‘ছাত্ররাজনীতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে পারে না’ শিক্ষামন্ত্রীর এই উদ্ধৃতিকে শিরোনাম করে ৮ সেপ্টেম্বর দৈনিক আজকের পত্রিকার প্রথম পাতায় যে খবরটি প্রকাশিত হয়েছে, সেটিকে কেন্দ্র করেই আমার আজকের লেখা। শিরোনামটির দিকে দৃষ্টিপাত করলে এটি বোঝা যায় যে সরকার বা সরকারি দলের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি চাইছে কিন্তু কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান সেটি হতে দিচ্ছে না।
গুগল করে কিছু তথ্য পেলাম, যা এ রকম: সম্প্রতি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগ ১৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংগঠনিক কমিটি ঘোষণা করে। এর মধ্যে নর্থ সাউথ, ইস্ট ওয়েস্ট, ব্র্যাকসহ ১২টি বিশ্ববিদ্যালয় রাজধানীতে অবস্থিত। অন্য চারটি ঢাকার বাইরের।
৪ সেপ্টেম্বর গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তাদের কমিটিগুলোর একটি সম্মিলিত কাঠামো গড়ে তোলার এক পর্বে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী, বিশেষ করে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে প্রধান অতিথি করে ৩ সেপ্টেম্বর একটি সম্মেলন করেছে। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে যে বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত রূপ লাভ করেনি; পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যেই রয়েছে। তবে এতেই নড়েচড়ে বসেছে সচেতন মহল এবং অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তারা ক্যাম্পাসের ভেতরে যাতে সরাসরি ছাত্রসংগঠনের কার্যক্রম পরিচালিত না হয়, সে জন্য নোটিশও করেছে।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে কোনো এক অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ‘সরকার শিক্ষার্থীদের রাজনীতিসচেতনতা ও সম্পৃক্ততাকে নিরুৎসাহিত করে না। তবে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ভেতর দলীয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চলবে কি না, তা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম দ্বারাই নির্ধারিত। ক্যাম্পাসের বাইরে ইতিবাচক রাজনীতির ধারায় অংশগ্রহণ একান্তই শিক্ষার্থী ও তাঁদের অভিভাবকেরা ঠিক করবেন।’
শিক্ষামন্ত্রীর এই পর্যবেক্ষণকে আমার যথার্থ মনে হয়েছে। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের পলিসি, শৃঙ্খলা ও নিয়মকানুন অনুযায়ী পরিচালিত হয়ে আসছে। অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বমানের কোর্স-কারিকুলাম, সেমিস্টারভিত্তিক কর্মোপযোগী শিক্ষাদান পদ্ধতি, সেশনজট, রাজনৈতিক সংঘাত ও দলাদলিমুক্ত উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে দেশ-বিদেশে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে ব্যাপক আস্থা ও সুনাম অর্জন করেছে।
এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের নানামুখী প্রতিভার বিকাশ ও নেতৃত্বের গুণাবলি অর্জনের জন্য বিভাগভিত্তিক স্টুডেন্ট ক্লাব গঠন করে নিয়মিত সহশিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে। এসব ক্লাবের ব্যবস্থাপনায় স্টুডেন্ট কর্তৃক নিয়মিতভাবে আয়োজিত নানা অনুষ্ঠান, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, ওয়ার্কশপ, ক্রীড়া, সাংস্কৃতিক চর্চা, মন ও শরীর গঠনের মতো আবশ্যিক কাজগুলো আন্তবিশ্ববিদ্যালয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, এটুকুতে আমরা সন্তুষ্ট কি না? নাকি ছাত্ররাজনীতি আবশ্যিক।
এ প্রসঙ্গে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি আল নাহিয়ান খান বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি আদায়ের জন্য প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি থাকা উচিত বলে আমরা মনে করি। বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছাত্ররাজনীতিকে নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করছে। তাদের উদ্দেশে বলব, ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করে দয়া করে জঙ্গিবাদকে প্রশ্রয় দেবেন না।’
এখানেই আমার প্রশ্ন, দেশের সব কটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এ মুহূর্তে ছাত্ররাজনীতি বহাল আছে। শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবির প্রতিফলন কি আমরা সেখানে দেখছি? জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেদের আটটি আবাসিক হলে প্রশাসনের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। আসন (সিট) বরাদ্দের পুরো বিষয় নিয়ন্ত্রণ করেন ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেদের ১৩টি আবাসিক হলের প্রশাসনিক ক্ষমতা হল প্রাধ্যক্ষদের হাতে থাকলেও ছাত্রলীগই সেখানকার ছায়া প্রশাসন। অধিকাংশ হলে প্রাধ্যক্ষ পুতুল ভূমিকায়। ছাত্রলীগের এসব ধারাবাহিক অপকর্ম নীরবে মেনে চলেছেন তাঁরা।
সিলেটে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) আবাসিক হলগুলোর ৮০ শতাংশ সিট ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে। মিছিলে যাওয়ার শর্তে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের ছয়টি গ্রুপ (পক্ষ) সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে এসব সিট বিলিবণ্টন করে বলে অভিযোগ রয়েছে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে কোনো সিটে ছাত্র ওঠাতে হলে ছাত্রনেতাদের কাছে সুপারিশ পাঠাতে হয় বলে জানা গেছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকতে চাইলে ছাত্রলীগই শেষ কথা। দেশের অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে এ থেকে খুব বেশি ব্যতিক্রম, তা বলা যাবে না।
বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদের কথা সবার নিশ্চয়ই মনে আছে। ২০১৯ সালের অক্টোবরে বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা পিটিয়ে তাঁকে হত্যা করেছেন। সেই থেকে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ আছে।
সবগুলো রিপোর্ট সাম্প্রতিক সময়ের বলে দায় চেপেছে ছাত্রলীগের ওপর। কিন্তু আমরা যদি ২০০১ থেকে ২০০৬ বা তারও আগে ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সময়সীমার দিকে তাকাই তাহলে এর চেয়ে ভালো অবস্থা বিরাজমান ছিল তখন? নিশ্চয়ই না।
এখন তো শুধু ছাত্রলীগ, তখন ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের যৌথ তাণ্ডব ছিল। বিএনপির ১৯৯১-৯৬ শাসনামলে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। আমার বাবা আমাকে শর্ত দিয়েছিলেন: ‘যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চাও তাহলে শাবিপ্রবিতেই পড়তে হবে, অন্যথায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজে।’ দেশের প্রথম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং নতুন বলে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় এখানে ছাত্ররাজনীতির বীভৎস রূপ তখনো ফুটে না ওঠায় আমার বাবার এমন সিদ্ধান্ত।
একে তো নতুন বিশ্ববিদ্যালয়, তার ওপর বিভাগ সংখ্যা, শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম ছিল বলে রাজনৈতিক সহাবস্থান ছিল চোখে পড়ার মতো। একই রুমে ছাত্রলীগ-ছাত্রদলের নেতারা থাকত। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ও একসময় অশান্ত হয়ে উঠল ছাত্রশিবিরের দাপটে। তাদের ভয়ংকর রূপ তখন স্বচক্ষে দেখেছি।
এ কথা ঠিক যে আমাদের ছাত্ররাজনীতির আছে একটি সোনালি অতীত এবং গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। আবরার হত্যার মতো আরও অনেক হত্যাকাণ্ড প্রমাণ করে তা এখন অভিশাপে পরিণত হয়েছে। ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টির ট্রাস্টি বোর্ডের প্রধান মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের মতে, ‘১৯৯০ সালের পর থেকে দলীয় ছাত্ররাজনীতি দেশের জন্য কোনো উপকার বয়ে আনেনি।’ আমার ধারণা, এ কথার সঙ্গে একমত দেশের সিংহভাগ মানুষ। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, তখন দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে সেই দলের ছাত্রসংগঠন।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) এক হিসাব বলছে, ২০২০ সাল থেকে গত আগস্ট মাস পর্যন্ত ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল-সংঘর্ষে ৬ জন নিহত ও ২২০ জন আহত হয়েছেন। একই সময়ে ছাত্রলীগের সঙ্গে অন্য রাজনৈতিক দল, তাদের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘাতে ৩ জন নিহত ও ৫২০ জন আহত হয়েছেন।
শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবিদাওয়া নিয়ে কাজ করার কথা থাকলেও তা না করে ছাত্রনেতারা এখন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনের ব্যানার ব্যবহার করে নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারে ব্যস্ত। এহেন বাস্তবতায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্ররাজনীতি চালু করার পাঁয়তারা কি খাল কেটে কুমির আনতে যাওয়ার মতো বোকামি হবে না?