যা কিছু করতে হবে, তা দায়িত্বের সঙ্গে করতে হবে। অধীত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে সব জায়গায় কাজে লাগাতে হয়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে হবে। জাপানের কোনো যুবক সেলফোনে মিথ্যা কথা বলে বিলম্বে অফিসে ঢুকবে না। জরুরি কাজ থাকলে কিংবা ভূমিকম্প হলেও সে ঘরে বসে থাকবে না। তার এত বুদ্ধি নেই যে সে ঘরে বসে বসে কাজ ফাঁকি দেওয়ার নানান কারণ বের করবে। পেশাদারির বিপরীতে আছে কর্তব্যে অবহেলা এবং দায়িত্বহীনতা। আজকের শিশুরা ওই শখের শিক্ষকদের ছোটবেলা থেকেই ফাঁকি দিতে দেখে এসেছে। ফাঁকিবাজ স্যাররা শ্রেণিকক্ষে না আসুক, কিন্তু পরীক্ষার খাতাটাও নিজে দেখেন না। প্রযুক্তিকে সঠিক কাজে না লাগিয়ে বিভিন্ন ধরনের দ্বিতীয়-তৃতীয় পন্থা বের করে এবং তাতেই সে আনন্দ পায়। সুকৌশলে ঘরে বসে বুদ্ধি বের করে যে রাস্তায় জ্যাম হচ্ছে বলে তার অফিসে আসতে বিলম্ব হচ্ছে। আর শখের প্রশাসন এসব মেনেও নেয়।

পাশের বাসার লোকটা হঠাৎ করে আঙুল ফুলে কলাগাছ হলো। বিনাশ্রমে তা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে ওই পথটা খোঁজার চেষ্টা করে সবাই। আজকাল মেহনতি মানুষেরা শ্রম চুরি করে শখের নেতাদের পেছনে থেকে রাতারাতি বড়লোক হয়ে যাচ্ছে। পত্রপত্রিকায় তাদের খবর প্রকাশ হলে ধিক্কার না দিয়ে ওটাকেই একটা পথ বলে বিবেচনা করে। একজন পেশাজীবী তার নিজের পেশার চেয়ে রাজনীতিটা ভালো বোঝে। সে রাজনীতিটাকে পদোন্নতির জায়গায় নিয়ে যাবে। ওপরের সাহেবরা এভাবেই ওইখানে গিয়ে পৌঁছেছেন।

শৌখিনতার বিপরীতে যে শব্দটি প্রচলিত তা হচ্ছে—পেশাদারি। নিজের পেশাকে বোঝা এবং সর্বান্তঃকরণে সেই পেশায় নিজেকে সমর্পণ করা। বাঙালির জীবনে এ রকম লোকও আছে প্রচুর। কিন্তু তারা উপহাসের পাত্র হয়ে আছে। ব্যবস্থাটাই এমন চমৎকার যে এদের সমঝদারও পাওয়া যায় না। দক্ষ, সৎ মানুষটি একাকী। আর অদক্ষ লোকটির চারদিকে অসংখ্য মানুষ। দক্ষ লোকটি বাজারে গিয়ে থলে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় আর অসৎ-অদক্ষ মানুষটি বাজার কিনে ফেলে। কখনো দেখা যায়, তার বাজার করার প্রয়োজনও হয় না। সুবিধাভোগীর দল দেশের শ্রেষ্ঠ জিনিসগুলো তার বাড়িতে পৌঁছে দেয়। এই অদক্ষ ও অসৎ মানুষটি কথায় বড়ই পটু। এরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলে, অদক্ষতার বিরুদ্ধেও কথা বলে এবং ধর্মকে চমৎকারভাবে ব্যবহার করতে পারে। ধর্ম যে একটা বড় অস্ত্র, এটা ছোটবেলা থেকেই তারা বুঝে ফেলেছে। ঘুষখোর আমলাটি নামাজ পড়ার নাম দিয়ে অফিস ফাঁকি দিচ্ছে তো বটেই, আবার নামাজে যাওয়ার আগেই পকেটটা ঘুষের টাকায় ভারী করে নিয়ে যায়।

আর অন্যদিকে ধর্মপ্রাণ পেশাদার লোকটি গোপনে ধর্ম পালন করে এবং অফিসে কোণঠাসা হয়ে বসে থাকে। কাজের বেলায় তার ডাক পড়ে, কিন্তু বিনিময়ে তার কোনো প্রশংসা মেলে না। শখের বড় বা ছোট ভাইটি প্রশংসা পেয়ে পেয়ে টাকাপয়সা লুটপাট করে একসময়ে ডানা মেলে বিদেশে চলে যায়। তাই শখ আমাদের জীবনের সর্বক্ষেত্রে সর্বনাশ ডেকে এনেছে আর মুষ্টিমেয় সাফল্য আকাশচুম্বী হয়ে পড়েছে।

দেশের চিন্তায় হয়তো দু-একজন লোক বিনিদ্র রাত কাটাচ্ছে আর অনাহারে, অনিদ্রার দিনরাত্রি কাটাচ্ছে কোটি কোটি সম্ভাবনাময় মানুষ। শখের বশে উচ্চশিক্ষা স্বভাবতই একটা ভারী বোঝা হয়ে যায়। অথচ এ বোঝা টানছে কোটি কোটি শিক্ষার্থী। এদের মধ্যে যারা শখের রাজনীতির মজাটা বুঝে গেছে, তাদের সমস্যা নেই। সমস্যা হচ্ছে তাদেরই, যারা দক্ষতা অর্জন করেছে অনেক কষ্টে, নিজের কাজটি বোঝে এবং নীরবে দায়িত্বটি পালন করে যাচ্ছে। 
বাজার অর্থনীতির আরেক নাম টাকা। এই টাকা ওড়ে, কিন্তু সঠিক প্রাপকের কাছে সে ধরা দেয় না।

সে এক দুষ্ট প্রজাপতি। তার প্রেমিক ওই শখের খেলোয়াড়েরা। আত্মঘাতী বাঙালির কাছে এই শখের মানুষগুলো বড়ই প্রিয়। আর অপ্রিয় হচ্ছে সেই সব মানুষ, যারা শুধু স্বপ্ন দেখে না, তার একটা বাস্তবায়ন করতে চায়। দেশের টাকা, দেশের মেধা বাইরে না পাঠিয়ে দেশটাকে বাসযোগ্য করতে চায়। শৌখিন বাঙালির খেলাধুলার মধ্যে বাঙালি আটকে গেছে। বড় বড় আন্দোলনের কথা না বলে বাঙালি কি কর্তব্যবোধ নিয়ে পেশাদারিতে ফিরে আসতে পারবে? পেশাদারিই পারে শখের জঞ্জালকে পরিষ্কার করতে।

লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব 

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ